হযরত বায়েজীদ বোস্তামী (রঃ) – পর্ব ১৩

হযরত বায়েজীদ বোস্তামী (রঃ) – পর্ব ১২ পড়তে এখানে ক্লিক করুন

তখন বায়েজীদ (রঃ)-এর অন্যান্য অতিথি ও শিষ্যগণ বললেন, নফল রোজা তরক করে যদি দাওয়াত রক্ষা করা হয়, তাহলে রোজা ও দাওয়াত রক্ষা- দুটি পুণ্য পাওয়া যায়। কিন্তু তবুও আবু তুরাব রোজা ভাঙতে সম্মত হলেন না। এবার কথা বললেন হযরত বায়েজীদ বোস্তামী (রঃ)। বললেন, তোমরা হয়ত জান না, এ লোকটি আল্লাহ্‌ থেকে বহু দূরে পড়ে রয়েছে।

কয়েকদিন পর দেখা গেল, চুরির অপরাধে আবু তুরাব গ্রেপ্তার হয়েছেন। আর বিচারে দোসী সাব্যস্ত হওয়ার তাঁর হাত কাটা হয়েছে।

তাঁর কৃতজ্ঞতাবোধও ছিল অসাধারণ। একবার জামে মসজিদের কোণায় হাতের ছড়িখানা দাঁড় করিয়ে রেখে তিনি নামাজ পড়ছিলেন। কোনভাবে সেখানে মেঝেতে পড়ে যায়। আর এক বৃদ্ধ ব্যক্তি আবার তা খাড়া করে রাখেন। নামাজ শেষ করে ঘটনাটি শোনামাত্র তিনি ঐ বৃদ্ধের বাড়ী গিয়ে তাঁর এ কাজের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।

পাছে মনের মধ্যে এক বিন্দু অহংকার আসে, এই ভয়ে তিনি সদা সতর্ক থাকতেন। একবার দজলা নদী তাঁর সম্মানে স্ফীত হয়ে তরঙ্গোচ্ছ্বাস নিয়ে তাঁর পায়ের ওপর আছড়ে পড়ে। তাতে বিন্দুমাত্র গৌরববোধ করেননি তিনি। বললেন, তাঁর দীর্ঘ ত্রিশ বছরের সংগ্রাম ও সাধনা নিমেষের মধ্যে নষ্ট হোক, এ তিনি চান না। তিনি শুধু তাঁর প্রতিপালকের সন্তুষ্টির প্রত্যাশী। অলৌকিকতা তাঁর কাম্য নয়।

একবার তিনি স্থির করেন, পরিবার-পরিজনের গুরুদায়িত্ব আল্লাহ্‌র হাতেই ছেড়ে দেবেন। আর এই মর্মে মোনাজাতের জন্য তিনি আল্লাহ্‌র দরবারে প্রায় হাত ওঠাতে গেছেন, হঠাৎ মনে হল, কাজটা নবীজীর সুন্নতের বিরুদ্ধে যাবে। কেননা, রাসূলে কারীম (সঃ) তাঁর পরিবার-পরিজনের ভার আল্লাহ্‌র হাতে সোপর্দ করেননি। তার সেটা মনে হওয়া মাত্র তিনি তাঁর সংকল্প পরিত্যাগ করলেন। তিনি বলেছেন, তারপর থেকে আল্লাহ্‌ অবশ্য এ ব্যাপারটি খুব সহজ করে দেন।

ইমামের পেছনে নামাজ আদায় করে মসজিদে বসেছেন বায়েজীদ (রঃ)। ইমাম সাহেবও তাঁর কাছে এসে বসলেন। কথা প্রসঙ্গে তিনি বায়েজীদ বোস্তামী (রঃ)-কে তাঁর জীবিকা নির্বাহের উপায় অবলম্বন সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করলেন। তিনি জানালেন, প্রথমে তাঁর নামাজের কাজা আদায় করে তিনি তাঁর প্রশ্নের জবাব দেবেন।

অবাক হয়ে ইমাম বললেন, এই মাত্র তো নামায পড়লেন। কাজা পরবেন কেন?

হযরত বায়েজীদ (রঃ)-এর সুস্পষ্ট উত্তর, যিনি রুজিদাতাকেই চিনতে পারেননি, তাঁর পেছনে নামাজ পড়া দুরস্ত হয়নি। বলাবাহুল্য, ইমাম সাহেব আর কথা খুঁজে পেলেন না। তাঁর শিক্ষা হয়ে গেল। হযরত বায়েজীদ (রঃ) নিজেই বলেছেন, তাঁর আপাত-অসংগত কার্যকলাপ দেখে যারা তাঁর পেছনে নিন্দাবাদ করে, তাড়া আল্লাহ্‌র ক্রোধে পতিত হয়, আর যারা তাঁকে স্বাভাবিক অবস্থায় দেখে তার প্রশংসা করে। তারা পুণ্যের অধিকারী হয়।

তিনি প্রায় বলতেন, যদি রোজ কিয়ামত একটু তাড়াতাড়ি আসে তাহলে তিনিও তাড়াতাড়ি জাহান্নামের দরজায় গিয়ে দাঁড়াতেন। তাহলে জাহান্নাম কিছুটা স্নিগ্ধ হয়ে যেত আর জাহান্নামবাসীরাও ঈষৎ শান্তি পেত।

কিছু লোক তাঁকে বলল, হাতেম ইবনে আসাম (রঃ) বলেন, যারা কিয়ামতের দিন জাহান্নামীদের জন্য আল্লাহ্‌র কাছে সুপারিশ করবে না, তারা আমার মুরীদ নয়। এ কথা শুনে হযরত বায়েজীদ (রঃ) বললেন, আর যারা জাহান্নামবাসীদের জান্নাতে পাঠাবার জন্য নিজেরা জাহান্নাম বরণ না করবে, তারা আমার মুরীদ নয়। অর্থাৎ গুনগত দিক দিয়ে তার শিষ্যবর্গকে কেমন হতে হবে তিনি তার আভাস দিলেন।

আল্লাহ্‌ যখন তাঁকে প্রভূত অলৌকিকতা দান করেছেন, তখন তার উচিত ছিল পথ-ভ্রষ্টদের সরল পথে ফিরিয়ে আনা। কিন্তু তিনি তা করছেন না কেন? তাঁকে এ প্রশ্ন করা হলে তিনি উত্তর দেন, যারা নিজেরাই দূরে সরে যায়, তাঁদের আমি কিভাবে আল্লাহ্‌র পথে টেনে আনতে পারি?

মাথা নিচু করে তিনি বসে আছেন। তিনি উপবিষ্ট বটে। কিন্তু তার মধ্যে তিনি নেই। আর ঠিক এ অবস্থায় এক জ্ঞানী ব্যক্তি তাঁর কাছে এলেন। বললেন, আপনাকে এমন চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন?

তিনি কোন উত্তর দিলেন না। বরং প্রশ্ন শোনামাত্র আরও চিন্তাক্লিষ্ট হলেন। তারপর আচমকা জ্ঞান হারিয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়লেন। কিছুক্ষণ পরে জ্ঞান ফিরে এলে তিনি বলে ওঠলেন, প্রভু গো! কেন জানি না, আপনি আজ আমার মুখ থেকে নিজের মারেফতের কথা প্রকাশ করালেন। আল্লাহ্‌র ভয়ে ভীত এই মানুষটি একদিন কাঁপছেন, একজন কেউ তাঁর এ অবস্থার কথা জানতে চাইলে বললেন, দীর্ঘ ত্রিশ বছরের কঠোর সাধনার বলে যে অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে, তা তুমি বুঝবে না।

হযরত বায়েজীদ বোস্তামী (রঃ) – পর্ব ১৪ পড়তে এখানে ক্লিক করুন

You may also like...

দুঃখিত, কপি করবেন না।