হযরত ইউসুফ (আঃ)-এর বন্দী জীবন-৩য় পর্ব

হযরত ইউসুফ (আঃ)-এর বন্দী জীবন-২য় পর্ব দেখতে এখানে ক্লিক করুন

তোমরাও এ ধর্মের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করে ধন্য হও। তোমরা বর্তমানে যে দেব দেবীর পূজা অর্চনা কর উহা ধর্ম নয়, কুসংস্কার। নিজ হাতে প্রতিমা তৈরি করে তাঁর পূজা করা বোকামি বৈ কিছুই নয়। তোমাদের সে প্রতিমা কথা বলতে পারে, না কার কোন মঙ্গল সাধন করতে পারে। অতএব তোমরা ধর্মের নামে কুসংস্কার পরিত্যাগ করে আল্লাহ্‌র একত্ববাদে বিশ্বাস স্থাপন কর এবং মুসলমান হয়ে যাও। তবে তোমরা দুনিয়া ও আখেরাতের উভয় ক্ষেত্রে মুক্তিপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত থাকবে। অন্যথায় তোমরা ইহকাল ও পরকালে অশেষ শাস্তি ভোগ করবে।

চাকরদ্বয় হযরত ইউসুফ (আঃ)-এর উপদেশ বাণী শুনে বলল, আমরা ইসলাম গ্রহণ করলাম। এখন আমাদিগকে ইসলামের আদেশ নিষেধ শিখিয়ে দিন এবং আমাদের স্বপ্নের তাবির বলে দিন। হযরত ইউসুফ (আঃ)- তখন বললেন, তোমাদের মধ্যে রাজার শরাব পরিবেশনকারী আঙ্গুর নিংড়িয়ে পেয়ালা ভর্তি করার যে স্বপ্ন দেখেছ, তাঁর তাবীর হল-তুমি পুনরায় তোমার চাকরিতে বহাল হবে এবং অধিক মর্যাদা লাভ করবে। আর যে বাক্তি মাথায় রুটির ঝুড়ি এবং পাখিকে সে রুটিগুলো ভক্ষণ করতে দেখেছ সে মামলায় দোষী সাব্যস্ত হবে। তাঁকে শুলে দেয়া হবে। তাঁর মাথার মগজ পাখিরা ঠোকরে খেতে থাকবে।

স্বপ্নের তাবীর শুনে শরাব পরিবেশনকারী আনন্দ প্রকাশ করল এবং আল্লাহর দরবারে কৃতজ্ঞতা পেশ করল। দ্বিতীয় রুটির ঝুড়ি বহনকারী ব্যাক্তি বিমর্ষ বদনে কাঁদতে আরম্ভ করল। এভাবে কিছু সময় অতিবাহিত হওয়ার পরে রাজদরবার থেকে চাকর দুজনকে রাজ দরবারে নিয়ে যাওয়ার আদেশ এলো। জেল কর্তৃপক্ষ রাজ আদেশ অনুসারে চাকর দ্বয়কে দূতের হস্তে সামার্পণ করল। দূত উভয়কে নিয়ে রাজ দরবারে হাজির হল। রাজদরবারের বিচার বিভাগ থেকে উভয়কে মামলার রায় পড়ে শোনান হল। যাতে লেখা ছিল শরাব পরিবেশনকারী বে-কসুর খালাস ও চাকরিতে পুনর্বহাল থাকবে। বাবুর্চি রাজাকে বিষপান করানোর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল বিধায় তাঁকে শূলে মৃত্যুদণ্ড দিবার আদেশ দেওয়া গেল। বিচার বিভাগের এ রায় দিনের মধ্যেই কার্যকরী করা হল।

হযরত ইউসুফ (আঃ)-কে একাধারে সাত বছর বন্দীজীবন কাটাতে হয়। এর মধ্যে দেশের অনেক উত্থান পতন হয়েছে। জাতির অনেক উন্নতি অবনতি  ঘটেছে। কিন্তু হযরত ইউসুফ (আঃ)-এর পিতা হযরত ইয়াকুব (আঃ) এ দীর্ঘ সময়ের মধ্যে হারান সন্তান হযরত ইউসুফ (আঃ) এর কোন খোজ-খবর পাননি । তাই তিনি শোক ঘরে বসে এবাদাত বন্দেগীতে মশগুল থাকতেন এবং হযরত ইউসুফ (আঃ) এর কথা মনে উঠলে কিছু সময় কেঁদে নিতেন। এ সুদীর্ঘ পনের বছর যাবত কাঁদতে কাঁদতে তাঁর চোখ দুটি সম্পূর্ণ অন্ধ হয়ে যায়। হযরত ইউসুফ (আঃ)- এর সৎ ভাইয়েরা প্রথম দিকে পিতার নিকট অতিপ্রিয় হবার লক্ষ্যে ঘন ঘন তাঁর নিকট যাতায়াত করত এবং সর্বদা খোঁজ খবর নিত। কিন্তু পিতা যখন হযরত ইউসুফ (আঃ)-এর কথা আদৌ ভুলতে পারলেন না তখন তারা কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে চলত। তারা শারীরিক পরিশ্রম দিয়ে চাষাবাদের কাজ করে জীবন-যাপন করত এবং পশু চারণ ছিল তাঁদের একটি অন্যতম ব্যবসা। যা তখনকার দিনে বেশ লাভজনক ব্যবসা বলে ধরা হত। এভাবে কালের চক্র ঘুরতে থাকে।

হযরত ইউসুফ (আঃ)-কে জেলখানায় প্রেরণের পরে আজিজ মেছেরের কড়া নির্দেশের ফলে তাঁর সাথে জোলেখা আর সাক্ষাত করতে পারেন নি। তিনি হযরত ইউসুফ (আঃ)-স্মৃতি হৃদয়ের মাঝে দৃঢ়ভাবে এঁকে সর্বদা তাঁর নামের জপ করে কাটাতেন। আজিজ মেছের জোলেখার এ মোহ দূরীকরণার্থে বহু তদবীর ফিকির করেছেন, বহু চেষ্টা চালিয়েছেন। কিন্তু সব কিছু ও অকার্যকর হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। জোলেখা মুহুর্তের জন্য কোন দিন হযরত ইউসুফ (আঃ)-কে ভুলতে পারেন নি। জোলেখা জানতেন রাজমহলের রমণীগণ জেলখানায় খাদ্য সরবরাহের নাম করে হযরত ইউসুফ (আঃ)-কে প্রতিদিন একবার দর্শন করে মনের জ্বালা জুড়াচ্ছে। কিন্তু জোলেখার ভাগ্যে এমন সুযোগ আর কোন দিন এল না। তাই তিনি নিজেকে কপালপোড়া, ভাগ্যহতা মনে করতে লাগলেন। আর এজন্য তাঁর মধ্যকার অনল প্রদাহ দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেল। রাগে ক্ষোভে তাঁর জলন্ত রূপের শোভা দিন দিন ঝলসে যেতে লাগল। তাঁর চলা, বলার মাঝে বিভ্রান্তি ও বিস্মৃতি দেখা দিল। এভাবে তাঁর রাত যায় দিন আসে, দিন যায় রাত আসে। দিন রাতের এ ঘূর্ণায়মানের চিরচারিত নিয়মের মাঝ দিয়ে বয়ে যাচ্ছিল মাসের পর মাস, বছরের পর বছর অতি ধীর গতিতে। এ গতির সচলবেগ ক্ষণিকের জন্য রোধ করা আর সম্ভব হল না জোলেখার পক্ষে।

সূত্রঃ কুরআনের শ্রেষ্ঠ কাহিনী

হযরত ইউসুফ (আঃ)-এর বন্দী জীবন-১ম পর্ব দেখতে এখানে ক্লিক করুন

You may also like...

দুঃখিত, কপি করবেন না।