হযরত ইসহাক ইব্রাহীম ইবনে আহমদ খাওইয়াস (রঃ) – শেষ পর্ব
হযরত ইসহাক ইব্রাহীম ইবনে আহমদ খাওইয়াস (রঃ) – পর্ব ৫ পড়তে এখানে ক্লিক করুন
পর দিন ভোরে দরবেশ বললেন, আজ থেকে আমি কর্তা। আপনি আমার আজ্ঞাবাহী। তিনি রাজি হয়ে গেলেন। পরে তাঁরা যখন মঞ্জিলে পৌঁছালেন, তখন হযরত আবু ইসহাক (রঃ) আগের মতো সব কাজ নিজেই করতে লাগলেন। তখন সঙ্গী দরবেশ বললেন, এখন কর্তার নির্দেশ ছাড়াই আপনি কাজ করছেন কেন? তিনি বললেন, যখন নিজের কাজ কর্তাকে দিয়ে করানো হয়, তখন নিজেকে অমান্য করা হয়। আর কর্তার সেবা করা তার বিরুদ্ধাচরণ নয়। দরবেশ তাঁর সঙ্গে মক্কা পর্যন্ত যান। পরে তাঁর কাজকর্মে লজ্জিত হয়ে তাঁর সঙ্গ ত্যাগ করেন। পরে তাঁর সাথে এক জায়গায় দেখা হলে হযরত ইসহাক (রঃ) বলেন, আমি যেভাবে আপনাকে সঙ্গ দিয়েছি, আপনিও আপনার বন্ধুদেরকে অনুরূপ সঙ্গ দিবেন ও ব্যবহার দেখাবেন।
আপনি কোথা থেকে খাবার পান? এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, সন্তান মাতৃগর্ভ থেকে এবং বন্য প্রাণীকে বনে থেকে যেখানে থেকে খাবার পায় আমিও ঐ স্থান থেকে পাই। একবার বুকে করাঘাত করে তিনি আক্ষেপ করেন যে, তিনি আমাকে দেখছেন, আমি তাঁকে দেখছি না।
নির্ভরশীল লোকদের কি কখনও লোভ হয়? এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, হয়। লোভ মানুষের প্রবৃত্তি। তা সব সময়ে মনে জাগরূক থাকে। কিন্তু তা থাকলেও নির্ভরশীল লোকদের কোন ক্ষতি করে না। কারণ, যে শক্তি দিয়ে লোভ দমন করা যায়, তাঁদের তা থাকে না।
তিনি বলতেনঃ
১. যে বিশ্বাস করে যে, আল্লাহ তাঁর প্রতিশ্রুতি পাওল করেন, তার উচিত আল্লাহর ওপর ভরসা রেখে বিশ্রাম নেয়া ও তাঁর ওপর পূর্ণ নির্ভরশীল হওয়া।
২. বেশী বিদ্যা অর্জন করলেই আলেম হওয়া যায় না। বরং প্রকৃত আলেম তাঁকেই বলে, যিনি নিজের শিক্ষা অনুযায়ী কাজ করেন ও সুন্নাতের অনুসরণে অবহেলা করেন না। তাতে তাঁর বিদ্যার কম হলেও যায় আসে না।
৩. যে ব্যক্তি আল্লাহ সঙ্গে পরিচয়ের দাবী করে, অথচ আল্লাহ ছাড়া অন্যের পেছনে ঘুরতে শান্তি পায়, তার ওপর কঠিন বিপদ পতিত হয়। আর আল্লাহর মারেফাতের দাবীদার হয়ে জগত থেকে
যে বিচ্ছিন্ন হয় না, আল্লাহ তাকে তার রহমত থেকে দূর করে দেন। শেষ পর্যন্ত অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে, স্বয়ং জগত তাকে ঘৃণা ও অবজ্ঞা করে।
৪. ইহলোকে যে কাঁদে, পরলোক সে অবশ্য হাসবে।
৫. কুরআন-হাদিসের নির্দেশানুযায়ী অবিচল থেকে এবাদতকে ধৈর্য বলে।
৬. যাবতীয় কামনা ও মানবীয় চাহিদা রবিনাশই হল প্রেম।
৭. রুগ্ন হৃদয়ের ঔষধ পাঁচটি। যথাঃ (১) নিয়মিত কুরআন পাঠ ও সেই মত কাজ করা, (২) পেট কিছুটা খালি রাখা, (৩) শেষ রাতে জেগে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়া, (৪) প্রত্যুষে আল্লাহর দরবারে বিনীত ও কাতর প্রার্থনা করা, (৫) সাধক-দরবেশগণের সান্নিধ্য অবলম্বন করা।
৮. তিনি বুকের ওপর হাত রেখে বলতেন, আমি সেই আল্লাহর দীদার প্রত্যাশী, যিনি প্রতিনিয়ত আমাকে দেখেন। আপনি খাবার পান কোথা থেকে? এর উত্তরে তিনি বললেন, যেখান থেকে খাবার আসে মাতৃগর্ভে। যেমন আল্লাহ কুরআনে বলেছেন, আল্লাহ তাঁকে এমন স্থান থেকে রুজি পৌঁছে দেন, যা কেউ কল্পনাও করতে পারে না।
৯. আল্লাহর ওপর নির্ভরশীল লোক কি লোভী হন? এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, অবশ্যই লোভী হয়ে থাকেন। কেননা লোভ-লালসা প্রবৃত্তির একটি অবিচ্ছেদ্য গুণ- যা মানব হৃদয়ে নিশ্চিতরূপে থাকে। তবে লোভ-লালসা নির্ভরশীলদের কোন ক্ষতি করতে পারে না। কেননা, আল্লাহ তাদেরকে লোভ-লালসার ওপর প্রবল করে দিয়েছেন। অতএব লোভ-লালসা তাঁর আদেশের অধীন।
শেষ জীবনে হযরত আবু ইসহাক (রঃ)-এর আমাশয় ও উদরাময় রোগ দেখা দেয়। একদা মসজিদে যাওয়ার পর তিনি ঐ রোগে আক্রান্ত হন। মল ত্যাগের জন্য তাঁকে বার বার বাইরে যেতে হয়। দিনে ও রাতে মোট ষাটবার তিনি বাইরে যান। তিনি প্রতিবারই স্নান করে দুরাকাত করে নফল নামাজ আদায় করেন। তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়, আপনার কি কোন কিছু খেতে ইচ্ছা হয়? তিনি বলেন, ভুনা কলজে খেতে ইচ্ছা হয়। এই বলে তিনি স্নান করলেন। আর তারপরেই চিরবিদায় গ্রহণ করেন। তাঁর মরাদেহ মসজিদ থেকে অন্য এক বাড়ীতে নিয়ে যাওয়া হয়।
২৯১ হিজরীতে তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন। তাঁর মৃত্যুর কিছুক্ষণ পরে একজন দরবেশ এসে তাঁর মাথার বালিশ তুলে এক টুকরো রুটি দেখতে পান। তিনি বললেন, এই রুটি দেখতে না পেলে আমি তাঁর জানাজা পড়তাম না। কেননা, রুটি থাকাতে প্রমাণ হয় তাওয়াক্কুলের ওপরই তাঁর মৃত্যু হয়েছে। এবং তাওয়াক্কুল ছাড়া দরবেশগণের অন্য কোন গুণ তাঁর মধ্যে ছিল না। বস্তুতঃ সুফী-দরবেশদের নিদর্শন হল তাঁরা সব রকম গুণের অধিকারী হবেন, কেবল এক ধরণের গুণ আঁকড়ে থাকলে চলবে না।
সূত্রঃ তাযকিরাতুল আউলিয়া
হযরত ইসহাক ইব্রাহীম ইবনে আহমদ খাওইয়াস (রঃ) – পর্ব ১ পড়তে এখানে ক্লিক করুন