আল্লাহ্র পথে এক শাহজাদা
শায়েখ ছফিউদ্দীন আবূ মানসুর ছিলেন শায়েখ আবূ আব্বাসের শাগরিদ। তিনি বলেন, আমার উস্তাদের একটি সুন্দরী ও নেক কন্যা ছিল। হযরতের শিষ্য ও মুরীদের মধ্যে অনেকেই তার বিয়ের প্রার্থী ছিল। হযরত শায়েখ তাদের বাসনার কথা জানতে পেরে সবাইকে বললেন, তোমরা কেউ আমার কন্যাকে নিয়ে করার ইচ্ছা করো না। কারণ আমার এই মেয়ের জন্মের সাথে সাথেই তার স্বামী কে হবে এই বিষয়ে আল্লাহ্ পাক আমাকে জানিয়েছেন, এখন আমি সে ছেলের অপেক্ষা করছি।
শায়েখ ছফিউদ্দীন বলেন, আমার পিতা ছিলেন একটি উপসাগরীয় দেশের প্রশাসক। একবার আমার পিতাকে কেন্দ্রীয় সরকার মিশরে ডেকে পাঠালেন। অতঃপর আমার পিতাকে কেন্দ্রীয় সরকারের দূত হিসাবে ইয়ামানের প্রশাসনিক কাজে সহায়তার জন্য মক্কায় আব্দুল আজীজের নিকট পাঠানো হল। ঐ সময় আমি আমার পিতার সাথে ছিলাম। মক্কায় হাজির হতেই আমার সম্মুখে যখনই কোন বুজুর্গের আলোচনা করা হতো সাথে সাথে সেই বুজুর্গের ছবি আমার সামনে ভেসে উঠত। এদিকে আমার চেহারা ছুরত ছিল বেশ সুন্দর। আমি উত্তম ছওয়ারী এবং সোনালী জরির কাজ করা মূল্যবান পোষাক পরে হযরতের দরবারে এলাম। এখানে আসার পর আমার দৈহিক সৌন্দর্য আরো বৃদ্ধি পেল। পরে আমি বাড়ি ঘর ত্যাগ করে স্থায়ীভাবে শায়েখের দরবারে পড়ে রইলাম।
এভাবে অনেকদিন অতিবাহিত হওয়ার পর একবার আমার পিতা পূর্ণ রাজকীয় কায়দায় মক্কায় তাশরীফ আনলেন। তার সাথে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে মিশর হতে বহু গন্যমান্য ব্যক্তিবর্গ মক্কায় উপকন্ঠে এসে তাবু স্থাপন করল। একদিন শায়খ আমাকে বললেন, তুমিও তোমার পিতার সাথে সাক্ষাৎ করে আস। আমি বললাম, এখন আপনিই আমার (রুহানী) পিতা আমি আপনাকে ছেড়ে আর কোথাও যাব না। আমার জন্মদাতা পিতার রাজকীয় পরিবেশে ফিরে যাওয়ার আমার কোন ইচ্ছা নেই। শাহী পরিবারের আরাম আয়েশ ও ভোগ বিলাসে আমার আর কোন আকর্ষণ নেই, আর এখন আমি যে অবস্থায় আছি সেই অবস্থায় সেখানে গেলে আমাকে একান্তই বেমানান মনে হবে। হযরত শায়েখ বললেন, তুমি তোমার বর্তমান দৈন্য দশার দিকে না তাকিয়ে সে অবস্থায় আছ সে অবস্থায়ই পিতার সাথে দেখা কর।
অতঃপর হজরতের হুকুম অনুযায়ী আমি একটি ছেড়া জামা গায়ে জড়িয়ে একটি সাধারণ সওয়ারীতে বসে পিতার সাথে সাক্ষাৎ করতে চললাম। যথা সময়ে আমি তথায় পৌছার পর আমার পরিচিত জন ও আত্মীয়বর্গ আমার করুণ দশা দেখে কোনক্রমেই অশ্রু সংবরণ করতে পারল না। পরে আমি একাকী আব্বার সাথে সাক্ষাৎ করে তাঁকে সালাম করলাম। কিন্তু প্রথম দর্শনে তিনি আমাকে চিনতে পারলেন না। তখন আব্বার দরবারে উর্ধ্বতন সরকারী আমলা সামরিক কর্মকর্তা ও খাদেমরা উপস্থিত ছিলেন। পরে আমার পরিচয় পাওয়ার পর আমার পিতা অবাক বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। প্রথমে কিছুক্ষণ তার মুখে কোন কথাই ফুটল না।
যাই হোক পরে আমার অন্যান্য আত্মীয়-স্বজন ও গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ এসে আব্বার সাথে সাক্ষাৎ করতে লাগল। ক্রমে মানূষের ভীড় বাড়তে লাগল। ভীড়ের চাপে আমি কক্ষের এক কোনে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। সেখানে আমার নিজের নিকটই নিজেকে অবাঞ্চিত মনে হচ্ছিল। যথাসময়ে দরবার কক্ষে মেহমানদের জন্য খাবার আয়োজন হতে লাগল। দস্তরখান বিছানোর পর তাতে বিবিধ প্রকার উপাদেয় খাবার পরিবেশন করা হল। সকলে যখন খাবারে মনোনিবেশ করল তখন আমি একা সে কক্ষের এক কোণে দাঁড়িয়ে অজস্র ধারায় কান্না করছিলাম। তাদের অনুরোধের পরও সেই খাবারে কিছুতেই শরীক হতে পারলাম না।
আমি যদি আমার বর্তমান অবস্থান ত্যাগ করে রাজকীয় পরিবেশে ফিরে না আসি তবে আমাকে আটক করে কয়েদ খানায় প্রেরণ করা হবে। আমার পিতা আমাকে হুমকিও দিয়েছেন। অতঃপর আমি শায়খের দরবারে ফিরে এসে সবকিছু জানালাম। কিন্তু আমার বিস্তারিত অবস্থা শোনার পর শায়েখ আমাকে খানকাহ থেকে বের করে দিয়ে বললেন, এখন থেকে তুমি তোমার পিতার সাথেই থাকবে এবং আর কখনোই আমার এখানে আসবে না।
শায়েখ ছফিউদ্দীন (রঃ) বলেন, অতঃপর আমি শায়েখের আদেশ অনুযায়ী আব্বার নিকট ফিরে এলাম বটে, কিন্তু আমার শায়েখকে ছেড়ে এখানে এসে আমি একদণ্ড শান্তি পেলাম না। আহার নিদ্রা ত্যাগ করে দিনরাত শুধু কান্না করলাম। আর লাইলী মজনুর বয়াত পড়তাম
“আমি লাইলীর উপর দেয়ানা হলাম আর লাইলী অপর এক ব্যক্তির উপর দেয়ানী হয়ে গেল। এদিকে অপর এমন একজন আমার উপর দেয়ানী হয়ে গেল যাকে আমি আশা করি না”।
এভাবে কিছুদিন অতিবাহিত হওয়ার পর আমার ব্যাপারে শায়েখের মনোভাব সম্পর্কে আল্লাহ্ পাক আমাকে অবহিত করলেন যে, আসলে শায়েখ শুধু পরীক্ষা করেছেন আমাকে। শায়েখের প্রতি আমার টান কতটুকু এবং যখন যা হুকুম করেন তাই আমি মান্য করি কি না। এটাই তিনি দেখতে চেয়েছেন। শায়েখের এ উদ্দেশ্য সম্পর্কে অবহিত হওয়ার পর তার প্রতি আমার শ্রদ্ধা আরো বেড়ে গেল এবং সেই সাথে আমি পিতার ঘরের এক কোণে এসে জমে বসলাম। উপরন্তু এই সময় আমি মনে মনে এরূপ শপথ করলাম, যতক্ষন পর্যন্ত শায়েখের পক্ষ হতে কোন হুকুম না আসবে ততক্ষন আমি আহার নিদ্রা কিছুই গ্রহণ করব না এবং বাড়ি থেকে কোথাও বেরও হবো না।
এদিকে পরে আমার পিতা শায়েখ কর্তৃক তার দরবার হতে আমার বহিষ্কার এবং পরবর্তীতে আহার নিদ্রা ত্যাগ সংক্রান্ত আমার অঙ্গীকারের কথা জানতে পেরে মন্তব্য করলেন ক্ষুধা লাগলে নিজেই এসে খাদ্য গ্রহণ করবে। এ বিষয়ে চিন্তা করার কোন কারণ নেই। কিন্তু আমার অনশনের তৃতীয় দিন অতিবাহিত হওয়ার পর আমার পিতার টনক নড়ল। এবার তিনি বলে পাঠালেন, তাঁকে বল যেন শায়েখের নিকট চলে যায় এবং সেখানে যাওয়ার পর যা ইচ্ছা তাই করে। কিন্তু পিতার আদেশের উত্তরে আমি পরিস্কার বলে দিলাম যে, যতক্ষণ না আমার পিতা স্বয়ং আমাকে শায়েখের নিকট দিয়ে না আসবেন ততক্ষণ আমি কিছুতেই শায়েখের নিকট যাব না। এবং অনশনও ভঙ্গ করব না। এ প্রস্তাবের পেছনে আমার উদ্দেশ্য ছিল আমার শায়েখের মর্যাদা বৃদ্ধি করা।
অবশেষে বাধ্য হয়ে আমাকে নিয়ে তিনি পায়ে হেটে শায়েখের নিকট গমন করলেন। মসজিদে প্রবেশ করে তিনি তাজীমের সাথে হযরতের হস্ত চুম্বন পূর্বক আরজ করলেন, হযরত! আপনার এ ছেলেকে আপনার কাছে দিয়ে গেলাম, আপনি তাঁকে যেভাবে রাখতে চান সে সেভাবেই থাকবে। এ বিষয়ে আমার পক্ষ থেকেই কখনো কোন আপত্ত্বি উথাপিত হবে না। জবাবে শায়েখ বললেন, আমি আশা করি, আল্লাহ পাক এ সন্তানের উছিলায় আপনার মর্যাদা বৃদ্ধি করবেন। অতঃপর আমার পিতা আমাকে শায়েখের হাতে ন্যস্ত করে চলে গেলেন।
এবার আমি নতুন উদ্যমে শায়েখের দরবারে থেকে তার খেদমত করতে লাগলাম। শায়েখের খেদমত করতে আমার উৎসাহের কোন অন্ত ছিল না। আমি দৈনিক দুবার নদী হতে বড় বড় কলসী ভরে পানি নিয়ে শায়েখের বাড়ি আসতাম। লোকেরা আমার পিতাকে এ অবস্থায় সংবাদ দিলে তিনি বললেন, আমি তাঁকে আল্লাহর পথে ছেড়ে দিয়েছি এবং আমি আশা করছি যে, সে আল্লাহ পাকের নিকট এ মোজাহাদার উত্তম প্রতিদান প্রাপ্ত হবে। আমি অন্তর দিয়ে দোয়া করছি, যেন তার এ বিপুল ত্যাগ, এ সাধনা বিফলে না যায়, সে যেন এর উত্তম বিনিময় প্রাপ্ত হয়।
শায়েখ ছফিউদ্দীন (রঃ) বলেন, আমার পিতা ইন্তেকালের পর একদিন আমি স্বপ্নে দেখলাম, আবার শায়েখ আমাকে লক্ষ করে বলছেন, হে ছফিউদ্দীন! আমি আমার কন্যাকে তোমার নিকট বিয়ে দিয়েছি। ঘুম থেকে জাগ্রত হবার পর স্বপ্নের কথা ভেবে আমি পেরেশানী ও লজ্জায় অস্বস্তি বোধ করতে লাগলাম। অন্য দিকে যদি এ স্বপ্নটি শায়েখের নিকট প্রকাশ করা না হয়, তবে হয়তো শায়েখের সাথে খেয়ানত করা হবে। মনে মনে এ আশংকা দেখা দিল। আমার এই কঠিন দুর্ভাবনায় মুহুর্তে শায়েখ আমাকে ডেকে বললেন, আজ তুমি কি স্বপ্ন দেখেছ বল, লজ্জা করার কিছুই নেই। খুলে বল। অতঃপর আমি তার নিকট স্বপ্নের বিবরণ পেশ করলে তিনি বললেন, বেটা, তোমাদের জন্মের সাথে সাথেই এই বিয়ের সাব্যস্ত হয়েছে। সুতরাং এতে আর কোন সংশয়ের কারন নেই। একথা বলেই তিনি নিজের কন্যার সাথে আমার বিয়ে পড়িয়ে দিলেন।
শায়েখের কন্যা এত খোদাভক্ত ছিলেন যে, ইতোপূর্বে তা আমি কল্পনাও করতে পারি নি। তার চেহারা সর্বদা এমন একটি বেহেস্তী নূর জ্বল জ্বল করত যা দেখে প্রথম দর্শনেই আল্লাহ্র ওলী বলে চিনতে ভুল হতো না। তার নূরানী চেহারা দর্শনে মুহুর্তেই দর্শকের ভক্তি ও শ্রদ্ধা আকর্ষণ করত। শায়েখের সেই পূর্ণবতী কন্যার সাথে ঘরসংসার করে আমি যেন দুনিয়াতেই স্বগীয় সুখ অনুভব করতে লাগলাম। আমার এই স্ত্রীর গর্ভে যে কয়জন সন্তান হয়েছে তাদের সবাই আল্লাহওয়ালা বুজুর্গ হয়েছে। আমার শশুরের ইন্তেকালের পরও আমরা দীর্ঘদিন জীবিত ছিলাম। তিনি ইন্তেকালের এক বছর পূর্বেই নিজের ইন্তেকালের তারিখ সম্পর্কে আমাদেরকে অবগত করিয়েছিলেন। তার মৃত্যুর পূর্বে পরবর্তী কিছু ভবিষ্যতবাণী করেছিলেন যা তার ইন্তেকালের পর হুবহু সংঘটিত হয়েছিল। মৃত্যুর সময় তিনি বলেছিলেন-
হে (প্রশান্ত চিত্ত!) তুমি তোমার প্রতিপালকের দিকে চল, এভাবে যে, তুমি তার প্রতি সন্তুষ্ট এবং তিনি তোমার প্রতি সন্তুষ্ট। (সুরা ফাজরঃ ২৭-২৮)