আদ সম্প্রদায়ের ধ্বংসের বর্ণনা
এর পরও তাদের আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ এমন চরমে পৌঁছল যে, আল্লাহ তায়ালা তাদের প্রতি আযাব পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। প্রাথমিক পর্যায়ে তিন বছর পর্যন্ত বৃষ্টি বন্ধ করে দিলেন। ফলে দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দিল। আর দুর্ভিক্ষ এমনি চরম আকার ধারণ করল যে, তাদের নাকের ডগায় রূহ এসে পড়ল। তখনকার যুগে প্রথা ছিল কোন বিপদাপদে পতিত হলে সকলে মিলে মক্কা শরীফে আল্লাহর ঘরের সামনে সমবেত হয়ে বিপদ দূর করার জন্য আল্লাহ পাকের দরবারে প্রার্থনা করত। প্রথা অনুসারে তারা নিজেদের মধ্য হতে কিছু লোককে মক্কায় পাঠাল যাতে তারা সেখানে গিয়ে আল্লাহ পাকের কাছে দোয়া করে, তিনি যেন তাদের উপর থেকে বিপদ দূর করে দেন। আর বৃষ্টি বর্ষণ করেন।
তৎকালে মক্কায় আমালিকা বংশের কিছু লোক বসবাস করত। তখন আমালিকা সম্প্রদায়ের প্রধান ছিল মুয়াবিয়া বিন বকর। ভিনদেশী যে সব লোক মক্কায় আসত তাদের মেহমানদারী আমালিকা বংশের লোকেরা করত। এ হিসাবে আদ জাতির প্রতিনিধি দলও মুয়াবিয়া বিন বকরের মেহমান হল। দুর্ভিক্ষের কারণে তারা এক দীর্ঘ সময় ধরে ভুখা-নাঙ্গা ছিল। মক্কায় পৌঁছে ভাল ভাল খাদ্য আর পেট ভরে খাওয়ার সুযোগ পাওয়ার তারা স্বীয় সম্প্রদায়ের কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছিল। তাদের সম্প্রদায়ের লোকেরা যে উদ্দেশ্যে তাদেরকে পাঠিয়েছে তা তারা ভুলে গিয়েছিল। মুয়াবিয়া বিন বকর লজ্জার কারণে নিজে কিছু বলতে পারলেন না। তাই তিনি গায়িকাদেরকে কিছু কবিতা শিখিয়ে দিলেন। কবিতাগুলোর অর্থ ছিল- হে লোকেরা তোমাদের সপ্রদায়ের জন্য দোয়া কর। যাতে তাদের প্রতি আল্লাহ অনুগ্রহ করেন। তোমরা তো এখানে ভোগবিলাসে মত্ত কিন্তু তাদের অবস্থা খুব খারাপ ও নাজুক। গায়িকাদের মুখে এ কবিতা শুনে তারা সতর্ক হয়ে গেল এবং দোয়া করার জন্য কাবাঘরের সামনে উপস্থিত হল। সেখানে গিয়ে দোয়া করল। দোয়ার পর সাদা, কালো ও লাল বর্ণের তিন খণ্ড মেঘ আকাশে দেখা গেল। আর তখন আসমান হতে এক আওয়াজ এল যে, তোমরা মেঘ খণ্ডত্রয় হতে যে কোন একটি স্বীয় সম্প্রদায়ের জন্য বেছে নাও। তারা মেঘ খণ্ডত্রয় হতে কাল বর্ণের মেঘখন্ডটি বেছে নিল। তাদের ধারণা ছিল যে, কাল মেঘে অধিক পানি থাকবে। তাই অধিক পানি লাভের উদ্দেশ্যেই কাল মেঘ খণ্ড নিজেদের জন্য পছন্দ করেছিল। অতঃপর কাল মেঘ খণ্ড তাদের সাথে তাদের সম্প্রদায়ের দিকে উড়ে চলল। মেঘ খণ্ড নিকটবর্তী হতে তাদের সম্প্রদায়ের লোকেরা তা দেখতে পেয়ে খুব আনন্দিত হল। কুরআনে পাকে এরশাদ হয়েছে-
فَلَمَّا رَأَوْهُ عَارِضًا مُّسْتَقْبِلَ أَوْدِيَتِهِمْ قَالُوا هَـٰذَا عَارِضٌ مُّمْطِرُنَا
অর্থঃ অতঃপর এ মেঘ খণ্ডটি তাদের জনপদের দিকে আসছে দেখে তারা বলল, এ দিকে আগত মেঘ খণ্ডটি আমাদের প্রতি বৃষ্টি বর্ষণ করবে। (আহকফ)
কিন্তু আদজাতির এক মহিলা মেঘ খণ্ডটি দেখে বুঝতে পেরেছিল যে, এ মেঘ রহমতের মেঘ নয় এবং এটা আযাব হিসাবেই জনপদের দিকে আসছে। আল্লামা আলুসী (রহঃ) এক বর্ণনায় উল্লেখ করেছেন যার সারকথা হল, এ মেঘখণ্ড যে আযাব নিয়ে এসেছিল এক মহিলা সর্বপ্রথম বুঝতে পেরেছিল যে, মেঘখণ্ডটি পানির পরিবর্তে অগ্নি বহন কর জনপদের দিকে এগিয়ে আসছে। পরবর্তীকালে আযাব অবতীর্ণ হওয়ার পর অন্যান্যরা বুঝল যে প্রকৃতপক্ষে এটা বৃষ্টি বহনকারী মেঘ নয়।
আল্লাহপাক এরশাদ করেন-
بَلْ هُوَ مَا اسْتَعْجَلْتُم بِهِ ۖ رِيحٌ فِيهَا عَذَابٌ أَلِيمٌ
অর্থঃ বরং এটা এমন জিনিস যার তড়িৎ আগমন তোমরা চেয়েছিলে। এটা প্রবল তুফান যাতে মর্মস্তুদ আযাব রয়েছে। (আহকাফ)
মেঘখণ্ড আদ জাতির জন্য শাস্তিদায়ক বৃষ্টির বদলে আল্লাহর আযাব হয়ে আগমন করেছে। ক্রমাগত সাতরাত আটদিন পর্যন্ত ঝড় বইতে থাকে। ঝড় এত প্রবলবেগে প্রবাহিত হচ্ছিল যে, আদ জাতির সুদৃঢ় অট্টালিকাসমূহ ভেঙ্গে চুর্ণবিচুর্ণ করে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছিল। বড় বড় বৃক্ষসমূহ চর্বিত ঘাসের ন্যায় শিকড়সমূহ তুলে নিক্ষেপ করছিল। শক্তির দাবীদার আদ সম্প্রদায়ের লোকদেরকে একজন করে উপরে তুলে সেখান থেকে মাথা নীচের দিকে করে নিক্ষেপ করে সকলকে ধ্বংস করে দিল। মাত্র চার হাজার লোক যারা হযরত হূদ (আঃ)-এর অনুগত ছিল তারাই বেঁচেছিল।
অন্য বর্ণনায় হযরত হূদ (আঃ) যখন বুঝতে পারলেন যে, আল্লাহ তায়ালার তরফ থেকে আযাব আরম্ভ হয়ে গিয়েছে, তখনই তিনি যেখানেই ছিলেন তাঁর চতুষ্পার্শ্বে একটি বৃত্ত আঁকেন তদ্রূপ মমিনদের চতুষ্পার্শ্বে আর একটি বৃত্ত এঁকে দিলেন। মমিনদের কাছে উক্ত বায়ু ছিল সুশীতল বাতাসের ন্যায়। তারা এ বাতাসের সাহায্যে আরও অধিক আরাম ও সুখ ভোগ করছিল। অথচ এ বায়ুই আদ জাতিকে তাদের ঘরবাড়ি ও গাছপালাসহ তাদেরকে উপরে তুলে দূরে দূরে নিক্ষেপ করছিল। দেখে মনে হচ্ছে যে পাথরের বৃষ্টি হচ্ছে। (রুহুল মানী)
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা তাদের ধ্বংসের কথা বর্ণনা করেছেন-
وَأَمَّا عَادٌ فَأُهْلِكُوا بِرِيحٍ صَرْصَرٍ عَاتِيَةٍ(6)
سَخَّرَهَا عَلَيْهِمْ سَبْعَ لَيَالٍ وَثَمَانِيَةَ أَيَّامٍ حُسُومًا فَتَرَى الْقَوْمَ فِيهَا صَرْعَىٰ كَأَنَّهُمْ أَعْجَازُ نَخْلٍ خَاوِيَةٍ(7)
فَهَلْ تَرَىٰ لَهُم مِّن بَاقِيَةٍ(8)
অর্থঃ আর আদ জাতির লোকদের ধ্বংস করা হয়েছিল এক ধরণের প্রবল বায়ুর সাহায্যে যা নিয়ন্ত্রণের ও বাইরে চলে যাচ্ছিল। আর ক্রমাগত সাত রাত ও আটদিন এটা প্রবাহিত হয়েছিল। হে শ্রোতা! তুমি এ দৃশ্য দেখলে সেখানে ধরাশায়ী এক সম্প্রদায়কে দেখতে পেতে যেন তারা পতিত কতগুলো খেজুর বৃক্ষের কাণ্ড। তুমি তকি তাদের মধ্যে কাকেও অবশিষ্ট দেখতে পাচ্ছ?
আদ সম্প্রদায়ের প্রতি নাযিলকৃত আযাব যে কত প্রবল ছিল তা রাসূল (সাঃ)-এর আমলের মাধ্যমেই উপলব্ধি করা যায়। নবী কারীম (সাঃ) যখনই আকাশ মেঘাচ্ছন্ন দেখতেন তখনই আদ জাতির আযাবের কথা স্মরণ করে অস্থির হয়ে পড়তেন। হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত, যখনই বায়ু জোরে প্রবাহিত হতে শুরু হয় তখনই রাসূল (সাঃ) নিম্নের দোয়া পড়তেন-
اللهم إني أسألك خيرها وخير مافيها وخير ما أرسلت به وأعوذ بك من شرها وشر ما فيها وشر ما أرسلت به
অর্থঃ হে আল্লাহ! নিশ্চয়ই আমি আপনার দরবারে বায়ুর কল্যাণ, বায়ুর ভিতরে যা কিছু আছে তার কল্যাণকর অংশ এবং যা সহ এ বায়ু চালিত করেছেন তার ভিতরে যা কল্যাণকর তা কামনা করছি। আর এ বায়ুর মধ্যে যা কিছু আছে তার অনিষ্টকর অংশ এবং যা সহ আপনি এ বায়ু চালিত করেছেন তার মাঝে যা অনিষ্টকর তা থেকে আপনার আশ্রয় প্রার্থনা করছি।
আকাশ মেঘাচ্ছন্ন দেখলেই রাসূল (সাঃ)-এর পবিত্র চেহারা বিবর্ণ হয়ে যেত। তিনি অস্থির হয়ে পড়তেন। একবার ঘরের বাইরে আসতেন আবার ঘরের ভিতরে যেতেন। কখন হাটাহাটি করতেন আবার কখন বা বসে পড়তেন। বৃষ্টি হওয়া শুরু হলে চিন্তাভাবনা দূরীভূত হয়ে মুখমণ্ডলের বর্ণ স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসত। হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, একদিন আমি জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রাসূল আকাশ মেঘাচ্ছন্ন দেখলে আপনার এ অবস্থা কেন হয়? রাসূল (সাঃ) জবাবে বলেন, হে আয়েশা! আকাশে মেঘ দেখা দিলে আমি তো জানিনা যে, এটা কেমন মেঘ? না জানি এটা ঐ সম্প্রদায়ের মেঘের ন্যায় হয়ে যায় যে সম্প্রদায়ের লোকজন আকাশে মেঘ খণ্ড দেখে খুব আনন্দিত হয়ে বলেছিলেন, এটা আমাদের প্রতি বৃষ্টি বর্ষণ করবে। যাতে আমরা প্রশান্তি লাভ করব। (মুসলিম)