হযরত শাহজালাল (রঃ ) – পর্ব ৯
হযরত শাহজালাল (রঃ ) – পর্ব ৮ পড়তে এখানে ক্লিক করুন
গৌর গোবিন্দের পরিচয় ও তাঁর অত্যাচারঃ
প্রকাশ থাকে যে গৌর গোবিন্দের পূর্ব পুরুষ সম্পর্কে তেমন কোন তথ্য পাওয়া যায় না। তবে ঐতিহাসিকদের মতে জানা যায় তিনি এক মহিয়সী মহিলার জারজ সন্তান ছিলেন। কোন ঐতিহাসিক বলেন, গোবিন্দ সমুদ্রের বড় পুত্র। একদিন ত্রিপুরা রাজ্যের মহীয়সী রাজার অজান্তে সমুদ্র দেবতার সংগে অবৈধ মেলামেশা করে সেই মিলনে সমুদ্র দেবতার গর্ভধারণ করে যে বাচ্চা প্রসব করে তিনিই হল গৌর গোবিন্দ। তাঁর দেহের আকৃতি এমন ভয়ানক ছিল যে তাঁকে দেখলেই মনে ঘৃণা আসত ও ভয় পেত। সে যাই হোক এক সময় তাঁর বুদ্ধির চালে কূটনীতির মাধ্যমে গৌর রাজ্যের অধিপতি হয়ে বস। সিলেটের উত্তর অঞ্চলে পাহাড়িয়া উঁচু টিলার উপর ছিল তাঁর রাজ প্রাসাদ। তাঁর রাজ প্রসাদ এমন ভাবে নির্মান করেছিলেন সেখানে বাইরে কোন শত্রু প্রবেশ করতে পারত না।
সে এমন অত্যাচারী ছিল যে এক সময় অনুভব করতে পারলে যে আমার অসংখ্য শত্রু রয়েছে। তখন থেকে প্রাসাদের চার পাশে পাহাড়ের গুহায় একদল অস্ত্রধারী প্রহরী নিযুক্ত করল যাতে করে কোন শত্রু রাজার উপর আক্রমন না করতে পারে।
গৌর গোবিন্দের রাজ্যের এখানে সেখানে অসংখ্য মুর্তি ছিল। রাজা ও মন্ত্রী সভাসদগণ সকলেই সর্বদা উহার পূজা করত। রাজা এমন ভ্রমের মধ্য নিপতিত ছিল যে সেই মাটির তৈরি মূর্তির আদেশ উপদেশ অনুযায়ী নিজেকে পরিচালিত করত এবং রাজ্যও সি অনুপাতে চালাত তিনি এমন মনগড়া সংবিধানের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল যে, তাঁর অস্ত্রগারে একটি বৃহদাকারের ধনুক ছিল। ন্ত রাজা উহার মাধ্যমে ভাগ্য নির্ধারণ করত। এবার আসা যাক তাঁর অত্যাচারের দিকে। গৌর রাজা অত্যাচারের দিক থেকেই বেশি খ্যাতি লাভ করেছিল।
সমস্ত শিহট্ট তিন ভাগে বিভক্ত করে তিনজন রাজা শাসন করত। আর মধ্য গৌর রাজ্যের শাসক ছিল গোবিন্দ তাইতো তাঁর নাম হয় গৌর গোবিন্দ। তখন তাঁর মন অত্যাচারী উৎপীড়নকারী শাসক অন্য কোথাও দৃষ্টি মান হত না। তাঁর অত্যাচারে বিক্রমে সকল স্তরের জনগণ সর্বদা ভয়ে কম্পমান থাকত। তাঁর অত্যাচারের কথা পাশ্ববর্তী দেশগুলোর করো অজানা ছিল না। এক সময় তিনি পাশ্ববর্তী রাজ্যের উপর তাঁর অত্যাচার হাত বাড়াল। তারাও রক্ষা পেল না। রাজা গোবিন্দ শাসকনীতি পরিহার করে পশুত্বের দ্বারা পার্শ্ববর্তী রাজ্য দখল করে নিজ রাজ্যকে বিস্তার করেন।
শুধু তাই নয় এক সময় তাঁর রাজ্যকে একটি শক্তিশালী রাজ্যে পরিণত করেছিল। ওলিয়ে কামেল হযরত শাহাজালাল (রঃ) এর সিলেট আগমনের পূর্বে সারা শ্রিহট্টকে বিধমীরা দখল করেছিল। মুসলমানদের কোন অধিকার ছিল না। সকল শ্রেণীর জনগণকে অত্যাচারী রাজা মূর্তি পূজায় বাধ্য করত। এই কুআচরণ থেকে কেউই রক্ষা পেত না। সকলে ঘরে ঘরে গৃহ দেবী নির্মান করে উহার পূজা অর্চনা করত। সেখানে ১২ মাসে ১৩ পূজার সমরোহ ঘটত। যারা রাজার পায়রুবী করত তারা বেশ সুখে-শান্তিতেই বসবাস করতে পারাত। কিন্তু মুসলমানরা তাঁর অত্যাচারের কারণে তাদের ধর্ম পালনে সকলে ব্যর্থ ছিল। গোবিন্দের শাসনামলে সিলেট মুসলমানদের সংখ্যাও ছিল কম। মাঝে মধ্যে যারা দু’চার জন ছিল তাদের দুঃখ যাতনার সীমা ছিল না।
কোন মুসলমান স্বীয় ধর্ম পালনে প্রকাশ্যে কোন কাজ করলে বা গোপনেও কিছু করলে তাঁকে রাজ দরবারে হাজির করে তাঁর উপর নানা নির্যাতন উৎপীড়ন করত। কোন কোন স্থানে কোন মুসলমান আযান দিলে কুকুরের মত লালায়িত হিন্দু গোষ্ঠীরা তাঁকে ধরে নিয়ে অত্যাচারী গোবিন্দর কাছে নিয়ে যেত। এক কথায় মুসলমানরা স্বাধীনভাবে তাদের ধর্ম পালন করতে পারতেন না। এমন কি এমন কি কোন মুসলমানরা গরু জবাই করতে পারতেন না বা কোরবানীও করতে পারত না। গোবিন্দের অত্যাচারে সকলমানুষ অতিষ্টিত উঠল। সকলেই একা একা ভাবতে লাগল যে আমার শক্তি থাকলে গোবিন্দের বিরুদ্ধে সংগ্রাম জারী করতাম।
ঈমানী চেতনা তাদের মধ্যে কম ছিল না। কিন্তু কারো একার পক্ষে রাজার বিরুদ্ধে কিছু বলার ক্ষমতা ছিল না। এমন কি কোন স্থানে রাজ সভায় হাজির করে নানা উপায়ে শাস্তি দিয়ে মারধর করে পাঠিয়ে দিত। উচ্চস্বরে আযান একামত দিতে পারত না। নামাজের সূরা বা কোরআন তেলয়াত করতে পারত না। যারা ধর্মে আগ্রহী ছিল তাঁর সকলেই চায় যে স্বীয় ধর্ম পালন করি তারই মুসলমানরাও এদের থেকে ব্যতিক্রমধর্মী ছিল না। সকল মুসলমানদের মনেই ধর্ম পালনের আগ্রহ ছিল কিন্তু অত্যাচারী শাসক গোবিন্দের কারণে মুসলমান তাদের ধর্ম পালন করতে পারত না।
সূত্রঃ তাযকিরাতুল আউলিয়া