হিংসা-বিদ্বেষ

বন্ধুরা, তোমরা নিশ্চয়ই হিংসা-বিদ্বেষ শব্দ দু’টির সঙ্গে পরিচিত এবং হিংসুটে লোকদের আচরণ সম্পর্কে কমবেশি জানো। মানুষের মধ্যে এমন কিছু রোগ আছে যেগুলো চিকিৎসার মাধ্যমে দূর করা সম্ভব হয় না, তেমনি হিংসা মানুষের অন্তরের এমন একটি দুরারোগ্য ব্যাধি, যা সামাজিক সম্প্রীতি বিনষ্ট করে, সমাজে নানা ফেতনা ফাসাদ সৃষ্টি করে।

হিংসা-বিদ্বেষের ফলে মানুষ কারো বিরুদ্ধে চক্রান্ত, ষড়যন্ত্র এমনকি সম্পর্কচ্ছেদ করতেও দ্বিধা করে না। এসব কারণে ইসলাম ধর্মে হিংসার ব্যাপারে সতর্ক করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সা. আ.) বলেছেন, ‘তোমরা পরস্পর হিংসা-বিদ্বেষ কর না, ষড়যন্ত্র কর না এবং সম্পর্ক ছিন্ন কর না। বরং তোমরা আল্লাহতায়ালার বান্দা হিসেবে পরস্পর ভাই ভাই হয়ে যাও।’

হিংসা-বিদ্বেষ মুনাফিকের চরিত্র। কোনো মুমিন অন্য মুমিনের প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ রাখতে পারে না। এটি মুনাফিকদের একটি বদ স্বভাব। কেবল মানুষের মধ্যেই নয়, পশুপাখির মধ্যেও এ বদ অভ্যাসটি দেখা যায়। আমরা এ সম্পর্কে একটি গল্প শোনাব।

কচ্ছপ তো তোমরা সবাই চেনো। খুবই নিরীহ একটা প্রাণী। কচ্ছপ স্থলে যেমন বাস করে, তেমনি পানিতেও বাস করে। কচ্ছপের এত পরিচিতির একটা প্রধান কারণ হলো এই প্রাণীটি ধীর গতিতে চলে। ধীর গতির উদাহরণ এলেই কচ্ছপের নামটিই সবার আগে উচ্চারিত হয়।

বিশাল এই পৃথিবীর কোনো এক কোণে বাস করত এরকমই একটি কচ্ছপ। তার বয়সও কম হয় নি। জীবনে অনেক ঠাণ্ডা গরম, তিক্ত আর মিষ্টি অনেক রকমের অভিজ্ঞতা তার জীবনের ইতিহাসে যুক্ত হয়েছে। বিচিত্র চড়াই-উৎরাইয়ের প্রত্যক্ষ জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার কারণে তাকে বানানো হয়েছে প্রাণীদের উপদেষ্টা।

যে প্রাণীরই কোনো সমস্যা দেখা দিত, সে-ই চলে আসত কচ্ছপের কাছে পরামর্শ নেয়ার জন্য। কচ্ছপের কাছে বসত, লম্বা সময় নিয়ে খোশগল্প করত, ফাঁকে নিজেদের সমস্যার কথা বলত। কচ্ছপও আন্তরিকতার সাথে সবার সমস্যার কথা শুনত এবং তার দৃষ্টিতে যেটা উপযুক্ত সমাধান বলে মনে করত- তা বলে দিত। সবাই ওই কচ্ছপকে খুবই জ্ঞানী বলে মনে করত।

তবে কাঁকড়াই শুধুমাত্র কচ্ছপের ওপর সন্তুষ্ট ছিল না। কাঁকড়া কচ্ছপের অভিজ্ঞতা আর দীর্ঘ জীবনের কোনো মূল্যায়নই করত না। সে বলত: ‘আমিও কচ্ছপের মতো। তার মতোই হাত পা নাড়াই। তার মতোই পানিতে বসবাস করি এবং স্থলেও বাস করি। তাছাড়া আমার তীক্ষ্ণধার দাঁত আছে কিন্তু কচ্ছপের নেই। আমি কচ্ছপের চেয়ে দ্রুত গতিতে চলতে পারি। তাহলে প্রাণীরা কেন তাকে এত বেশি সম্মান করে, কেন সবাই তার কাছে যায় নিজেদের সমস্যা সমাধানের জন্য? কেন তারা আমার কাছে সমস্যার সমাধানের জন্য আসা তো দূরে থাক, আমাকে সালাম পর্যন্ত দেয় না?’

কাঁকড়ার মনে খুবই হিংসা হতো এবং সে চাইত তার ধারাল দাঁত নখ দিয়ে কচ্ছপের ওপর হামলা চালিয়ে তাকে মেরে ফেলতে। কেবল চাইত বললে ভুল হবে, সে কয়েকবার হামলাও করেছিল। কিন্তু কচ্ছপের ছিল ভীষণ শক্ত খোলস। কাঁকড়ার দাঁত নখ কচ্ছপের ওই শক্ত খোলস ভেদ করা কোনোভাবেই সম্ভব ছিল না। এ কারণে কাঁকড়া আরও বেশি বিরক্ত ছিল।

যখনই তাদের দুজনের দেখা হতো, কাঁকড়া তখনই কচ্ছপকে এক গাল বাজে কথা শুনিয়ে দিত যাতে কচ্ছপ বিরক্ত হয়। কিন্তু কচ্ছপ কখনোই কাঁকড়ার কথায় প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে সোজা চলে যেত তার পথে।

একদিন হলো কী! একটা খরগোশ দৌড়ে দৌড়ে এসে হাজির হলো কচ্ছপের কাছে। হাঁপাতে হাঁপাতে খরগোশ বলল যে, বনে আগুন লেগেছে।

এক কান দু’কান হতে হতে সবার কাছেই আগুন লাগার খবর পৌঁছে গেল। সবাই এসে হাজির হলো কচ্ছপের কাছে। এই বিপদে এখন কী করণীয় তাদের সেটা জানার জন্যই একত্রিত হওয়া।

কচ্ছপ খানিক চুপ থেকে ভাবল। তারপর সমবেত প্রাণীদের উদ্দেশে বলল: ‘আমাদের সবার এখান থেকে চলে যাওয়া উচিত। বাতাসের বেগে আগুন এখানে চলে আসার আশঙ্কা আছে।’

সাথে সাথেই প্রাণীরা সেখান থেকে পালাতে শুরু করে দিল। কেউ দ্রুত দৌড়াল, কেউ উড়ে গেল ইত্যাদি যে যার মতো সরে যেতে লাগল। কচ্ছপ নিজেও তার মতো করে ধীরে ধীরে পথ ধরল।

একমাত্র প্রাণী যে কিনা কচ্ছপের কথায় কান দেয় নি, সে হলো কাঁকড়া। সে প্রাণীদের যাবার পথে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলতে লাগল: ‘তোমরা কী বোকা, মূর্খ, কচ্ছপের কথায় তোমরা তোমাদের বাসাবাড়ি ছেড়ে অজানার পথে পাড়ি দিচ্ছ। বাতাস কোথায় যে এখানে আগুন নিয়ে আসবে?’

কিন্তু কাঁকড়ার কথায় কেউ কান দিল না। কাঁকড়ার পাশ দিয়ে যে প্রাণীটা সবার শেষে গেল সে হলো কচ্ছপ।

কাঁকড়া তাকে দেখে উপহাসের হাসি দিয়ে বলল: “তুমি কোথায় যাচ্ছো হে বুড়ো কচ্ছপ?”

কচ্ছপ বলল: “আমি চীন ও মচীন যাচ্ছি…”

কাঁকড়া বুঝতে পারে নি যে কচ্ছপ তাকে বোকা বানাচ্ছে। সে জানতো চীন অনেক দূরে। কচ্ছপ যেরকম ধীরে ধীরে চলে তাতে আরও দশ বছরেও চীন যেতে পারবে না সে।

সেজন্য বলল: “এই গতিতে হেঁটে তুমি চাচ্ছ যেতে চীনা ভূমি?”

এই বলে আবারও সে হাসতে হাসতে বলল: “আহা রে! বেচারা প্রাণীগুলো দেখ কী রকম একটা বেআক্কেল প্রাণীর হাতে পড়ে নিজেদের বিবেককেও জলাঞ্জলি দিয়েছে!”

প্রাণীগুলো বহুদূর গিয়ে আরেকটা জায়গায় সমবেত হয়ে জীবন যাপন করতে লাগল। ভালোভাবেই কাটছিল তাদের। কিন্তু কাঁকড়ার যে কী পরিণতি হলো, সেই খবরটাও তাদের কাছে আর কোনোদিনই গেল না।

তার মানে তো বুঝতেই পারছ তোমরা। কচ্ছপের কথাই সত্যি হয়েছিল এবং আগুনে পুড়ে কাবাব হয়ে গিয়েছিল কাঁকড়া।

আর অপরাপর প্রাণীরা সুখে শান্তিতেই তাদের জীবন কাটাতে লাগল।

বন্ধুরা, কচ্ছপ ও কাঁকড়ার গল্পটি শুনলে, আশা করি ভালো লেগেছে।

সাতক্ষীরা থেকে পাঠিয়েছেন মহিবুল্লাহ।

কচ্ছপ কেন আস্তে হাঁটে

গরু-ভেড়ার অনুতাপ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *