আল্লাহওয়ালাদের প্রতি ভক্তি

এক বুজুর্গ বর্ণনা করেন, একবার আমি মিশরের প্রখ্যাত বুজুর্গ  হযরত শায়েখ আবুল ফজল ইবনে জওহারীর সাথে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে মিশরের পথে যাত্রা করলাম। দীর্ঘ পথ ছফরের পর আমি জুমআর দিন মিশর নগরীতে গিয়ে উপস্থিত হলাম। সেদিন শায়েখ আবুল ফজল ওয়াজ করছিলেন। আমিও সেই ওয়াজ মাহফিলে শ্রোতাদের সাথে বসে গেলাম।

আমি দেখতে পেলাম, হযরত শায়েখের চেহারা ছুরতে একজন সুদর্শন   পুরুষ। সে সাথে তিনি উজ্জ্বল বর্ণের দামী দামী পোষাক পরে বেশ আরামের সাথে ওয়াজ করছেন। আমি মনে মনে বললাম, এই সেই ইবনে জাওহরী, যার বুজুর্গী ও  পরহেজগারীর সুখ্যাতি দেশ বিদেশে মানুষের মুখে মুখে ঘুরে ফিরছে। অথচ তাকে দেখে তো মনে হচ্ছে না। তিনি একজন আরাম প্রিয় ও বিলাশী ব্যক্তি। আমি মনে মনে এ কথা ভেবে বড় বিষ্মিত হলাম যে, এমন একজন বিলাশী ব্যক্তিকে মানুষ কেমন করে একজন বুজুর্গ হিসাবে মেনে নিল।

এসব কথা ভাবতেই ঐ বুজুর্গের প্রতি বীত শ্রদ্ধ হয়ে মাহফিল থেকে চলে এলাম। আমি মিশরের গলিপথে ঘুরে ফিরছিলাম। হঠাৎ দেখতে পেলাম, এক মহিলা নিজের দুভার্গ্যের কথা বলে  বলে বিলাপ করে ফিরছে, মহিলার এ অবস্থা দেখে তাঁর প্রতি আমার করুনা হল। আমি নিকটে গিয়ে তাকে বললাম, হে রমনী তোমার কি হয়েছে? আমার নিকট খুলে বল।

সে আমার দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর বলল, আমি    একজন পর্দাশীল মহিলা। আল্লাহ পাক আমাকে একটি মাত্র  কন্যা সন্তান দান করেছেন। আমি বহু কষ্টে তাকে পর্দার ভেতরে রেখে লালন করেছি। পরে বড় হওয়ার পর একজন  পরহেজগার যুবকের সাথে তাঁর বিয়ে সম্পন্ন করেছি। আজ  তাঁর রুহছতীর দিন। কিন্তু আমার এমনই দুর্ভাগ্য যে, আজই তাকে জ্বীনে ধরেছে। এ কঠিন দিনে কে আমাকে সাহায্য  করবে, সে ভাবনায় আমি চারদিকে অন্ধকার দেখছি। মহিলার দুঃখের করুন কাহিনী শুনে আমারও বেদনার উদ্রেক হল। আমি তাকে সান্তনা দিয়ে বললাম, হে পূন্যবতী রমণী! তুমি আর কোন চিন্তা  করোনা।

আমি তোমার মেয়ের চিকিৎসার দায়িত্ব গ্রহণ করলাম। ইনশাল্লাহ আমি তোমার মেয়ের চিকিৎসা করব। আমার কথা শুনে মহিলার পেরেশানী দূর হয়ে গেল। তাঁর পর সে আগে আগে চলল এবং আমি তাঁর  পেছনে পেছনে চললাম। কিছুক্ষণের মধেই সে আমাকে একটি সূরম্য প্রাসাদে নিয়ে গেল। প্রাসাদের ভেতর প্রবেশ করে দেখতে পেলাম, সেখানে নতুন বিয়ের যাবতীয় উপায়  উপকরণ প্রস্তুত করা হলেও বাড়ীর সবার চোখেমুখেই একটা বিষাদের ছায়া সুস্পষ্ট ফুটে উঠেছে।

মহিলা আমাকে এক স্থানে বসিয়ে অভ্যন্তরে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর সে ভেতর থেকে একটি অনিন্দ্য সুন্দরী যুবতী মেয়েকে নিয়ে আসল। মেয়েটি কিছুটা অপ্রকৃস্থিতভাবে একবার ডানে একবার বামে তাকাচ্ছিল। সে নিকটে এলে  আমি পবিত্র কোরআনের দশটি আয়াত সাতবার পাঠ করে তাঁর উপর দম করলাম। অতঃপর তাঁর উপর আক্রমণকারী জ্বীনটি স্পষ্ট ভাষায় আমার সাথে কথা বলতে লাগল। যা উপস্থিত সবাই শুনতে পেয়েছে।

জ্বীনটি বলল, হে শায়েখ আবূ বকর তুমি সাত বার কোরআনের আয়াত তেলাওয়াত করার  গর্ব করোনা। আমরা এমন সত্তরজন জ্বীন যারা হযরত আলীর হাতে ইসলাম গ্রহণ করেছি। আজ আমরা শায়েখ ছালেহ আবুল ফজল ইবনে জত্তরীর পেছনে জুমআর নামায আদায় করতে এসেছিলাম- যেই শায়েখের ব্যাপারে ইতোমধ্যেই তুমি মনে মনে অশ্রদ্ধা পোষণ করতে শুরু করেছ। এ বিষয়ে আমার পরামর্শ হল, তুমি আল্লাহ পাকের নিকট তওবা করে তোমার মত পরিবর্তন করে নাও।

যাই হোক, যখন আমরা নামায আদায়ের উদ্দেশ্যে এ পথে যাচ্ছিলাম তখন এ মেয়েটি আমার উপর নাপাকী নিক্ষেপ করে। আমাদের দলের মধ্যে শুধু আমার গায়ে ঐ নাপাকী নিক্ষিপ্ত হয়ে কাপড় নাপাক হয়ে যায়। ফলে আজ আমি হযরত শায়েখ ছালেহ আবুল ফজল ইবনে জওহরীর পেছনে নামায আদায় করা হতে বঞ্চিত হলাম। এ কারণেই আমি ক্ষিপ্ত হয়ে এ মেয়েটির উপর আছর করেছি। বুজুর্গ বলেন, আমি জ্বীনকে লক্ষ্য করে বললাম, হে আল্লাহর বান্দা।

আজ তুমি যে শায়েখের পিছনে নামায পড়তে এসেছিলে  সেই শায়েখের ইজ্জতের দোহাই দিয়ে তোমাকে বলছি, তুমি তাঁর উপর হতে সরে যাও। আমার অনুরোধে সে মেয়েটিকে ত্যাগ করে চলে গেল। সাথে সাথে সে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এল এবং আমাকে সামনে দেখে লজ্জায় মুখের পর্দা টেনে দিল।

এতক্ষণ তাঁর উপর দিয়ে কি অবস্থা গুজরাচ্ছে সে কিছুই বলতে পারল না। মহিলা তাঁর মেয়েকে সুস্থবস্থায় ফিরে পেয়ে যায় পরনাই খুশী হয়ে আমার জন্য এরূপ দোয়া করলেন, আল্লাহ পাক তোমাকে এর উত্তম বিনিময় দান করুক। তুমি যেমন আমার মেয়ের একটি ক্রুটি গোপন করেছ তদ্রুপ আল্লাহ পাক ও তোমার দোষ গোপন রাখুন।

মেয়েটি ভাল হয়ে যাওয়ার পর আমি ঐ মহল ত্যাগ করে হযরত শায়েখের সাথে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। শায়েখ আমাকে দূর থেকে দেখে মৃদু হেসে বললেন, আহলান! সাহলান! হে আবু বকর! তোমার আগমন শুভ হোক। জ্বীনের মুখে শোনার পূর্বে তুমি আমাকে বুজুর্গ বলে স্বীকারই করলে না। শায়েখের মুখে এ কথা শুনার সাথে সাথে আমি অজ্ঞান হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লাম।

পরে আমি দীর্ঘ দিন যাবৎ শায়েখের খেদমতে থেকে তাঁর ওয়াজ নসীহত শুনতে লাগলাম। শায়েখ খানকার একটি নিভৃত কক্ষে আমার জন্য এবাদত করার ব্যবস্থা করে দিলেন। আমি সেখানে থেকে এবাদত বন্দেগী ও তওবা এস্তেফার করতে লাগলাম। অতঃপর আমি যতদিন জীবিত ছিলাম আর কখনো আউলিয়াদের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হইনি এবং কখনো তাদের কোন কেরামতি অস্বীকার করিনি।

You may also like...

দুঃখিত, কপি করবেন না।