হযরত বায়েজীদ বোস্তামী (রঃ) – পর্ব ৪
হযরত বায়েজীদ বোস্তামী (রঃ) – পর্ব ৩ পড়তে এখানে ক্লিক করুন
আবার মদীনা থেকে তিনি যখন বোস্তামে ফিরছেন, তখনও ঐ একই অবস্থা। অজস্র লোক তাঁর প্রত্যুদ্গমনে ভিড় করে। এতে তিনি অস্বস্তি বোধ করেন। হয়ত তাঁর মনে অহংকার দেখা দিতে পারে। হয়ত আল্লাহ্ থেকে তিনি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বেন।
ভিড় বর্জন করার জন্য এখানেও তিনি একই পন্থা অবলম্বন করলেন। তখন রমযান মাস। অথচ দিনের বেলায় রুটি কিনে সকলের সামনে খেতে শুরু করলেন। আর তা দেখে লোকের ধারণা হল, সত্যিই তাঁর মস্তিস্ক বিকৃতি ঘটেছে। সুতরাং এক-দুই করে সবাই তাঁর কাছ থেকে সরে গেল। কেউ কেউ আবার সহানুভূতি প্রকাশ করে বিদায় নিল।
তাঁর জন্য এ কাজটি আপতদৃষ্টিতে শরীয়ত বিরোধী মনে হলেও, অন্যদিক দিয়ে এর অনুমোদনও পাওয়া যায়। তিনি তখন মুসাফির। আর মুসাফিরের জন্য সফরকালে রমযান মাসে রোজা ভঙ্গ করার সুস্পষ্ট বিধান আছে।
একবার হজ্জ-ব্রত পালন করে তিনি তাঁর ও সঙ্গীদের মাল-পত্র চাপিয়ে দিলেন উটের পিঠে। একজন কেউ বললেন, উটের বোঝা ভারী হয়ে গেছে। আপনি কেবল আপনার মাল-পত্র রাখুন। বাকীগুলো আমরা বয়ে নিয়ে যাচ্ছি। হযরত বায়েজীদ (রঃ) তাঁকে বললেন, একটু ভালো করে তাকিয়ে দেখ তো। লোকটি অবাক হয়ে দেখে, সমস্ত মালপত্র উটের পিঠ থেকে অনন্ততঃ এক হাত শূন্যে ঝুলছে। তখন বায়েজীদ (রঃ) বললেন, আমি যদি আমার অবস্থা তোমাদের কাছে গোপন রাখি, তাহলে তোমরা আমাকে দোষী সাব্যস্ত কর। আর যদি প্রকাশ করি, তোমরা তা দেখতে পাও না। আমার সমস্যা বুঝছ তো? আমি এখন কোন পথ ধরব বলতে পার?
সত্যিই হযরত বায়েজীদ (রঃ)-এর সাধনা বড় কঠিন জটিল এবং দুর্ভেদ্য।
উপমা সহকারে তিনি তাঁর সাধনার ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করেছেন। মানুষের নফস বা কু-প্রবৃত্তি যেন কয়লা সদৃশ। প্রথমতঃ তিনি কয়লার প্রভাবে অর্থাৎ তামসিকতার ভুগছেন। তখন এবাদাত-বন্দেগীর অগ্নিকুণ্ডে ফেলে দিয়ে কয়লাকে তিনি উত্তপ্ত করেন। আর তওবা ও অনুতাপের হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করে তাকে আয়নার মতো স্বচ্ছ করেন। এ নিয়ে পাঁচ বছর অতিবাহিত হয়। নানা ধরনের এবাদত-বন্দেগীতে নিজেকে তিনি গড়ে তোলেন। পরে পুরো এক বছর নিজের প্রতি সূক্ষ্ম দৃষ্টি ফেলে তিনি দেখতে পান, অহংকারের রশি তাঁর কাঁধে। এ রশি ছিন্ন করার জন্য আরও পাঁচ বছর তিনি কঠোর সাধনায় রত হন। আর নব মুসলমান হয়ে যান। তখন মানব সমাজকে তাঁর মৃত বলে মনে হয়। তিনি তাদের ওপর জানাযা আদায় করে তাদের থেকে আলাদা হয়ে যান। যেমন জানাযা আদায়কারীরা মৃত ব্যক্তি থেকে আলাদা হয়ে যায়। তারপর তিনি আল্লাহ্র নৈকট্যলাভে সক্ষম হন।
একবার দেখা যায়, মসজিদের দরজায় দাঁড়িয়ে হযরত বায়েজীদ (রঃ) কান্নাকাটি করছেন। এর কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, আমি নিজেকে ঋতু-বতী নারীর মতো মনে করছি। ঋতু অবস্থায় তারা যেমন মসজিদে ঢুকতে ভয় পাচ্ছি।
একবার এক হাবশীর কথায় তিনি হজ্জযাত্রা থেকে ফিরে আসেন। হাবশী বলেছিল, আপনি আল্লাহকে বোস্তামে ফেলে রেখে যাচ্ছেন কেন?
আর একবার হজ্জের পথে এক ব্যক্তি তাকে জিজ্ঞেস করে, আপনি কোথায় যাচ্ছেন? তিনি তাঁর উদ্দেশ্যের কথা জানান। তখন আবার প্রশ্ন, সঙ্গে টাকাকড়ি কিছু আছে কি? তিনি বলেন, আছে দুশ’দীনার। লোকটি বলল, আমি গরীব মানুষ। সংসার চালাতে পারি না। আপনি দয়া করে টাকাগুলো আমাকে দিয়ে দিন। আর আমাকে সাতবার প্রদক্ষিণ করে দেশে ফিরে যান। আপনার হজ্জ আদায় হবে। হযরত বায়েজীদ (রঃ) তাই করলেন। টাকাকড়ি যা ছিল সব দিয়ে ফিরে এলেন বোস্তামে।