কাজীর বিচার
হযরত আলী (রাঃ) তখন মুসলিম বিশ্বের খলিফা। তার সাহস ও বীরত্বের জন্য তিনি সারা আরবের মশহুর। তাঁর ছিল একটি দু’ধারী তলোয়ার- জুলফিকার। এই তলোয়ার নিয়ে জিহাদে ঝাপিয়ে পড়তেন তিনি। ছিনিয়ে আনতেন বিজয়। তাকে বলা হতো শেরে খাদা বা আল্লাহর বাঘ।
বীরত্বের জন্য তিনি উপাধি পেয়েছিলেন আসাদুল্লাহ, মানে আল্লাহর সিংহ।
তিনি যখন খলিফা তখনকার ঘটনা। তাঁর সেই বিখ্যাত তলোয়ারটি চুরি হয়ে যায়।
অধিকাংশ সাহাবীই তাঁর তলোয়ারটি চিনতেন। জীবনে বহুবার জিহাদের ময়দানে তাঁরা দেখছে এই তলোয়ার।
তলোয়ারটি সন্ধানে বেরিয়ে পড়লো সৈনিকরা। অনেক খোঁজাখুজির পর তলোয়ারটি পাওয়া গেল এক ইহুদির ঘরে। কিন্তু ইহুদী কিছুতেই স্বীকার করল না। এটি আলীর (রাঃ) তলোয়ার। বলল, বরাবরই এটি আমার তলোয়ার ছিল এবং এখনো আছে।
ইহুদীর কথায় ক্ষেপে গেল মুসলমানরা। একে তো চুরি করেছে, তার ওপর মিথ্যা বলছে। ক্ষিপ্ত মুসলমানরা তাকে মারতে গেল।
হযরত আলী (রাঃ) বললেন, তোমরা আইন নিজের হাতে তুলে নিও না।
আমি খলিফা হতে পারি। কিন্তু আল্লাহর বিধানে খলিফা ও প্রজাতে কোন তফাৎ নেই।
আইনের চোখে সবাই সমান।
খলিফা আলী (রাঃ) কাজীর দরবারে বিচার দিলেন। নির্দিষ্ট দিনে ডাক পড়ল ইহুদী ও খলিফার।
দরবারে লোকে লোকারণ্য। বিচারকের আসনে বসলেন কাজী। খলিফা বসলেন বাদীর আসনে আর ইহুদী আসামির কাঠগড়ায়।
বিচার শুরু হল। কাজী সাহেব বললেন, তুমি কি খলিফার তলোয়ার চুরি করছো,
ইহুদী বলল, আমি চুরি করতে যাব কেন? এটা তো আমারই তরবারি।
কাজী তাকালেন খলিফার দিকে। বললেন, এটা যে আপনার তলোয়ার তার কোন সাক্ষী আছে আপনার কাছে?
আলী (রাঃ) বললেন, আছে, আমার ছেলে হাসান এবং আমার খাদেম আমার সাক্ষী। তারা চেনে আমার তলোয়ার।
কাজী বললেন, কিন্তু এ সাক্ষ্য আমি গ্রহণ করতে পারবো না। কেন, আপনি কি মনে করেন ওরা মিথ্যা কথা বলবে?
না, আমি জানি আপনি নবীর আত্মীয়। আপনি বা আপনার সাক্ষীরা কেউ মিথ্যা বলবে না। কিন্তু ইসলামে পিতার পক্ষে পুত্র এবং মনিবের পক্ষে চাকরের সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য নয়। তাই আপনার নালিশ খারিজ করে দিলাম।
এ রাই শুনে সবাই হতবাক হয়ে গেল। কিন্তু খলীফা নীরবে কাজীর বিচার মেনে নিলেন । এ সময় ঘটল সেই অভাবিত দৃশ্য। ইহুদী এগিয়ে গেল হযরত আলী (রাঃ) এর সামনে। চিৎকার করে বলল, কী অকল্পনীয় বিচার! কী অনন্য আইন! খলিফার দাবীও গ্রহণযোগ্য হয় না সঠিক সাক্ষ্য প্রমাণ না থাকলে! আইনের প্রতি এতটা শ্রদ্ধাশীল যে ধর্ম তা কখনো মিথ্যা হতে পারে না।
ইহুদী তলোয়ারটি হযরত আলীর হাতে তুলে দিতে দিতে বললেন, আমিরুল মোমিনীন, এটি আপনারই তলোয়ার। সত্যি আমি এটি চুরি করেছিলাম। আপনি আমার জিনিস গ্রহণ করুন। আরো একটি জিনিস গ্রহণ করুন, যেটি আপনার নয়।
আলী (রাঃ), কাজী এবং উপস্থিত সবাই বিস্মিত চোখে তাকালো তাঁর দিকে, কাজী বললেন, কী সেই জিনিস?
ইহুদী বলল, আমার দেহ, আমার আত্মা, আমার ঈমান। আজ থেকে আমি নিজেকে মুসলিম বলে ঘোষণা করছি। এই বলে ইহুদী জোরে জোরে উচ্চারণ করলো, লা ইলাহা, ইল্লাল্লাহু মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ।
এই গল্পে আমাদের শেখায়, আইন সবার জন্য সমান। ক্ষমতার জোরে আইনকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করা অন্যায়। উপযুক্ত সাক্ষ্য প্রমাণ না থাকলে কাউকে শাস্তি দেয়া যায় না।
লেখলঃ আসাদ বিন হাজিফ