হযরত জাফর (রাঃ) ও অন্যান্য সাহাবা (রাঃ) দের প্রথম হাবশায় ও পরে মদীনায় হিজরত – শেষ পর্ব
বর্ণনাকারী বলেন, হযরত আবু মূসা (রাঃ) বলিয়াছেন, আমরা আমাদের কওমের পঞ্চাশের উর্দ্ধে অথবা বলিয়াছেন, তিপ্পান্ন জনের অথবা বলিয়াছেন বাহান্ন জনের সহিত ছিলাম। আমরা একটি নৌকায় আরোহণ করিলাম। কিন্তু নৌকা আমাদিগকে হাবশায় নাজাশীর নিকট পৌঁছাইয়া দিল। সেখানে আমরা হযরত জাফর ইবনে আবি তালিব (রাঃ)কে পাইলাম। আমরা তাহার সহিত সেখানে থাকিয়া গেলাম।
তারপর আমরা একত্রে মদীনায় আসিলাম। নবী কারীম (সাঃ)এর খাইবার বিজয়ের পর আমরা তাঁহার খেদমতে পৌঁছিলাম। অনেকে আমাদের নৌকার আরোহীদেরকে বলিতে লাগিল যে, আমরা হিজরতে তোমাদের অপেক্ষা অগ্রগামী রহিয়াছি। (অর্থাৎ আমরা তোমাদের পূর্বে মদীনায় হিজরত করিয়াছি, তোমরা আমাদের অপেক্ষা পিছনে রহিয়াছ।) হযরত আসমা বিনতে উমাইস (রাঃ) ও হাবশা হইতে আগমনকারী আমাদের মধ্যকার একজন ছিলেন।
তিনি রাসূল (সাঃ)এর স্ত্রী হযরত হাবসা (রাঃ) এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করিতে তাঁহার ঘরে গেলেন। হযরত আসমা (রাঃ) মুসলমানদের সহিত হাবশায় হিজরত করিয়াছিলেন। হযরত ওমর (রাঃ) হযরত হাবসা (রাঃ)এর ঘরে যাইয়া সেখানে হযরত আসমা (রাঃ) কে দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, ইনি কে? হযরত হাবসা (রাঃ) বলিলেন, ইনি হযরত আসমা বিনতে উমাইসা (রাঃ)। হযরত ওমর (রাঃ) বলিলেন, সেই হাবশায় হিজরতকারিণী, সমুদ্রে সফরকারিণী? হযরত আসমা (রাঃ) বলিলেন, হ্যাঁ। হযরত ওমর (রাঃ) বলিলেন, হিজরতের ব্যাপারে আমরা তোমাদের
অপেক্ষা অগ্রণী, অতএব রাসূল (সাঃ)-এর ব্যাপারে আমরা তোমাদের অপেক্ষা বেশী অধিকার রাখি।
ইহা শুনিয়া হযরত আসমা (রাঃ)এর রাগ হইল। তিনি বলিলেন, কখনও এমন হইতে পারে না, আল্লাহর কসম, আপনারা রাসূল (সাঃ) এর সঙ্গে ছিলেন, আপনাদের ক্ষুধার্তকে তিনি খাওয়াইতেন, অন্ধকে শিক্ষা দিতেন। আমরা হাবশায় এমন জায়গায় ছিলাম, যেখানকার লোকজন দ্বীন হইতে দূরে, দ্বীনের দুশমন ছিল। আর এই সকল কষ্ট আমরা আল্লাহ ও রাসূলের খাতিরে সহ্য করিয়াছি।
আল্লাহর কসম, যতক্ষণ না আপনার এই কথা রাসূল (সাঃ)-এর নিকট আলোচনা করিয়াছি এবং তাঁহাকে এই ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করিয়াছি ততক্ষণ আমি কিছুই খাইব না, পান করিব না। আল্লাহর কসম, আমি মিথ্যা কথা বলিব না, এদিক সেদিকের কথা ও অতিরঞ্জিত কিছু বলিব না। অতঃপর নবী কারীম (সাঃ) আসিলে হযরত আসমা (রাঃ) বলিলেন, হে আল্লাহর নবী, ওমর (রাঃ) এই এই কথা বলিয়াছেন।
রাসূল (সাঃ) জিজ্ঞাসা করিলেন, তুমি কি বলিয়াছ? বলিলাম, আমি এই এই কথা বলিয়াছি। তিনি বলিলেন, আমার ব্যাপারে সে তোমার অপেক্ষা বেশী অধিকার রাখে না। তাহার ও তাহার সঙ্গীদের শুধু এক হিজরত, আর তোমাদের নৌকায় আরোহীদের দুই হিজরত হইয়াছে।
হযরত আসমা (রাঃ) বলেন, আমি দেখিয়াছি, হযরত আবু মূসা (রাঃ) ও নৌকায় আরোহী অন্যান্যরা দলে দলে আসিয়া আমার নিকট এই হাদিস সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করিতেন। নবী কারীম (সাঃ) তাহাদের সম্পর্কে যে ফযিলতের কথা বলিয়াছেন তাহা অপেক্ষা বড় ও আনন্দের বিষয় তাহাদের নিকট দুনিয়ার আর কোন জিনিস ছিল না। হযরত আসমা (রাঃ) বলেন, আমি হযরত আবু মূসা (রাঃ) কে দেখিয়াছি, তিনি বার বার আমার নিকট হইতে এই হাদিস শুনিতেন।
আবু মূসা (রাঃ) বলেন, রাসূল (সাঃ) আশআরী সাথীগণ যখন রাত্রিবেলায় কোরআন তিলাওয়াত করে তখন তাহাদের কণ্ঠস্বর চিনিতে পারি নাই এবং দিনেরবেলায় যদিও তাহাদের অবস্থানগুলি আমি দেখি নাই, তথাপি রাত্রিবেলায় কণ্ঠস্বর শুনিয়া আমি তাহাদের অবস্থানগুলি জানিতে পারি
হযরত হাকীম (রাঃ) ও এই আশআরী সাথীদের মধ্যে একজন। তিনি (এমন বাহাদুর ব্যক্তি ছিলেন যে,) শত্রুর সহিত মুকাবিলার সময় (পলায়নরত শত্রু সৈন্যদিগকে যুদ্ধের আহবান জানাইয়া) বলিতেন, পালাইও না আমার সঙ্গীগণ তোমাদিগকে একটু অপেক্ষা করিতে বলিতেছে অথবা মুসলমান ঘোড়সওয়ারদিগকে দেখিলে বলিতেন, আমার সঙ্গীগণ তোমাদিগকে একটু অপেক্ষা করিতে বলিতেছে যেন সকলে একত্রিতে আক্রমণ করিতে পারি।
শা’বী (রহঃ) বলেন, হযরত আসমা বিনতে উমাইস (রাঃ) আরজ করিলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ, কিছু লোক আমাদের উপর গর্ব করিয়া বলে যে, আমরা অগ্রবর্তী মুহাজিরীনদের অন্তর্ভুক্ত নহি। রাসূল (সাঃ) বলিলেন, তাহা নহে, বরং তোমাদের তো দুই হিজরত হইয়াছে। প্রথম তোমরা হিজরত করিয়া হাবশায় গিয়াছ, তারপর তোমরা পুনরায় হিজরত করিয়া মদীনায় আসিয়াছ। (ফাতহুল বারী)
সূত্রঃ হায়াতুস সাহাবা