প্যাচপেচে গরমে ঘামাচির মহোৎসব শরীরে। জ্যৈষ্ঠের রোদের ঝাঁজালো আগুনের পরশমণিতে হুল ফুটানো উৎসবে মেতে উঠছে প্রকৃতি। মেঘমুক্ত সুনীল আকাশ। শ্রান্তি হরণের জন্য বটচ্ছায়া আছে ঠিকই, কিন্তু প্যাচপেচে গরমের ক্লান্তি মুছে যাওয়ার জন্য একচিলতে ফুরফুরে বাতাসের বড্ড অভাব। সহসা বারি প্রস্রবণের চিহ্নটুকুও নেই। ঠিক এ সময়ে রক্তরোদ্রের বর্শাকে ফাঁকি দেয়ার জন্য আমি ও বাঁশমতি বেগম হন্যে হয়ে শ্যামল ছায়া খুঁজছি। যেখানে থাকবে অবারিত মাঠ, প্রকৃতির ঠোঁটে থাকবে সবুজের চুম্বন, ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় গ্রাম।
পত্রপল্লবে ঘেরা থাকবে আম্রকানন, পত্রপল্লবের ঘন সবুজের মোহময় আস্তরণে ঢাকা থাকবে ময়না, শালিক, কোকিলের কালো দেহ; ঠিক তেমনি পল্লবঘন শ্যামল ছায়ায় কোনো দীঘির টলটলে জলের হাম্মামখানায় জ্যৈষ্ঠের দুঃসহ গরমকে ‘দূর হ পাতক’ বলে কথা দিয়ে এক ঐতিহাসিক গোসলে মেতে শুদ্ধ করে নেব গা। জ্যৈষ্ঠের অগ্নিবর্শাকে দু’হাতে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে আমি ও বাঁশমতি বেগম শুক্রবার রাতে পৌঁছেছিলাম সাংবাদিক আল আমিন তুষারের সোনারগাঁও মঞ্জিলে। চতুর্দশ শতকের বাংলার প্রাচীন রাজধানী সোনারগাঁওয়ে যাবো, সেখানকার ঐতিহাসিক হাম্মামখানায় স্নান করব, দৃষ্টিভঙ্গি তো অতীতের দিকে ফেরাতেই হয়, হবে।
সোনারগাঁওয়ের আল আমিন তুষারের ফোন পেয়ে আমি ও বাঁশমতি বেগম দু’জনেই যারপরনাই উৎফুল্ল হলাম। দুঃসহ গরমের সাথে ঢাকার নাগরিক জীবনের সহবাসে হাঁসফাঁস করছিল বাঁশমতি বেগমের মন। আহ, এই কংক্রিটের জঙ্গলে দম ফেলার জন্য একটু ফাঁকা স্থান নেই, দুঃসহ গরমে শরীরে ঘামাচির যে মহোৎসব চলছে, সে দুঃসহ চুলকানির ঘামাচিকে ‘দুর হ পাতক’ বলে গলাধাক্কা দেয়ার জন্য কোনো পুকুর, দীঘি, জলাশয় নেই যেকোনো মুহূর্তে অবগাহনে গা ঘষে-মেজে দূরে ঠেলে দেবে, সে হাম্মামখানা নেই আর বুড়িগঙ্গার পানি তো রাব, আলকাতরা হয়ে আছে। বুড়িগঙ্গার পানির পলেস্তরার ওপর দিয়ে কুকুর-বিড়াল হেঁটে যাওয়ার অবস্থা। সোনারগাঁওয়ের ঐতিহাসিক ঝিলের হাম্মামখানায় গোসল করব। সে জন্য তো চাই রাজসিক পোশাক-পরিচ্ছদ। কিন্তু রাজসিক পোশাক পরার জন্য চিত্ত আছে ঠিকই, কিন্তু ছাপোষা সাংবাদিকের তো বিত্ত নেই। সে জন্য পোশাক খুঁজতে পুরনো স্যুটকেসের ঘরে বন্দী শাহী পাঞ্জাবি চাই। নিদেনপক্ষে রাজশাহী সিল্কের গরদের পাঞ্জাবি পিচ্ছিল কাপড়ের আঁটসাঁট পাজামা। পাঞ্জাবির জমিনে আঁকা থাকবে জরিসুতোর পরিপাটি কাজ, মাথায় তো আর ফেজ, আলোয়ান থাকবে না নিদেনপক্ষে থাকবে হাল আমলের মখমলের লাল টুপি। আমি ও বাঁশমতি বেগম সত্যিই ভাগ্যবান। ভাগ্যবান বলেই হয়তো বা পুরনো টিনের রঙচটা স্যুটকেস ক্যাচ শব্দে খুলতেই ভগবানের আশীর্বাদ রাজশাহীর রেশমের পাঞ্জাবি, মখমলি টুপি সবই পেয়ে গেলাম। বাঁশমতি বেগমও দেহকে আবৃত করল মসলিনের প্রপৌত্রী জামদানিকে দিয়ে।
ঘি-রঙা জামদানিতে লতাপাতার বাদলার কারুকাজে মনে হচ্ছিল, এ যেন ছাপোষা সাংবাদিক দোহা চৌধুরীর প্রিয়তমা নয়, সাক্ষাৎ শায়েস্তা বেগমের প্রিয়তমা কন্যা পরীবিবি। তো এ মুহূর্তে বাঁশমতি বেগমের শরীরে ঝিলিক দিচ্ছে জ্যৈষ্ঠ মাসের উড়াধুড়া পানিতে ভেসে আসা সোনালি, হলুদ মাছের রূপের মতো হেরেমবালার রাজকীয় রূপ। প্রাচীন রাজধানীর হাম্মামখানায় যাবো। কিছু একটা ভুস করা গন্ধ তো লাগবেই। আমাদের তো অরিজিনাল আতর, মাশকাত, জাফরান নেই; আশপাশে ঐতিহাসিক সুগন্ধবণিকও নেই; ইতিহাসের রাজা-বাদশাহদের ব্যবহার করা আতর মাশকাত জাফরান কোথায় পাবো? তবে আমার কাছে আছে মক্কা শরিফের আতর। সেটা গায়ে মাখতেই কোমল গন্ধ ছড়িয়ে গেল সবখানে। আমরা কিন্তু চারচক্রযানে সোনারগাঁওয়ের হাম্মামখানায় যাইনি। সন্ধ্যায় রওনা দিয়েছিলাম চারচক্রের অশ্বফটকে। ব্রিটিশ আমলের সাহেব সুবোদের ‘ফিটন’ গাড়ির মতো। প্যাচপেচে গরমে ঘামাচির সংসারকে গায়ে মেখে আমরা যখন সোনারগাঁও শহরের প্রাচীন স্থান পানাম নগরে পৌঁছলাম তখন ঘড়ির কাঁটা রাত ১টা ছুঁই ছুঁই। সোনারগাঁওয়ের পানামের বিদর্ভ নগরীতে তখন অনন্ত মধ্যাহ্নরাত। ভাগ্যিস আকাশে জোছনা ছিল। চাঁদের মিষ্টি আলো ঝরে পড়ছিল বিদর্ভ নগরী পানামে। কী সুন্দর মায়াময় দীঘল রাত। গোলাকার চাঁদ ছিল, চাঁদের হাসি ছিল। ছিল গভীর রাতে পত্রপল্লবের আধো ছায়ায় লুকিয়ে থাকা অপরূপ পাখি বসন্তভোরের মিষ্টি বিলাপ। কিন্তু কী আশ্চর্য, এই বিদর্ভ বিপর্যস্ত নগরীতে কেউ নেই, কিছু নেই।
শুধু কিছু দলছুট প্যাঁচা, খাটাস সোনারগাঁওয়ের অনন্ত মধ্যাহ্নরাতকে ভ্রুকুটি করে মার্বেল পাথরসম চোখে কটমট করে তাকিয়ে আছে। চার দিকে পিনপতন নিস্তব্ধতা। এমন হাজারো বছরের নীরবতা পানাম শহরকে ঘিরে আছে যেন একটি ক্ষুদ্র পিপীলিকা হেঁটে গেলেও তার শব্দ শোনা যাবে। এই অদ্ভুত নির্জনতা কার্তিকের মরা রোদের মতো বিষণ্ন ম্রিয়মাণ চাঁদের আলোকে সাক্ষী রেখে আমি ও বাঁশমতি বেগম ধীরলয়ে এগিয়ে গেলাম। এ রাজপথটি নাকি ছিল সম্রাট শেরশাহের সড়কে-ই আযম গ্র্যান্ডট্যাংক রোড। কিন্তু এ মুহূর্তে এখানে কোনো আশ্বারোহী ডাকহরকরা নেই। নেই বর্শার আগায় বাঁধা কোনো ঝুনঝুনি। নকিব নেই, প্রহরী নেই, নগর কোটাল নেই; কোথায় সেই হাম্মামখানা! সোনারগাঁওয়ের প্রাচীন পবিত্র সরোবর, যেখানে জলে নেমে শুদ্ধ করব গা। বিদর্ভ নগরীর দাদরাখাদরা শ্যাওলা জড়ানো প্রাচীন ইমারতরাজির পেছনের পানে তাকিয়ে আমি ও বাঁশমতি বেগম চিৎকার করে উঠলাম। ওই যে হাম্মামখানা। প্রাচীন ইমারতরাজির পেছনে রুপালি শুভ্র রজতধারার বর্ণিল ফোয়ারা আমাকে ও বাঁশমতি বেগমকে ডাকছে- আয় আয়… একবার জলে নেমে শুদ্ধ করে নে গা। শত বছরের নীরবতা ভেঙে শব্দটি গমগম করে উঠল, গমগম শব্দে আমি ও বাঁশমতি বেগম কিছুটা শঙ্কিত। কিন্তু পরমুহূর্তে প্রাচীন ইমারতরাজির ভেতর থেকে গলগল করে ধোঁয়া উদগিরণ হলো। সামনের দৃশ্যমান টলটলে জলের হাম্মামখানার নিস্তরঙ্গ জলে ঢেউ উঠল। আমরা আতিপাতি করে সোনারগাঁওয়ের সাংবাদিক আল আমিন তুষারকে খুঁজলাম, কিন্তু তাকে পেলাম না। তাকে না পেয়েছি, তাতে তো কোনো ক্ষতি নেই; দৃশ্যপটে হাম্মামখানা আছে।
গোসল করবো তার পর আবার কংক্রিটের জঙ্গলে মিশে যাবো। যেখানে পানি নেই। কী অদ্ভুত কাণ্ড, পানির দেশে পানির হাহাকার। রাত গভীর। আর বিলম্ব কিসের জন্য বাঁশমতি বেগম। আমরা দু’জনে রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত গানের দুটো চরণ সুরেলা কণ্ঠে গেয়ে উঠলাম- ‘আয় তব সহচরী, করি হাত ধরাধরি, নাচিব ধীরে ধীরে গাহিব গান।’ নামার প্রস্তুতি নিচ্ছি। ঠিক সে মুহূর্তে প্রাচীন ইমারতের গলগলে ধোঁয়ার কুণ্ডলি থেকে গাট্টাগোট্টা শরীরের পৌড় দীর্ঘ জটা চুলের, জীর্ণশীর্ণ পোশাকের, হাতে থাকা বল্লম নিয়ে দৌড়ে এসে বলল- ‘বস্তিঅলা জাগো, খবরদার, তোমরা কি অবস্থান করবে এই হাম্মামখানায়।’ খোলা চোখে আগন্তুকের দিকে তাকিয়ে আমরা দু’জনই জিজ্ঞেস করলাম- তুমি কে? এই বিদর্ভ নগরীতে তুমি বল্লম হাতে কী করছো, কী-ই বা তোমার পরিচয়। বল্লমধারী অমিতশক্তির জটাচুলের অধিকারী। খোলা চোখের পাগলটি গগনবিদারী অট্টহাসিতে পানাম নগরী কাঁপিয়ে বলল- : আমার পরিচয় জেনে তোমাদের কী লাভ? ভালোয় ভালোয় বিদায় হও। : কেন? : শোনো আমি এই নগরের নগরকোটাল। সবাই আমাকে পাগলা মোজম বলে ডাকে। এই যে ইমারত দেখছো… হু…। : হ্যাঁ, ইমারত তো দেখছি, তাতে হয়েছেটা কী? : শোনো… মন দিয়ে শোনো। এই ইমারত হলো সোনারগাঁওয়ের প্রাচীন টাকশাল। এখানে জমা থাকত হাজার হাজার সোনার মোহর… হা: হা: হা:। এই সোনার মোহরের আমি পাহারাদার। : কিন্তু মোজম আমরা তো টাকশালের সোনার মোহরের লোভে আসিনি। আমরা তো এসেছি জ্যৈষ্ঠের এই গরমে সোনারগাঁওয়ের পবিত্র হাম্মামখানায় অবগাহন করে শরীর জুড়িয়ে নিতে। : আরে, রাখো তোমার হাম্মামখানা। তোমাকে এমন শরাব খাওয়াব, তুমি বেমালুম ভুলে যাবে হাম্মামখানায় অবগাহনের স্বপ্ন। আমি ও বাঁশমতি বেগম এ মুহূর্তে কিংকর্তব্যবিমূঢ়। এ গভীর রাতে কী এক ভয়ঙ্কর পাগলের পাল্লায়ই না পড়লাম। মোজম আমাদের দু’জনকে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে চলল প্রাচীন জরাজীর্ণ শ্যাওলা ধরানো সাপসোপ-ঘেরা বিশাল টাঁকশাল ভবনের ধ্বংসস্তূপের কাছে। লোকটা নেশায় বুঁদ। শেষ মুহূর্তে আমরা যে কুঠুরিতে এসে পৌঁছলাম সেখানে নেশার পাহাড়, গাঁজা, চরস, ইয়াবা এমনকি আধুনিক নেশা ফেনসিডিল পর্যন্ত। এ কোথায় নিয়ে এলো পাগলা মোজম? : খাও খাও। যত ইচ্ছে টানো, পান করো, নেশায় বুঁদ হয়ে সাকির সন্ধান করো… কিন্তু…। : কিন্তু কী। : কিন্তু পানি পাবে না। : কেন, এই হাম্মামখানার পানি পাওয়ার অধিকার তো সবারই আছে। : পানি তোমাদের জন্য নিষিদ্ধ। এই সরোবর নিষিদ্ধ। : তবে এই সরোবর কাদের জন্য উন্মুক্ত। এই সরোবর ধনীদের জন্য উন্মুক্ত। এ পানি গরিব, নিম্নবিত্তের জন্য নয়। : তাহলে এই হাম্মামখানায় আমরা অবগাহন করতে পারব না। : না-না-না, তোমাদের কতবার বলব। তোমরা কি পেরেছিলে লালবাগ ও দিল্লির লাল কেল্লার হাম্মামখানায় গোসল করতে? ওই হাম্মামখানা ছিল রাজরাজরাদের, সম্রাজ্ঞী, শাহাজাদা, শাহাজাদীদের। রাজসিক হাম্মামখানা ছিল সর্বসাধারণের জন্য নিষিদ্ধ। : কিন্তু মোজম, এটা তো ছিল ইতিহাসের কাল।
এখনো কি রাজাদের প্রভুত্ব আছে। : আছে…। : বুঝতে পারিনি মোজম, তোমার কথা। : শোনো কমবক্ত। রাগ করলে না তো। কেউ আমার কথা না বুঝলে আমার মুখ দিয়ে খিস্তিখেউড় বের হয়। এক সময় আমাদের এ দেশটাই ছিল স্বর্ণগ্রাম। সোনারগাঁও। তিস্তা, পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, আড়িয়াল খাঁ, ডুমুর, কালাডুমুর, কর্ণফুলী, সুরমা, কুশিয়ারা কত নদী-সরোবর ছিল। সে সরোবরে অবগাহন করত হাজার বছরের বাংলা। মাটি, কৃষক, জনজীবন অবগাহন করে গড়ে তুলেছিল প্রাচুর্যশীল সমৃদ্ধ এক সভ্যতা। এই পললের মনন-মেধায় গড়ে উঠেছিল সমৃদ্ধশালী নগর-বন্দর। কিন্তু আজ ধনী লোকেরা আমাদের ভাতে মারছে না, মারছে পানিতে। সুতরাং সাবধান হয়ে যাও, সতর্ক হয়ে যাও, যেভাবে খালবিল, জলরাশি, দীঘি, পুকুর, নদীনালা, ডোবা ভেরে ফেলছো… পদ্মা শুকিয়ে যাচ্ছে, তিস্তায় পানি নেই, হাম্মামখানা কোথায় পাবে? পানি নেই, শীতল হাম্মামখানা নেই… বস্তিঅলা জাগো খবরদার…। পানির দেশে পানির হাহাকার। দৌড়ে চলে গেল সোনারগাঁওয়ের টাঁকশালের প্রহরী মোজম। নগরের কংক্রিটের জঙ্গল থেকে রাজকীয় পোশাক-পরিচ্ছদ পরেও আমি ও বাঁশমতি বেগম খুঁজে পাইনি সোনারগাঁওয়ের সেই বিখ্যাত হাম্মামখানা।
হাম্মামখানার খোঁজে সোনারগাঁওয়ের প্রতি পরতে পরতে সে রাতে ঘুরেছি, কিন্তু ইতিহাসের সেই বিখ্যাত হাম্মামখানা কাগজপত্রেই আছে, বাস্তবে এখানে এখন ধু-ধু বালুচর। কিছুক্ষণ পর ভোরের সূর্য উঁকি দেবে। আগুনের বর্শা বিদ্ধ করবে। কিন্তু নদী-জলের হাম্মামখানাকে কি খুঁজে পাবো?