হযরত ওমর (রাঃ) এর জীবনের যবনিকা

ফিরোজ নামে এক লোককে ইরানের পতনের পরে যে ব্যক্তি ধৃত হয়ে মদীনায় নীত হয়েছিল, তাঁদের মধ্যে সে একজন।  তাঁকে গোলাম করে আনা হয়েছিল, মদীনায় সে হযরত মুগীরা ইবনে শো’ব (রাঃ)-এর গোলাম ছিল। যদিও সে বাহ্যিক দিক দিয়ে ইসলাম গ্রহন করেছিল বলে প্রমাণ করত, কিন্তু আন্তরিকভাবে সব সময় চেষ্টা করত, যাতে তাঁর মাতৃভূমির পতনের প্রতিশোধ গ্রহণ করতে পারে।   

তাঁর ইরানের পতনে সে খুবই দুঃখিত ছিল। এজন্য সে সুযোগ খুঁজতেছিল, যে কোন ভাবে খলিফাকে হত্যা করবে।  একদিন ফিরোজ হযরত ওমর (রাঃ)- এর সেবায় উপস্থিত হয়ে বলল, আমার প্রভু মুগীরা আমার নিকট হতে দু’ দিরহাম করে মাশুল আদায় করে। এত বেশি মাশুল আমার নিকট হতে আদায় করলে আমি দারুণ কষ্ট পাই। 

অতএব, আপনি আমার প্রভুর নিকট সুপারিশ করুন, যাতে তিনি আমার নিকট হতে কিছু কম  মাহসুল আদায় করে। 

তখন খলিফা উত্তর করল, আমি লৌহকার।

তখন হযরত ওমর (রাঃ) এ ব্যাপারে খুঁজে নিয়ে দেখলেন যে, লৌহকারের আয় বেশি। তাই তিনি এ  বলে সুপারিশ করতে অস্বীকার করলেন যে, এ জাতীয় শিল্প ভাল আয় করে। অতএব, দু দিরহাম আদায় করা তোমাদের জন্য অবশ্যই বেশি নয়।

হযরত ওমর (রাঃ) এর এ উত্তরে শ্রবন করে ফিরোজ মনে মনে খুব উত্তেজিত হল। এতদিন যাবৎ সে হযরত ওমর (রাঃ) কে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করছিল।

তদপুরি তাঁর সুপারিশ করতেও হযরত ওমর (রাঃ) অস্বীকার করলেন। এ জন্য ফিরোজ আর নিজেকে সামলিয়ে রাখতে পারল না। একদিন ভোর বেলা হযরত ওমর (রাঃ) মসজিদে ফজরের নামাজের ইমামতি করছিলেন। সে সময় ফিরোজ অকস্মাৎ পিছন দিক হতে তাঁর উপর ঝাঁপিয়ে  পড়ল। হাতেই ধারাল ছুরি দিয়ে বার বার আঘাত করতে লাগল।  নিদারুণ যন্ত্রনায় খলিফা হযরত ওমর (রাঃ) কাতর হয়ে সেখানেই পড়ে গেলেন। তাঁর পরিবর্তে আবদুর রহমান ইমামতি করলেন।

নামাজ শেষ হলে সকলে তাঁকে কাঁধে করে বাড়িতে পৌঁছে দিল। ফিরোজকে ধরতে পারল না। মসজিদে আরও দু’তিনজনকে জখম করে সে নিজেও আত্নহত্যা করল। খলিফা বুঝতে পারলেন, তাঁর জীবনের প্রদীপ নিভতে আর বেশি দেরী নেই। সুতরাং পুত্র আবদুল্লাহ কে ডেকে তিনি বললেন, বিবি আয়েশার কাছে গিয়ে আমার জন্য অনুমতি প্রার্থনা কর, হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর পাশে যেন  আমার স্থান হয়। তিনি যদি অনুগ্রহ করে রাজী হন তবে আমার ইন্তেকালের পর মুহাম্মদ (সাঃ) এর পাশে আমাকে কবর দিও। 

এ দুর্ঘটনার সংবাদ শুনে হযরত বিবি আয়েশা (রাঃ) কাঁদছিলেন। আবদুল্লাহর প্রস্তাব শুনে তিনি কান্না ভরা কণ্ঠে  বললেন, ভেবেছিলাম হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর পাশে আমি ঠাই নেব। কিন্তু খলিফা হযরত ওমর (রাঃ) আমার পূর্বে চললেন, তাঁর ইচ্ছাই পূর্ণ হবে।

ছুরিকাঘাতে হযরত ওমর (রাঃ) এর পেট ছিড়ে গিয়েছিল। এ যখম হবার পর তিনি কয়েকদিন বেঁচে ছিলেন, এ সময় তিনি যা কিছুই আহার করতেন তা পেটের যখমী পথ দিয়ে বের হয়ে যেত। এমন করুন অবস্থায়ও হযরত ওমর (রাঃ) খিলাফতের দায়িত্ব হতে কিছুক্ষণের জন্যও ক্ষান্ত হলেন না। সবাই যখন দেখলেন যে, তাঁর শারীরিক অবস্থা খুবই খারাপ। তখন কয়েকটি বিশিষ্ঠ সাহাবা আরয করলেন, হযরত আবু বকর দিদ্দীক (রাঃ) তাঁর ইন্তেকালের সময় আপনাকে নিজের স্থলাভিষিক্ত মনোনীত করে বিরাট এক দায়িত্ব আমাদের মুক্তি দান করেছিলেন। তদ্রুপ আপনিও যদি আপনার পরের খলিফা মনোনীত করে দিতেন তাহলে খুবই ভাল হত। আমাদের এই কথার উত্তরে তিনি বললেন, আমি কোন ব্যক্তির নাম ঘোষণা করব না। অতঃপর ছয় বুযুর্গের মধ্য হতে আপনারা গভীর চিন্তা করে একজনকে মনোনীত করবেন। আর সে ছয়জন ব্যক্তি হলঃ

(১) হযরত আলী (রাঃ), (২) হযরত উসমান (রাঃ), (৩) হযরত যুবায়ের ইবনুল আওয়াম (রাঃ)

, (৪) হযরত আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রাঃ)। (৫) হযরত তালহা (রাঃ) (৬) হযরত সা’দ ইববে অয়াক্কাস (রাঃ) হযরত ওমর (রাঃ) পরবর্তী খিলাফতের দায়িত্ব সম্পর্কে অসীয়ত করলেন যে, আমার পরে যিনি খলিফা নির্বাচন হবেন, তিনি যেন আনসারদের অধিকার সম্মান আর মর্যাদা রক্ষা  করলেন। খুবই ভাল ব্যবহার করবে তাঁর সঙ্গে।  সত্যই আমরা তাঁদের কাছে খুবই কৃতজ্ঞ। আমাদেরকে অনেক সাহায্য করেছেন আনসাররা। তাঁদের সাথে মুহাজিরদের সম্মান এবং যেন বিন্দু মাত্র অভিযোগের কোন কিছু না ঘটে। এর কারণ হল, এ ইসলামের ভিত্তি তাঁদের মাধ্যমেই স্থাপিত হয়েছে জিম্মীদেরকেও যেন অবহেলা না করা হয়। তাঁদের নিজের অধিকার হতে কখনও যেন বঞ্চিত কর করা না হয়।  

হিজরী ২৪ সনের মহররমের প্রথম তারিখে রাতের শেষ দিকে তাঁর মৃত্যু যন্ত্রণা আরম্ভ হল।

সূর্যোদয়ের পূর্বে তাঁর একটু জ্ঞান ফিরে এসেছিল এবং তিনি চোখ খুলেন। তাঁর কাছেই একজন   ব্যক্তি দণ্ডায়মান ছিল তাঁর পাজামা পায়ের গোড়ালি নিজ পর্যন্ত ছিল। তখন তিনি তাঁকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ভাতিজা, পাজামা গোঁড়ালির উপর রাখ। কারণ এতে ইবাদত ও পরিচ্ছন্নতা দুটিই রয়েছে। এরপরেই তিনি অজ্ঞান হয়ে যান এবং অল্পক্ষনের মাঝে তিনি শাহাদাত বরণ করলেন। এভাবে খিলাফতের দ্বিতীয় সূর্যও অস্তমিত হল (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন) এরপর তাঁকে গোছল এবং কাফনের পর নামাযের জন্য জানাযা রাখা হল। 

তখন হযরত আলী (রাঃ) বললেন, পূর্ব থেকেই আমার বিশ্বাস ছিল যে, হযরত ওমর (রাঃ) হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর পাশেই স্থান পাবেন।  কারণ হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) সব সময় নিজের পরে এ দু বুযুর্গের নামই বেশি উচ্চারণ করতেন।  এরপরও আমি দোয়া করি যে, মহান আল্লাহ্‌ হযরত ওমর (রাঃ) এর আমলনামার মত আমারও আমলনামা করে দেন।

হযরত সুহাইব (রাঃ) তখন মসজিদে নববীতে নামাজের ইমামতি করে ছিলেন। তিনি এসে জানাযার নামায পড়ালেন।  হযরত আলী (রাঃ), হযরত উসমান (রাঃ, হযরত আবদুর রহমান, হযরত আউফ (রাঃ), হযরত তালহা (রাঃ), হযরত ইবনে সাইদ আবু ওয়াক্কাস (রাঃ) মিলিত ভাবে তাঁর লাশ কবরে রাখেন। এমনি ভাবে একটি জীবনের সমাপ্তি ঘটল।   

You may also like...

দুঃখিত, কপি করবেন না।