বেলা শেষের গান-২

এবার একটু পিছন ফিরে দেখি কে এই হাসান সাহেব, কি তার পরিচয়। হাসান সাহেবের বাবা এক জন ছোট খাট স্বর্ণের ব্যবসায়ী ছিলেন। স্বর্ণের ব্যবসায়ী বলতে যা বোঝায় আসলে ঠিক তা না। কর্মকারেরা যেখানে নানা গহনা তৈরি করে সেখানে দিনের শেষে ঘর ঝাড়ু দিয়ে আবর্জনার স্তূপ জমা করে রাখে এতে দিনের স্বর্ণ কাটা ছেড়া, ঘসা মাজা করতে বা হাতে নারা চারা করতে স্বর্ণের যে অণু পরমাণু বা ছোট সামান্য ক্ষুদ্র কণা যা ছিটে পরে সে গুলি জমে থাকে। ওই গদি ঝারা আবর্জনা কিনে সেগুলি থেকে নানা প্রক্রিয়া করে তা থেকে স্বর্ণ আলাদা করে নিয়ে কুমিল্লার নিজের একটা দোকানে কিছু সামান্য অলঙ্কার বানাতেন এ ছারা কিছু জমি জমা ছিল ওতেই মোটামুটি সচ্ছল ভাবেই চলে যেত।
ঢাকার অদূরে ধামরাই থানার কাছেই এক বর্ধিষ্ণু গ্রামের পাঠশালা শেষ করে একটা বৃত্তি পেয়ে মানিকগঞ্জে এসেছিলেন হাই স্কুলে পড়ার জন্য। এখানেও ভাল ফল পেয়ে ভর্তি হলেন মানিকগঞ্জের দেবেন্দ্র কলেজে। বাড়ি থেকে বাইরে এসে ছোট এই মফস্বল শহরে পড়া লেখার ফাকে ফাকে এতো দিনে তিনি বেশ স্বপ্ন দেখতে শিখে ফেলেছেন অনেক উঁচু স্বপ্ন। চলনে বলনে আচরণে ছিলেন অসম্ভব মার্জিত। প্রায় ছয় ফুট উচ্চতা, গায়ের রঙ উজ্জ্বল শ্যামলা, মাথায় সামান্য কুঞ্চিত চুল, গলার কণ্ঠ এবং কথা বলার ভাব ভঙ্গি ছিল । যে কেউ তার সাথে এক মুহূর্ত আলাপ করলে তাকে পছন্দের তালিকার শীর্ষে বসিয়ে দেয়ার মত। শিক্ষার পাশা পাশী কিছু কিছু সামাজিক নানাবিধ কর্মকাণ্ডের সাথে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছিলেন। এমন কি স্কুল কলেজ ছুটির সময় যখন গ্রামে যেতেন তখন থেকেই নিজ গ্রামে গড়ে তুলেন একটা তরুণ সঙ্ঘ যেখানে গ্রামীণ নানাবিধ উন্নয়ন এবং গ্রামের অন্যান্য ছেলে মেয়েদেরকে তার মত করে উন্মুক্ত ভাবনা ভাবতে এবং স্বপ্ন দেখতে শেখাবার একটা পথ বের করেছেন। ছোট শহর, বড় শহরে কোথায় কোন কলেজ, কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে কি পড়ান হয়, কি নিয়ে পড়াশুনা করলে ভাগ্য তাকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে, নিজের ভাগ্য কি ভাবে নিজে গড়ে নিতে হয় এই সব ধ্যান ধারনা সবার মাঝে বিলিয়ে দিয়ে একটা আত্ম তৃপ্তি পেতেন।

সবচেয়ে বড় কথা গ্রামের উঠতি বয়সের ছেলেদের স্বপ্ন দেখতে শেখাতেন। ইচ্ছে করলেই কি আর স্বপ্ন দেখা যায়? স্বপ্ন দেখতে হলে যে সাধের সীমানাটা ছড়িয়ে দিতে হয় অনেক দূরে আকাশের ওই দূর প্রান্তে যেখানে দৃষ্টিসীমা পৌছাতে পারে না সেখানে। কে কতদূর যাবে সে কথা তার স্বপ্ন দেখার আকাঙ্ক্ষা দেখেই কিছুটা অনুমান করা যায়।
হাসান সাহেব স্থানীয় সুয়াপুর হাইস্কুলেই তার উচ্চ মাধ্যমিক শুরু করলেও বোর্ডে নাম রেজিস্ট্রি করার আগে তার সুদূরের স্বপ্ন সফলের আশায় অজ গ্রামের পরিবেশ ছাড়িয়ে তখনকার মহকুমা সদর মানিকগঞ্জে মডেল হাইস্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন। তার মেধা, মিষ্টি স্বভাব আর পড়াশুনার প্রতি একাগ্রতা সবার দৃষ্টিতে এলেও সবচেয়ে যিনি কাছে টেনে নিলেন তিনি এই স্কুলেরই হেড স্যার মীর আক্কাস আলি। আক্কাস সাহেব অনেকদিন ধরেই এই স্কুলের হেড মাস্টারের দায়িত্ব পালন করছেন এবং প্রতি বছরেই তার বেশ কয়েকজন ছাত্র বৃত্তিও পায় আবার যারা স্কুল ফাইনাল দেয় তাদের শতকরা ৯০ জনই ফার্স্ট ডিভিশন পেয়ে জেলা সদর ঢাকা শহরের নামি দামি কলেজ পেরিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পায়। এক এক করে প্রায় প্রতিটি ছাত্র ছাত্রীর উপরেই তার সজাগ দৃষ্টি। কে কি করছে, কোথা থেকে এসেছে, কার বাবা কি করে সবই তার মুখস্থ হাজার হাজার ছাত্র ছাত্রী কেউই তার চোখের আড়াল হতে পারে না। তার একটাই স্বপ্ন, মানিকগঞ্জের ছোট্ট মহকুমা সদরের স্কুলটাকে ঢাকা, না না শুধু ঢাকা নয় সারা বাংলার সেরা স্কুল হিসেবে দাড় করানো। মেধাবী ছাত্র ছাত্রীদের নিয়ে স্কুল ছুটির পর নিজেই আলাদা করে ক্লাস নিয়ে যার যেখানে দুর্বলতা সেগুলি পূরণ করে দেয়া তার ব্রত। বাড়িতে ফিরে গিয়েও ক্লান্তি নেই। নিজের দুই মেয়েকে নিয়ে বসে। দীপা আর নিপা দুই বোন, আক্কাস সাহেবের দুই মেয়ে। মাত্র এক বছরের ছোট বড় হলেও পড়ে একই ক্লাসে আর দুইজনেই ক্লাস ফাইভ থেকে বৃত্তি পেয়েছে সামনে এইট থেকেও পাবে এমনই তাদের দুই বোনের মেধা। হবে নাই বা কেন? যারা এমন চৌকস বাবার মেয়ে আর শুধু বাবার কথাই-বা বলছি কেন মাও কি কম? সেও একই স্কুলের শিক্ষিকা, খাদিজা বেগম।

হাসান সাহেব সুয়াপুর স্কুল থেকে এখানে আসার আগে বৃত্তি পরীক্ষা দিয়ে এসেছিলেন। বৃত্তি পাবে জেনে ওই স্কুলের শিক্ষকেরা কেওই তাকে সার্টিফিকেট দিতে সম্মত ছিল না কিন্তু ছেলের জেদের কাছে তারা তাদের মতে স্থির থাকতে পারেনি। সিঁড়ি বেয়ে তরতর করে উপরে ওঠার স্বপ্নে বিভোর ছেলে নাওয়া খাওয়া ছেড়ে এমন জেদ ধরল যে শেষ পর্যন্ত তাদের বাধ্য হয়েই বিদায় দিতে হলো। সার্টিফিকেটটা হাতে দেবার সময় হেড স্যার মাখন বাবু বলেছিলেন দেখ বাবা আমরা তোমাকে ছাড়তে চাইনা কিন্তু শুধু তোমার জন্যেই টিসি দিতে বাধ্য হলাম তবে যেখানেই যাওনা কেন ঈশ্বর যেন তোমার মঙ্গল করেন আর বাড়ি এলে আমাদের সাথে এসে দেখা করে যেও। আচ্ছা স্যার, আসব, আমার জন্য আশীর্বাদ করবেন। বলে বের হয়ে বাড়ি এসে নিজের কাপড়চোপড় গুছিয়ে রেখেছিল। মা বারবার করে বলছিল অত দূরে যেয়ে কি এমন লেখাপড়া করবি যে এখানে হবে না! এখানে কি কেও লেখা পড়া করে না? ওখানে যেয়ে থাকবি কোথায়, খাবি কি? কে তোর রান্না করে দিবে? অতশত তোমার বুঝে কাজ নেই মা, আমাকে খুশি মনে যেতে দাও আর আমার জন্য দোয়া কর। [চলবে]

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!