মূসা আঃ এর বিয়ের প্রস্তাব
ঘরে ফিরেও দু বোন এ অপরিচিত যুবকের মাঝে দেখা গুণ বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করছিলেন। তাদের কথাবার্তার শব্দ শুনে হযরত শুআইব (আঃ) কন্যাদ্বয়কে অন্য দিনের তুলনায় এত দ্রুত ঘরে ফিরার কারণ জিজ্ঞেস করলে তারা পিতার কাছে ঘটোনা সবিস্থরে বর্ণনা করেন। তারা এও বলল, যুবকটি অতুলনীয় দৈহিক শক্তি ও সুঠাম দেহের অধিকারী, পুণ্যবান ও আমানতদার।
সুতরাং আমাদের মনে হয়, এ সুবককে আমাদের ঘরের কাজ কর্মের জন্য রেখে দিলে ভাল হবে। কেননা যে কোন কাজ সুষ্ঠভাবে সম্পন্ন করার জন্য দৈহিক শক্তিমত্তা এবং আমানতদারীর সর্বাধিক প্রয়োজন। হযরত শুআইবও (আঃ) ঘর – গৃহস্থালীর কাজ সুষ্ঠভাবে সমাধার জন্য দৈহিক শক্তিমত্তার অধিকারী একজন আমানতদার লোকের প্রয়োজন ইতো পূর্বেই অনুভব করেছিলেন। কন্যাদ্বয়ের কাছে সফুরাকে প্রেরণ করেন।
শুআইব (আঃ) এর জৈ্যষ্ঠ কন্যা সফুরা অত্যন্ত সংযতভাবে, সংযত বেশবুসে ততকালীন সময় প্রচলিত পর্দারীতি রক্ষা করে সলজ্জভাবে মূসা (আঃ)- কে ডেকে আনার উদ্দেশ্যে গমন করেন। এ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেন-
অর্থঃ অতঃপর কন্যাদ্বয়ের একজন সলজ্জভাবে চলতে চলতে এসে বলল, আমার পিতা আপনাকে ডেকেছেন, আপনি যে পানি পান করিয়ে দিয়েছেন তার বিনিময় দেয়ার জন্য।
জৈষ্ঠা কন্যাকে প্রেরণ কালে হযরত শুআইব (আঃ) পানি পানের বিনিময় দেয়ার উদ্দেশ্যে মূসা (আঃ) কে ডেকে পাঠাননি। বিনিময় প্রদান করতে ডেকেছেন এ উক্তি শুআইব এর কন্যার স্বউক্তি। কেননা, তারা মূসা (আঃ) কে গৃহস্থলীর কাজে নিযুক্ত করার প্রস্তাব পেশ করলেও শুআইব (আঃ) তাদের এ প্রস্তাবের প্রতি কোন প্রকার সম্মতি প্রকাশ করেননি।
আবার অসম্মতি জানান নি। তাই কন্যা অনুমান করেছে, সম্ভবত পিতা এ যুবককে পানি পানের বিনিময় দেয়ার জন্যই ডেকে পাঠিয়েছেন। কেননা, তারা পূর্ব হতেই দেখে আসছে, তাঁদের পিতা কাউকে দিয়ে সামান্যতম কোন কাজ করালে বা কেউ স্বেচ্ছায় কোন সাহায্য সহায়তা করলে তিনি তার বিনিময় প্রদান করতেন। পিতার এ সব রীতিই তাকে বিনিময় প্রদানের কথা বলতে উদ্ধুদ্ধ করেছে।
কিন্তু মূসা (আঃ) যখন বিনিময় প্রদানের কথা বলতে উদ্বুদ্ধ করেছে। কিন্তু মূসা (আঃ) যখন বিনিময় প্রদানের কথা শুনেন তখন চিন্তায় পড়ে যান। কারণ তিনি তো কোন বিনিময় লাভের আশায় কন্যাদ্বয়কে তাদের কর্মে সহযোগিতা করেন নি। বরং মানবিক কর্তব্যবোধই তাঁকে এ কাজে উৎসাহিত করেছে মাত্র।
আর মানবিক কর্তব্য সম্পাদনের বিনিময় গ্রহণ কোন মানুষের রীতিও হতে পারে না। অপর দিকে একজন বয়ঃবৃদ্ধ সম্মানিত লোকের আহ্বান প্রত্যাখ্যান করাও সমীচীন হতে পারে না। এসব চিন্তা ভাবনা করতে করতে তিনি শুআইব দুহীতার সাথে গমন করেন। যেহেতু এখানে মূসা (আঃ) এর প্রথম আগমন।
তাই পথঘাট তাঁর অজানা অচেনা। এজন্য শুআইব তনয়া তাঁকে পথ নির্দেশনার উদ্দেশ্যে আগে চলতে থাকেন। কিন্তু মূসা (আঃ) ভাবলেন, যুবতী একজন নারী আগে আগে পথ চলতে থাকলে তার প্রতি দৃষ্টি পড়া অত্যন্ত স্বাভাবিক, এতে নৈতিকতা ক্ষতিগ্রস্থ হবার সর্বাধিক সম্ভাবনা।
তাই তিনি তাকে তাঁর পিছন থেকে পথ দেখাতে বলেন। এভাবে শুআইব (আঃ)- এর দুহীতাকে পিছনে রেখে তার মৌখিক নির্দেশে মূসা (আঃ) শু’আইব (আঃ)-এর ঘরে পৌঁছার পর তিনি মূসা (আঃ) কে তাঁর সাথে খেতে আহ্বান করেন। জবাবে মূসা (আঃ) বলেন, আল্লাহ আপনার মঙ্গল করুন।
তাঁর এ কথা বলার উদ্দেশ্য, তিনি মানবিক কর্তব্য সম্পাদনের বিনিময় স্বরুপ কিছু গ্রহণে সম্মত নন। শু’আইব (আঃ) জিজ্ঞেস করলেন, কেন খাবে না, তুমি কি ক্ষুধার্ত নও। মূসা (আঃ) বলেন, আমি অবশ্যই ক্ষুধার্ত এবং তা খুব বেশিই। কিন্তু কাউকে কোন মানবিক সাহায্য দানের বিনিময়ে দুনিয়াসম স্বররণ হলেও আমি তা গ্রহণে প্রস্তুত নই।
কেননা, মানবিক সাহায্য সহাহতা প্রদান পরকালীন আমল। আর আমি এমন এক বংশধারার সন্তান, যাঁরা কোন মূল্যেই পরকালীন কোন আমল বিক্রি করতে সম্মত নয়। হযরত শুয়াইব (আঃ) বলেন, তোমাকে আহার করাতে দিচ্ছি কোন কিছুর বিনিময়ে নয়, বরং অতিথিপরায়ণতা আমার উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত। তাই আমি অতিথিদেরকে খাওয়ায়ে থাকি।
সুতরাং তুমি যে কারণে শংকিত হয়ে খেতে অস্বীকার করছ, এখানে এমন কারণ সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। শু’আইব (আঃ) তাঁর জীবন বৃন্তান্তসহ সমগ্র অবস্থা এবং তাঁর মাদইয়ানে আসার কারণ ইত্যাদি সকল বিষয়ে জিজ্ঞেস করেন। মূসা (আঃ) তাঁর কাছে মাদইয়ানে উপনীত হবার কারণসহ আনুপূর্বিক সব ঘটনা সবিস্তরে বর্ণনা করেন। তাঁর বর্ণনা শুনে শু’আইব (আঃ) তাঁকে অভয় দান করেন।
পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে- অর্থঃ অনন্তর মূসা যখন তাঁর কাছে আসলেন এবং সমগ্র অবস্থা বর্ণনা করলেন, তখন তিনি বলেন, ভয় পেয়ো না। তুমি যালিমদের থেকে রক্ষা পেয়েছ। সূরা কাসাসঃ আয়াতঃ ২৫
হযরত মূসা (আঃ)-এর সমস্ত ঘটনা শুনে শু’আইব (আঃ) সান্ত্বনা ও অভয় দিয়ে বলেন, এখন তুমি সম্পূর্ণ নিরাপদ। কেননা, তুমি ফেরাউনের শাসনাধীন এলাকার বাইরে এসে গেছ। ফেরাউনের কর্তৃত্বের কোন কার্যকারিতা এখানে নেই, তাই তোমারও শংকিত হওয়ার কিছু নেই।
শু’আইব (আঃ) এর কন্যারা পর্দার আড়ালে তাদের পিতা ও আগত বিদেশী যুবকের কথোপকথান শুনছিলেন। কন্যাদ্বয়ের মধ্য থেকে জৈষ্ঠ্য কন্যা সফূরা পিতাকে বলল, এ যুবককে আমাদের সাংসারিক কাজকর্মের জন্য রেখে দিন। কেননা, এ যুবক দৈহিক শক্তিমত্তার অধিকারী এবং আমানতদার। আর সাংসারিক কাজকর্মে এমন ধরনের লোকেরই প্রয়োজন। এ সম্পর্কে আল্লাহ পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেন-
অর্থঃ কন্যাদ্বয়ের একজন বলল, হে আমার পিতা! আপনি তাঁকে কর্মচারী রাখুন, কেননা, সে উত্তম কর্মচারী যে শক্তিশালী ও আমানতদার। সূরা কাসাসঃ আয়াতঃ ২৬
কন্যার এ প্রস্তাবে শু’আইব (আঃ) বুঝে ফেলেন, ভিন দেশী অপরিচিত এ যুবক তাঁর কন্যাদ্বয় পছন্দ হয়েছে। – কেননা মানুষের সারারণ প্রকৃতি হচ্ছে- পছন্দনীয় কোন লোকের প্রশংসা করা। এক্ষেত্রে তাঁর কন্যাদ্বয় এ যুবকের শারীরিক শক্তিমত্তা ও আমানতকারীর প্রশংসা করছে। তিনি কন্যাকে বলেন তুমি তাঁর আমানতদারী গুণের পরিচয় পেলে কি করে।
শক্তিমত্তার পরিচয় তো পেয়েছ তোমাদের পশুপালকে কূপ থেকে পানি পান করানোর দ্বারা। কিন্তু আমানতদারীর পরিচয় তো তোমাদের পাবার কথা নয়। সফুরা বলেন, পানি পান করানোর সময় এবং আপনার আহবানে আমাদের ঘরে আসার সময় পথে তাঁর আচার-আচরণ ও চলন বলনে তাঁর আমানতদারীর পরিচয় পেয়েছি। শু’আইব (আঃ) কন্যাদ্বয়ের যুক্তি স্বীকার করেন।
কন্যাদ্বয়ের যুবক মূসা (আঃ) সম্পর্কিত কথাবার্তায় আশ্বস্ত হয়ে হযরত শু’আইব (আঃ) এর আস্থা হয়েছে, কন্যাদ্বয়ের কাউকে যদি এ যুবকের সাথে বিয়ে দেয়ার প্রস্তাব করি তাহলে সে অমত করবে না।
তাঁর এরূপ আস্থার ভিত্তি হল-তাঁর কন্যাদ্বয় যখন যুবককে কর্মচারী রাখার প্রস্তাব দেয় তখন সে তা অস্বীকার করেনি। সুতরাং কন্যা বিয়ের প্রস্তাব কর্মে নিযুক্ত করার প্রস্তাব অপেক্ষা উত্তম, তাই তার অস্বীকার করার কথা নয়। এ চিন্তা করে শু’আইব (আঃ) বিদেশী অপরিচিত যুবক মূসা (আঃ) এর কাছে সরাসরি নিজের কন্যাকে বিয়ে দেয়ার প্রস্তাব দেন।
এ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
“তিনি তাঁকে বলেন, আমি আমার এ কন্যাদ্বয়ের একজনকে তোমার সাথে বিয়ে দিতে চাই শর্ত হল, তুমি আট বছর আমার চাকরি করবে (এটা বিয়ের মহরানা), অতঃপর তুমি যদি দশ বছর পূর্ণ কর, তবে তা তোমার পক্ষ হতে (অনুগ্রহ) হবে, আর আমি তোমার উপর কোন চাপ প্রয়োগ করতে চাই না; আল্লাহ চাহেন তো তুমি আমাকে সদাচারী পাবে।
হযরত মূসা (আঃ) শু’আইব (আঃ) এর প্রস্তাব গ্রহণ করে বলেন-
অর্থঃ তিনি বলেন, আমার ও আপনার মাঝে এটাই সিদ্ধান্ত হল; এ দু’মেয়েদের যেটাই আমি পূরন করি, আমার প্রতি কোন বাধ্যবাধকতা থাকবে না-আর আমরা যা বলছি, আল্লাহই এর স্বাক্ষীরুপে যথেষ্ট। (সূরা কাসাসঃ আয়াত -২৮)
চুক্তি মোতাবেক মূসা (আঃ) আট বছর পর্যন্ত শু’আইব (আঃ)-এর কর্মে নিয়োজিত থাকেন এমনকি ইচ্ছাধীন বছরও পূরণ করেন। এতে পুরা দশ বছরই তিনি শু’আইব (আঃ) গৃহকর্মে নিযুক্ত থাকেন। আর শুআইব (আঃ) ও চুক্তির শর্তানুযায়ী কন্যা সফুরাকে হযরত মূসা (আঃ) এর কাছে বিয়ে দেন। চুক্তির শর্তমাফিক আট বছর ও ইচ্ছাধীন দু বছর মোট দশ বছর পূর্ণ করার পর হযরত মূসা (আঃ) মিসরে অবস্থিত তাঁর মা ও বোনের সাথে দেখা করতে যেয়ে শুআইব (আঃ) এর সমীপে নিবেদন করলেন।