আকূল দরিয়ার মাঝে
এক বুজুর্গ বর্ণনা করেন, একদা আমি তাওয়াফ করার সময় হঠাৎ এক মহিলার উপর আমার নজর পড়ল। সে একটি শিশু সন্তান কোলে নিয়ে চীৎকার করে ফরিয়াদ করছিল- হে দয়াময়! হে দয়াময়! তোমার সেই ওয়াদা আমি পালন করেছি। আমি এগিয়ে গিয়ে সেই মহিলাকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার সাথে আল্লাহ্ পাকের কি ওয়াদা ছিল? উত্তরে সে এক মর্মন্তুদ ও বিস্ময়কর ঘটনার বিবরণ দিয়ে বলল,
একবার আমি এক জাহাজে চড়ে সমুদ্রে ভ্রমণ করতে ছিলাম। ঐ জাহাজে এক তেজরতী কাফেলাও ছিল। জাহাজটি গভীর সুমুদ্রে যাওয়ার পর হঠাৎ আকাশ অন্ধকার করে ভীষণ তুফান শুরু হল। মুহুর্তে সাগরের উত্তাল তরঙ্গের আঘাতে সকল যাত্রী ও মালামালসহ জাহাজটি ডুবে গেল। কিন্তু আল্লাহ্ পাকের মেহেরবানীতে অলৌকিক ভাবে আমি এবং আমার এ শিশুটি একটি তক্তার উপর বসে রইলাম। অতঃপর দেখতে পেলাম, আমাদের আদূরে আরেকটি তক্তার উপর এক হাবশী পুরুষ ভাসছে। রাতের আধার কেটে সকাল হবার পর হাবশী ভালোভাবে আমার দিকে তাকিয়ে দেখল। এবার ক্রমে তার চোখে মুখে আদীম লালসা ফুটে উঠল। হাবশী এগিয়ে এসে আমার তক্তার উপর উঠল এবং আমাকে অপকর্মের প্রস্তাব দিল আমি ঐ পাষান্ডের প্রস্তাবে অবাক হয়ে তাকে বললাম।
হে আল্লাহ্র বান্দাহ! তোমার অন্তরে কি আল্লাহ্র ভয় বলতে কিছুই নাই? একবারও কি ভেবে দেখনি যে, আমরা কি ভয়াবহ মুসীবতে লিপ্ত আছি? এই আকুল দরিয়ায় কি আলৌকিকভাবে আল্লাহ্ পাক এখন আমাদের জীবিত রেখেছেন এবং যে কোন মুহুর্তে আমরা চরম দূর্ঘটনায় শিকার হতে পারি। আল্লাহ্ পাকের অশেষ মেহেরবানী না হলে এ মহাবিপদ হতে আমাদের মুক্তির কোন উপায় আছে কি? অথচ এ কঠিন বিপদের সময়ও তুমি আল্লাহ্র নাফরমানী করতে চাচ্ছ?
পাষণ্ড হাবশী আমার কথার উত্তরে বলল, তোমার ঐ সকল কথা রাখ, কোন ছল ছাতুরীহ আজ তোমাকে আমার হাত থেকে রক্ষা করতে পারবে না। তার কথায় আমি প্রমাদ গুনলাম। তখন এই শিশুটি আমার কোলে ঘুমাচ্ছিল। আমি ইচ্ছা করে তাকে জাগিয়ে দিলে সে কাঁদতে লাগল। আমি কালক্ষেপনের উদ্দেশ্য বললাম, হে আল্লাহ্র বান্দা! তুমি ধৈর্য ধর। আমি তাকে ঘুম পাড়িয়ে নেই, অতঃপর ভাগ্যে যা আছে তাই হবে।
হাবশী অধৈর্য হয়ে বাচ্চাটিকে আমার হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে সাগরে নিক্ষেপ করল। মুহুর্তে যেন গোটা আকাশ পাতাল আমার চোখের সামনে লাফিয়ে উঠল। আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে আল্লাহ্র দরবারে ফরিয়াদ করলাম।
হে দয়াময় আল্লাহ্! তুমি মানুষের পশুবৃত্তিকে নিবৃত্ত করতে পার। তুমি আমাকে এই পাষণ্ডের হাত থেকে রক্ষা কর। আর সাগরে নিক্ষিপ্ত আমার সন্তানকে রক্ষা কর।
আল্লাহ্র শপথ! আমার ফরিয়াদ শেষ হবার পূর্বেই হঠাৎ সমুদ্র থেকে একটি হাঙ্গর মুখ হা করে ভেসে উঠল এবং সাথে সাথে হাবশীকে গ্রাস করে পূনরায় পানিতে ডুবে গেল। আল্লাহ্ পাক এভাবেই আমাকে ঐ পাষণ্ডের হাত থেকে রক্ষা করলেন। অতঃপর সমুদ্র তরঙ্গের আঘাতে আঘাতে আমি এক দ্বীপে গিয়ে ভিড়লাম। দ্বীপটি ছিল শস্য-শ্যামল। আমি সেখানেই আল্লাহ্ পাকের পক্ষ থেকে মুক্তির কোন উপায়ের আশায় অপেক্ষা করতে লাগলাম। এভাবে আমার চারদিন কেটে গেল।
পঞ্চম দিনে আমি দূর থেকে একটি জাহাজ দেখতে পেলাম। সাথে সাথে আমি একটি টিলার উপর উঠে কাপড় নেড়ে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম। নাবিক আমাকে দেখতে পেয়ে একটি নৌকা যোগে তিনি এক ব্যক্তিকে দ্বীপে পাঠিয়ে আমাকে উদ্ধার করলেন। জাহাজে উঠে আমি দেখতে পেলাম, আমার সে নয়ন মনি সেখানে বসে আছে। বিস্ময়ের রেশ কেটে উঠার পূর্বেই আমি ছুটে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলাম। আমার দু’চোখ বেয়ে অজস্র ধারায় আনন্দাশ্রু বইতে লাগল। আমি সকলে বললাম, এ শিশু আমার কলিজার টুকরা, আমার নয়নমণি। কিন্তু তারা আমার এ আচরণে বিস্মিত হয়ে বলল, তুমি পাগল, তোমার বিবেগ বুদ্ধি লোপ পেয়েছে। আমি বললাম, আমি পাগল নই, বিবেকও লোপ পায়নি।
অতঃপর আমি আনুপূর্বিক সব ঘটনা বর্ণনা করলে তারা বিস্ময়ে স্তব্দ হয়ে গেল। তাদের দলপতি বলল, বেটী! তুমি বড় আশ্চর্য ঘটনা শোনাচ্ছ। এবার আমরাও তোমাকে একটি আশ্চর্য ঘটনা শোনাব।
আমরা অনুকুল বাতাসে জাহাজ ছুটে সামনে এগুচ্ছিলাম হঠাৎ এক বিশাল জন্তু জাহাজের পথ রোধ করে দাঁড়াল। সেই জন্তুটির পিঠের উপর এ শিশুটি বসা ছিল। ঐ সময় গায়েব হতে কে যেন বলে উঠল, তোমরা যদি এই শিশুটিকে নিয়ে না যাও, তবে তোমরা ধ্বংস হয়ে যাবে। সুতরাং আমরা ঐ জন্তুর পিঠ হতে শিশুটিকে জাহাজে উঠালাম। সাথে সাথে জন্তুটি পানিতে ডুবে গেল। এখন আমরা ঐ ঘটনায় এবং তোমার মুখ হতে শোনা ঘটনায় প্রভাবিত হয়ে অতীতের নাফরমানী ও পঙ্কিল জীবন হতে তাওবা করছি। ঐ জাত বড় পবিত্র, যিনি স্বীয় বান্দাদেরকে ভালোবাসেন এবং বিপদে তাদের সাহায্য করেন।