হযরত ইউসুফ (আঃ) এর সৎ ভাইদের ছোলনা
হযরত ইউসুফ (আঃ)-এর দশজন সৎ ভাই জঘন্য ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে হযরত ইউসুফ (আঃ)-কে কূপে নিক্ষেপ করে মনে করল, অবশ্যই তিনি মারা গেছেন। তাই সকলে নিশ্চিন্ত হল এবং যথেষ্ট আনন্দ প্রকাশ করল। সকলে বলাবলি করতে লাগল সবার পিতা কয়েক দিন হয়ত ইউসুফের কথা স্মরণ রাখবেন তারপরে ইউসুফের অবর্তমানে তাঁদেরকে অধিক ভালবাসতে আরম্ভ করবেন। তবে এখন ইউসুফের সম্বন্ধে পিতাকে কি বলা যায় তা নিয়ে সকলেই দুশ্চিন্তা গ্রস্থ হল। অনেক ভাবনা চিন্তার পরে তারা স্থির করল, পিতাকে গিয়ে বলবে, ইউসুফকে বাঘে খেয়ে ফেলেছে। এর চাইতে উত্তম জবাব আর কিছুই নেই। তবে এ ব্যাপারে কিছু প্রস্তুতি নিতে হবে। এ সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁরা একটি মেষ জবেহ করে তাঁর রক্ত ইউসুফ এর পরিত্যাক্ত জামা কাপড়ে লাগিয়ে তাঁরা বাড়ীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা করল। সন্ধ্যার পরে এসে তাঁরা পিতার নিকট পৌঁছল।
পিতা দশ ভাইকে দেখতে পেল কিন্তু হযরত ইউসুফ (আঃ)-কে তাঁদের সাথে দেখলেন না, তাই তিনি ব্যাকুলতার সাথে জিজ্ঞাসা করল, ইউসুফ কোথায়? ভাইয়েরা পিতার মুখে হযরত ইউসুফ (আঃ)-এর কথা শুনা মাত্র সজোরে চিৎকার দিয়ে কাঁদতে আরম্ভ করল এবং ওদের একজনে বলল, “প্রিয় পিতা! চারণ ভূমিতে আমরা যখন দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছি তখন ইউসুফকে আমাদের মালপাত্র পাহারা দেয়ার জন্য এক নির্দিষ্ট স্থানে রেখে যাই। প্রতিযোগিতা শেষে আমরা ফিরে এসে দেখি ইউসুফের রক্ত মাখা জামা কাপড় পড়ে আছে এবং ইউসুফকে বাঘে খেয়ে ফেলেছে। এই বলে রক্তাক্ত জামা কাপড়গুলো পিতার সম্মুখে রেখে দিল।
পিতা ওদের কথা শুনে বললেন, যা আশংখা করেছিলাম তাই ঘটল। অতঃপর পিতা ইউসুফ (আঃ)-এর জামাকাপড় হাতে ধরে দেখলেন এবং বললেন, ইউসুফকে বাঘে খেয়েছে মেনে নিলাম কিন্তু বাঘ দয়া করে ওর জামা-কাপড়গুলো সম্পূর্ণ অক্ষত রাখল কেন? তোমরা কি তাহলে বানোয়াট কথা বলে আমাকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করছ? তখন তাঁর ছেলেরা কছম করে বলতে লাগল, হে পিতা! আপনি হয়ত সহজে আমাদেরকে বিশ্বাস করবে না। কিন্তু আমরা যা বলছি তাহা আদৌ মিথ্যা নয়। একথা শুনে হযরত ইয়াকুব (আঃ) বললেন, তোমাদের কথা যদি সত্য হয় তাহলে তোমারা জঙ্গলের কাছে গিয়ে আল্লাহ্র কছম দিয়ে সেই চিহ্নিত বাঘটিকে আমার নিকট আসতে বল। যদি তোমরা সত্যবাদী হও তবে অবশ্যই বাঘটি আমরা নিকট এসে সবিস্তার ঘটনা বলে যাবে।
ইয়াকুব (আঃ)-এর ছেলেরা পিতার কথা শুনে খুবই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হল। অতঃপর তাঁরা সকলে জঙ্গলের দিকে রওয়ানা করল। ছেলেদের প্রত্যেকেই দৈহিক দিক দিয়ে খুবই পরাক্রমশালী ছিল। ছোটবেলা থেকে তাঁরা ব্যায়ামে অভ্যস্ত ছিল, ভাল ভাল খাবার খেত। যাতে সকলেই খুব শক্তিশালী ছিল। বাঘ ধরা বা মারার সাহস তাঁদের ছিল। তাই একটা বাঘ ধরে পিতার নিকট হাজির করার উদ্দেশ্যে তাঁরা দূরবর্তী জঙ্গলে পৌছল। জঙ্গলের মধ্যে প্রবৃষ্ট হয়ে তাঁরা দেখল। এক পাহাড়ের পাদদেশে একটি বাঘ শুয়ে আছে , তখন তাঁরা বাঘের নিকটবর্তী হয়ে তাঁকে রশি দিয়ে বেঁধে ফেলল। বাঘটি তেমন ছুটোছুটি করল না। মনে হয় বাঘটি খুবই দুর্বল ছিল। ইয়াকুব (আঃ)-এর ছেলেরা বাঘটিকে বড় বাঁশে করে ঝুলিয়ে পিতার সম্মুখে এনে হাজির করল। পতিমধ্যে তাঁরা বাঘের মুখে কিছুটা রক্ত মাখিয়ে আনল, যেন সেটাকে দেখলে মনে হয়, পূর্বে সে যে কোন প্রাণী ভক্ষণ করেছে।
পিতার সম্মুখে বাঘটি এনে তাঁরা রাখল। পিতা ওর হাত পায়ের বাঁধন ছেড়ে দিতে আদেশ দিলেন। পিতার আদেশ অনুসারে ছেলেরা বাঘের সকল বন্ধন ছেড়ে দিল। বাঘটি সেখানে শুয়ে পড়ল। ইয়াকুব (আঃ) বাঘটিকে লক্ষ্য করে বললেন, “ হে বনের বাঘ আমি আল্লাহ্র নবী, আমি আল্লাহ্র কছম দিয়ে তোকে জিজ্ঞেস করছি।। তুই কি আমার প্রাণপ্রিয় সন্তান ইউসুফকে বধ করেছিস। আল্লাহ তায়ালার নির্দেশে তখন বাঘের জবান খুলে গেল এবং শান্তভাবে আরজ করল – “ হে আল্লাহ্র নবী, নবীদের রক্ত মাংস আমাদের জন্য হারাম। মানুষ হারাম খায়, মিথ্যা কথা বলে, আল্লাহ তায়ালার আদেশ লঙ্ঘন করে।
কিন্তু আমরা বনের পশুরা কোন দিন হারাম খাই না, মিথ্যা কথা বলি না বা আল্লাহ তায়ালার আদেশ লঙ্ঘন করি না। হে আল্লাহ্র নবী! আমি আল্লাহ্র কছম করে বলছি, তাঁকে বধ করি নাই বা তাঁর রক্ত মাংস ভক্ষণ করি নাই। আমি কয়েক দিন যাবত খুব পেরেশানী অবস্থায় দিন যাপন করছি। কারণ আমার এক ভাই কিছুদিন পূর্বে নিখোঁজ হয়েছে। আমি তাঁর খোঁজে সকল জঙ্গলে, পাহাড় তন্য তন্য করে ফিরছি। বিগত তিন দিন যাবত কোন খাদ্য খাদক খেতে পারিনি।
খুবই দুর্বল ও ক্লান্ত অবস্থায় এক পাহাড়ের পাদদেশে আমি ঘুমিয়ে ছিলাম। এমন সময় আপনার ছেলেরা আমাকে ধরে নিয়ে আসে। এমন কি পথিমধ্যে একটি ছাগল যবেহ করে তাঁর রক্ত আমার মুখে লাগিয়ে দেয়। আমি কোন বাদ প্রতিবাদ করিনি। হে আল্লাহ্র নবী! এখন আপনার যা মর্জি তা করুন। তাতে আমার কোন আপত্তি নেই।
হযরত ইয়াকুব (আঃ)- বাঘের মুখের জবান বন্দি শুনে তাঁকে ভালভাবে খাবার দিলেন এবং বললেন, বনের বাঘ! তোমার আবাস্থলে চলে যাও। অতঃপর ছেলেদেরকে লক্ষ্য করে বললেন, “ তোমরা তোমাদের উদ্দেশ্য সফল করেছ। আর আমার জন্য থাকল ধৈর্য ধরার ভাগ্য। আমি ইউসুফকে আল্লাহ তায়ালার জিম্মায় রেখে দিলাম। আর আমি নিজের জন্য আল্লাহ্র নিকট ধৈর্য ধারণ করার শক্তি কামনা করছি। এই বলে ছেলেদিগকে চলে যেতে বললেন।
হযরত ইয়াকুব (আঃ) ছেলেদের ষড়যন্ত্র সম্পূর্ণ উপলব্ধি করলেন। তবে ইউসুফ (আঃ)-কে হত্যা করা হয়েছে কিনা সে সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারেন নি। তাই তিনি ইউসুফ (আঃ) এর হেফাজতের জন্য আল্লাহ্র দরবারে দোয়া করলেন। আল্লাহ্র তায়ালার পক্ষ থেকে হযরত জিব্রাইল (আঃ) হযরত ইয়াকুব (আঃ)-কে ইউসুফ (আঃ) এর জীবিত থাকার খবর পৌঁছে দিলেন এবং পিতা-পুত্রের মিলন আপাতত সম্ভব নয় বলে তাঁকে জানিয়ে দিলেন।
হযরত ইয়াকুব (আঃ) হযরত ইউসুফ (আঃ)-এর বিচ্ছদ যাতনা সহ্য করতে পারলেন না। তিনি একটি শোকাগার নির্মাণ করলেন এবং সেখানে তিনি সর্বদা এবাদতে মগ্ন থাকতেন। তিনি ইউসুফ (আঃ)-এর বিরহে সারা জীবন কেঁদে কেঁদে চক্ষু দুটি সম্পূর্ণ অন্ধ করে ফেলেছিলেন।
সূত্রঃ কুরআনের শ্রেষ্ঠ কাহিনী