গোলামের উছিলায়
আব্দুল ওয়াহেদ বিন জায়েদ (রহঃ) বর্ণনা করেন, একবার আমি নিজের খেদমতে একটি গোলাম ক্রয় করলাম। কিন্তু রাতে কাজের সময় তাকে খুজে পাওয়া গেল না। অথচ ঘরের সব দরজা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল। সকাল বেলা কোথা হতে সে গোলাম এসে আমার হাতে একটি দেরহাম দিল। এতে সূরা এখলাসের নকশা অঙ্কতি ছিল। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি এ দেরহাম কোথায় পেলে? কিন্তু সে সরাসরি আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলল, যদি রাতের বেলা আমাকে খেদমতের জন্য আহবান না করেন, তবে আমি প্রতিদিন আপনাকে একটি করে এরূপ দেরহাম দেব। আমি সাথে সাথে গোলামের প্রস্তাব মঞ্জুর করলাম।
অতঃপর বরাবর সে রাতেরবেলা কোথায় চলে যেত এবং সকাল বেলা রীতিমত আমার নিকট দেরহাম আসতে লাগল। দীর্ঘদিন পর্যন্ত নির্বিঘ্নে এ ব্যবস্থা চলছিল। পরে হঠাৎ একদিন আমার এক প্রতিবেশী এসে আমাকে বলল, তোমার ঐ গোলামটি বিক্রি করে ফেল। কারণ সে একজন পাকা কাফন চোর। প্রতিবেশীর বক্তব্য শুনে আমি অবাক হয়ে গেলাম। কিছুক্ষণ যাবৎ আমার মুখে কোন কথাই ফুটল না। পরে এই বলে বিদায় করলাম যে, আজ রাতে আমি বিষয়টি তদন্ত করব।
প্রতিদিনের মত এশার নামাযের পর কাজকর্ম শেষ করে যখন তার চলে যাওয়ার সময় হল, তখন আমি আড়ালে তার গতিবিধি লক্ষ্য করতে লাগলাম। প্রথমে সে ভেতর থেকে বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে হাতের ইশারা করতেই উহা খুলে গেল। অতঃপর বের হয়ে পূনরায় ইশারা করার সাথে সাথে ভেতর হতে দরজা বন্ধ হয়ে গেল। প্রধান ফটক পর্যন্ত পরপর তিনটি দরজা সে এভাবেই অতিক্রম করল। অতঃপর সে হাঁটতে আরম্ভ করলে আমিও তাকে পায়ে পায়ে অনুসরণ করলাম। কিছুক্ষণ পরে দেখা গেল আমরা একটি পাথরময় ভূমিতে এসে উপস্থিত হয়েছি।
গোলাম এখানে একটি চট গায়ে জড়িয়ে পরনের সমস্ত কাপড় খুলে ফেলল। অতঃপর সে নামায পড়তে আরম্ভ করল। সকাল পর্যন্ত এভাবে নামায আদায়ের পর আকাশের দিকে হাত তুলে আল্লাহ পাকের দরবারে আরজ করল, হে আমার মালিক! আমার ছোট মালিকের মুজুরী দিয়ে দাও। সাথে সাথে আকাশ থেকে একটি দেরহাম নীচে পড়ল। গোলাম তা কুড়িয়ে নিয়ে পকেটে রাখল। এই বিস্ময়কর ঘটনা দেখার পর আমার মনে যে কি অবস্থা সৃষ্টি হল তা প্রকাশ করার মত নয়।
সাথে সাথে আমি অযূ করে দু’রাকাত নামায পড়লাম এবং গোলাম সম্পর্কে সৃষ্ট আমার মনের সকল সংশয় ও সন্দেহের জন্য আল্লাহ পাকের দরবারে ক্ষমা প্রার্থনা করে তাকে আজাদ করে দেওয়ার সিধান্ত নিলাম। কিন্তু এর পরেই যুবক আমার দৃষ্টি হতে অদৃশ্য হয়ে গেল। চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম পথ ঘাট কিছুই আমার চেনা নেই। এবার আমি মহা ভাবনায় পড়লাম। আশে পাশে লোকজন নেই। কার নিকট পথের সন্ধান করব। কি উপায়ে বাড়ি ফিরব? আমি মনে মনে এসব কথা আলোচন করছিলাম। এমন সময় দেখতে পেলাম এক ব্যক্তি ঘোড়া ছুটিয়ে এদিকে আসছে।
নিকটে এসে সে নিজেই আমাকে জিজ্ঞেস করল, হে আব্দুল ওয়াহেদ! তুমি এখানে কি করে আসলে? উত্তরে আমি গতরাতের বিস্তারিত বিবরণ দিলাম। সে পূনরায় জিজ্ঞেস করল, তুমি কি বলতে পার এখান থেকে তোমার বাড়ি কত দূর। আমি বললাম, এ ব্যাপারে আমার কোন ধারণা নেই। সে বলল, একটি দ্রুতগামী ঘোড়া ছুটিয়ে গেলেও তোমার বাড়ি পৌছাতে দু বছর সময় লাগবে।
আগন্তুকের বক্তব্য শুনে আমার মনে কঠিন দুর্ভাবনা দেখা দিল। অতঃপর সে আমাকে বলল, তুমি এখানেই অপেক্ষা করতে থাক। রাতেরবেলা তোমার গোলাম আবার এখানেই আসবে। এই বলে সে ঘোড়া ছুটিয়ে স্থান ত্যাগ করল। আর আমি গোলামের অপেক্ষায় সেখানেই ঠায় বসে রইলাম। বাদ এশা যথাসময়ে গোলাম ফিরে এল। আজ তাঁর হাতে একটি রেকাবীতে ছিল বিবিধ উপাদেয় খাবার। তা আমার সামনে রেখে সে বলল, মনিব! আপনি ক্ষুধায় কষ্ঠ পাচ্ছেন, আগে আহার করুন। পরে বলল, ভবিষ্যতে আর কখনো এরুপ করবেন না।
আব্দুল ওয়াহেদ বলেন, আমি খানা খেতে লাগলাম, আর গোলাম নামাযে দাঁড়িয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর সে আমার হাত ধরে কয়েক কদম হাটার পরই দেখতে পেলাম, আমি আমার বাড়ির ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। এবার সে বলল, মনিব আপনি তো আমাকে আজাত করে দেওয়ার নিয়ত করেছেন। আমি বললাম, হ্যাঁ আমার সে নিয়তের কোন পরিবর্তন ঘটেনি।
সে বলল, আপনি আমার মূল্য গ্রহণ করেই আমাকে মুক্ত দিন। এ বলে সে জমিন থেকে একটি মাটির চাকা কুড়িয়ে আমার হাতে দিল। আমি তা হাতে নেওয়ার সাথে সাথে তা স্বর্ণে পরিণীত হল এবং গোলামও আমার সম্মুখ হতে অদৃশ্য হয়ে গেল। পরদিন আমার সেই প্রতিবেশী এসে জিজ্ঞেস করল। তোমার সেই কাফন চোর গোলামটির খবর কি? আমি সাথে সাথে বললাম, খবরদার! তাঁর সম্পর্কে আর কখনো এরূপ মন্তব্য করবে না। সে কাফন চোর নয়। অতঃপর আমি তাঁর বিস্তারিত ঘটনা শোনালে সেও অনুতপ্ত হয়ে তওবা করল।