গো-বাছুর প্রতিমা
মূসা (আঃ) যখন তুর পর্বতে গমন করেন তখন তাঁর ভাই হারুন (আঃ) কে তাঁর স্থলাভিষিক্ত করে যান। হারুন (আঃ) বনী ইসরাইলীদেরকে বলেন, হে আমার সম্প্রদায়ের লোকেরা তোমরা মিশর ত্যাগকালে কিবতীদের অনেক অলংকারপত্র সোনাদানা নিয়ে এসেছে। আবার তোমাদের অনেক কিছু তাদের কাছেও রয়ে গেছে।
তোমরা ভাবছ, কিবতীদের কাছে রয়ে যাওয়া তোমাদের সম্পদের বিনিময়ে তাদের থেকে আনা সম্পদের বিনিময়ে তোমরা তাদের যে সম্পদ এনেছ, সেগুলো ভোগ করা তোমাদের জন্য হালাল হবে না। কিবতীদের থেকে আনিত অলংকারপত্র সোনাদানা এবং অন্যান্য সম্পদ যেন তোমাদের স্বত্বাধীন না থাকে, সে জন্য এখনই একটি গর্তে এ সব সম্পদ নিক্ষেপ করে জ্বালিয়ে দেয়া সঙ্গত হবে। হযরত হারুন (আঃ)-এর নির্দেশ অনুসারে কিবতীদের থেকে আনা সব অলংকার, সোনাদানা ও অন্যান্য সম্পদ গর্তে ফেলে পুড়িয়ে দেয়া হয়।
তাদের মাঝে সামেরী নামে এক ব্যক্তি ছিল। সেখানে সেও উপস্থিত, কিন্তু তাঁর হাত ছিল মুষ্টিবদ্ধ। সে সকলকে মুষ্টিবদ্ধ অবস্থায় হারুন (আঃ)-এর নির্দেশ মোতাবেক কিবতীদের থেকে আনা অলংকারাদি ও সোনাদানা বা অন্য কিছু রয়েছে। তিনি তাকে মুষ্টিতে রক্ষিত বস্তু গর্তে ফেলার নির্দেশ দেন। সামেরী এতে রাজি না হয়ে বলল, তার হাতে কোন অলংকার বা সোনাদানা নেই বরং মৃত্তিকা রয়েছে। আর এ কোন সাধারণ মৃত্তিকা নয়। এ মৃত্তিকা হযরত জিবরাইল (আঃ)-এর ঘোড়ার পায়ের স্পর্শ পেয়েছে। এ মৃত্তিকার ইতিহাস জানার আগে সামেরী সম্পর্কে যথাসম্ভব জানা গেলেই পরবর্তী ঘটনাবলী বুঝতে সহজ হবে।
তার সঠিক পরিচয় সম্পর্কে ওলামাদের মত পার্থক্য দেখা যায়। কারো মতে সে ফেরাউন সম্প্রদায়ের লোক ছিল। হযরত মূসা (আঃ)-এর প্রতিবেশী ছিল। সে হযরত মূসা (আঃ)-এর প্রতি ঈমান এনেছিল। হযরত মূসা (আঃ) বনী ইসরাইলদের সাথে নিয়ে মিশর ত্যাগকালে সেও তাদের সঙ্গে এসেছিল। কারো মতে সে বনী ইসরাইলীদেরই একজন ছিল। বনী ইসরাইলের ছামেরার গোত্র প্রধান ছিল। সিরিয়াতে এ গোত্র সমধিক প্রসিদ্ধ।
হযরত সাঈদ বিন যুবাইর বলেন, সে ছিল পারস্য বংশোদ্ভুত কেরমান এলাকার অধিবাসী। হযরত ইবন আব্বাস (রাঃ) বলেন, সে এমন এক সম্প্রদায়ের লোক ছিল যারা গাভী পূজা করত কিন্তু কোন প্রকারে মিশরে প্রবেশ করেছিল। বাহ্যিকভাবে বনী ইসরাইলদের ধর্মে দীক্ষিত ছিল। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সে ছিল মুনাফিক। কারো কারো মতে তার নাম ছিল মূসা বিন যুফর।
হযরত ইবন আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, ফেরাউন বনী ইসরাইলদের নবাগত পুত্র সন্তানদের হত্যা করার জন্য নির্দেশ দেয়ার পর মূসা ও সামেরীর জন্ম হয়। তার মাতা ফেরাউনের সৈন্যদের ভয়ে গোপনে তাকে জঙ্গলের কোন এক জায়গায় রেখে এসেছিল। তার মা ভাবল যে, জঙ্গলে রাখলেও সন্তানের মৃত্যু অনিবার্য আবার বাড়ীতে রাখলেও ফেরাউনের সৈন্যদের হাতে তার মৃত্যু অনিবার্য। তাই চোখের সামনে ফেরাউনের সৈন্যদের দ্বারা আপন সন্তান হত্যা হওয়ার চেয়ে জঙ্গলে চোখের আড়ালে মরে যাওয়াই উত্তম। আল্লাহর ইচ্ছা হলে বেঁচে যেতে পারে। এদিক লক্ষ্য করে তাকে তার মা জঙ্গলে রেখে এসেছিল।
এদিকে হযরত জিবরাইল (আঃ) তাকে রক্ষার দায়িত্ব হাতে নিলেন। তিনি এক আঙ্গুলে মধু, অপর আঙ্গুলে মাখন এবং তৃতীয় এক আঙ্গুলে দুধ নিয়ে আসতেন। আর স্বীয় আঙ্গুল তার মুখের ভিতর প্রবেশ করিয়ে দিতেন। এভাবে সে ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠিল। তার মাতা তাকে দর্শনের নিমিত্ত মাঝে মাঝে জঙ্গলে যেতে। দেখতে যে তার পুত্র ধীরে ধীরে বেড়ে উঠেছে। বড় হওয়ার পর তাকে বাড়ীতে নিয়ে এল।
হযরত হারুন (আঃ) ভেবেছিলেন যে, সামেরীর হাতের মুষ্টিতে স্বর্ণ রয়েছে। তাই তিনি তাকে হাতের মুষ্টিতে রাখা স্বর্ণ গর্তে ফেলার নির্দেশ দিলেন। কিন্তু সামেরী এতে সম্মত হল না। বরং সে বলল যে, তার হাতে কোন অলংকার বা স্বর্ণ নেই। তার হাতে মৃত্তিকা। আর এ মৃত্তিকা কোন সাধারণ মৃত্তিকা নয় বরং এ মৃত্তিকা হযরত জিবরাইল (আঃ) এর ঘোড়ার পায়ের স্পর্শ পেয়েছে।
এ মৃত্তিকার ঘটনা সম্পর্কে তাফসীরের গ্রন্থসমূহে লিপিবদ্ধ আছে যে, হযরত মূসা (আঃ) বনী ইসরাইলদের নিয়ে লোহিত সাগর পাড়ি দেয়ার পর যখন ফেরাউনের লোকেরা সাগর পার হচ্ছিল তখন হযরত জিবরাইল (আঃ) ঘোড়ায় চড়ে তথায় উপস্থিত ছিলেন। অন্য এক বর্ণনায় পাওয়া যায় যে, হযরত মূসা (আঃ) সাগর পার হওয়ার পর হযরত জিবরাইল (আঃ) ঘোড়ায় চড়ে এসেছিলেন হযরত মূসা (আঃ)-কে জানিয়ে দেয়ার জন্য যে, তিনি যেন বনী ইসরাইলীদের নিয়ে তুর পাহাড়ের দিকে অগ্রসর হন। তখন সামেরী হযরত জিবরাইল (আঃ) দেখে চিনতে পেরেছিল।
কারণ সামেরীকে শিশু অবস্থায় হযরত জিবরাইল (আঃ) নিজেই প্রতিপালন করেছিলেন। তাই যে তাকে দেখেই চিনতে পারছিল। যেহেতু অন্য কারও সাথে তার পরিচয় ছিল না তাই অন্যরা তাকে দেখেনি বা চিনতে পারেনি। কোরআনের ভাষায়- بَصُرْتُ بِمَا لَمْ يَبْصُرُوا بِهِ
অর্থঃ আমি এমন কিছু দেখেছি যা তারা দেখেনি।
সামেরীর মনে শয়তানই এ কথা পয়দা করে দিল যে, হযরত জিবরাইল (আঃ)-এর ঘোড়ার পায়ের মৃত্তিকা যে অংশ স্পর্শ করে তা জীবন ও হায়াতের এক বিশেষ প্রভাব রাখে। অর্থাৎ এ মৃত্তিকা যে জিনিসের সাথে লাগবে তা জড় পদার্থ হলেও তাতে প্রাণের সঞ্চার হয় সুতরাং এখান থেকে মৃত্তিকা উঠিয়ে লও। সামেরীর মনে এ কথার উদ্ভব হওয়ার পর সে এখান থেকে কিছু মৃত্তিকা উঠিয়ে নিল। এক বর্ণনায় পাওয়া যায়, সামেরী দেখতে পেল যে, হযরত জিবরাইল (আঃ)-এর ঘোড়ার পা মৃত্তিকার যে অংশ স্পর্শ করে তা প্রাণবিশিষ্ট ও সজীব হয়ে ওঠে। তাই সে ধারণা করল যে, এ মৃত্তিকা যে বস্তুত লাগবে তাতেও প্রাণ আসবে। এজন্য সে কিছু মৃত্তিকা উঠিয়ে নিজের কাছে সংরক্ষিত রাখল।
সামেরী হযরত হারুন (আঃ)-কে বলল, আমি এক শর্তের ভিত্তিতে আমার মুষ্টিস্থিত মৃত্তিকা গর্তে রাখতে পারি যদি আপনি এ মৃত্তিকা সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালার কাছে এ দোয়া করেন যে, আমি যে উদ্দেশ্যে এ মৃত্তিকা যেখানে রাখব আল্লাহ পাক যেন আমাকে সে উদ্দেশ্যে সফল করার তৌফিক দেন। হযরত হারুন (আঃ) দোয়া করার প্রতিশ্রুতি দিলেন। আর সামেরী তার মুষ্টি ভর্তি মাটি গর্তে ফেলে দিল। হযরত হারুন (আঃ) প্রতিশ্রুতি মোতাবেক সামেরীর জন্য পর সামেরী বলল, আমি চাই যে, গর্তস্থিত সকল স্বর্ণ, রুপা ও তামার গলিত পদার্থের সম্বন্বয়ে একটি গো-বৎসের আকৃতি হয়ে যায়। হযরত হারুন (আঃ) দোয়া করেছিলেন আর সে দোয়া কবুলও হয়েছিল। তাই অলংকারাদির গলিত পদার্থ একটি গো বৎসের আকৃতি লাভ করল। এতে প্রাণ ছিল না বটে কিন্তু এটা হতে গরুর ডাকের ন্যায় শব্দ বের হত। কোরআনের ভাষায়-
فَأَخْرَجَ لَهُمْ عِجْلًا جَسَدًا لَّهُ خُوَارٌ فَقَالُوا هَـٰذَا إِلَـٰهُكُمْ وَإِلَـٰهُ مُوسَىٰ فَنَسِيَ
অর্থঃ সামেরী তাদের জন্য এসব অলংকারাদি হতে গো-বৎসের দেহ বের করে আনল যা গরুর ন্যায় শব্দ করত, তখন সে বলতে লাগল, এটাই তো তোমাদের ও মূসার ইলাহ।
বিস্ময়কর এ অবস্থা দেখে বনী ইসরাইলীরা কয়েক ভাগে বিভক্ত হয়ে গেল। একদল সামেরীর কাছে জিজ্ঞেস করল যে, একি? সামেরী বলল, এ তোমাদের খোদা। মূসা (আঃ) এর কাছেই গিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি পথ ভুলে অনত্র চলে গিয়েছিলেন একদল বলল, যে পর্যন্ত মূসা (আঃ) প্রত্যাবর্তন না করবেন আর এর প্রকৃত পরিচয় আমাদের সামনে তুলে না ধরবেন সে পর্যন্ত আমরা
সামেরীর কথা অসত্য বলতে পারি না। বাস্তবিক পক্ষে যদি এ আমাদের খোদা হয়ে থাকে তাহলে এর বিরোধিতা করে পাপী হতে চাই না। আর যদি এ সামেরীর কথা মত আমাদের খোদা না হয় তবে মূসা (আঃ)-এর অনুসরণ করাই আমাদের জন্য অপরিহার্য। অন্য একদল বলল, এসব কিছুই ইবলিসের ধোকা। এটা না আমাদের খোদা হতে পারে আর না আমরা এর প্রতি ঈমান আনতে পারি। আর সামেরীকেও আমরা এ বিষয়ে সত্য বলতে পারি না। অন্য একদল সামেরীর কথায় পূর্ণ ঈমান এনে একে খোদা বলে মেনে নিল।