হযরত আবু বকর শিবলী (রঃ) – পর্ব ৬
হযরত আবু বকর শিবলী (রঃ) – পর্ব ৫ পড়তে এখানে ক্লিক করুন
মারেফাতে তাঁর জ্ঞান অভিজ্ঞতা বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে তিনি জনসমক্ষে ভাষণ দিতে থাকেন। প্রকাশ করেন হাকীকতের গুপ্ত রহস্য। হযরত জুনায়েদ (রঃ) বললেন, আমি যে বিষয় মাটির নিচে ঢেকে রেখেছি, তুমি তা মানুষের সামনে তুলে ধরছ? হযরত আবু বকর (রঃ) বললেন, আমি যা বুনছি, তা মানুষের বুদ্ধি-বিবেচনায় ঊর্ধ্বে। তবে আমার কথাগুলি আল্লাহ্র তরফ থেকে এসে যায়। আবার সেগুলি তারই দিকে ফিরে যায়। সুতরাং এর মধ্যে জুনায়েদ এবং আবু বকরের কোন স্থান নেই। হযরত জুনায়েদ (রঃ) বললেন, তোমার মুক্তি অস্বীকার করার উপায় নেই। তবুও বলি, এগুলি প্রকাশ করা শোভনীয় নয়। হযরত আবু বকর (রঃ) বললেন, যারা দ্বীন-দুনিয়ার প্রত্যাশী তাঁদের জন্য আমার ধর্মসভায় অংশগ্রহণ করা কোনক্রমেই উচিত নয়।
একবার এক সভায় বসে তিনি বার বার আল্লাহ্ আল্লাহ্ করছিলেন। এক দরবেশ আপত্তি জানিয়ে বললেন, আপনি ওভাবে আল্লাহ্ আল্লাহ্ না বলে কালেমা তাইয়্যেবা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বললেই ভালো হয়। তিনি তাঁকে ধমকের সুরে বললেন, তুমি কি বোঝ না, তাতে একটি ভয়ের ব্যাপার থাকে। যদি লা (নেই) শব্দটি বলার পর বাকী অংশ বলার সুযোগ না পাই, যদি বিদায়ের ডাক আসে, তা হল কেমন হবে? তাঁর কথা শুনে দরবেশের মনে যে প্রচণ্ড ভাব-তরঙ্গ সৃষ্টি হল, তার আঘাত তিনি সহ্য করতে পারলেন না। সঙ্গে সঙ্গে মারা গেলেন।
তার বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ আনা হল খলীফার দরবারে। তিনি তখনও প্রভু তন্ময়তার অবস্থায় ছিলেন। নিজের নির্দোষিতা প্রমাণ করতে বলা হলে তিনি বললেন, ঐ দরবেশের প্রাণ আল্লাহ্ প্রেমের প্রাবল্যে দেহ নির্গত হয়ে আল্লাহ্র স্থায়িত্বে বিলীন হবাব জন্য আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল। দুনিয়ার সঙ্গে তাঁর আত্মার কোন সম্পর্কই ছিল না। আমার কথা শোনার মতো ক্ষমতাও তাঁর ছিল না; বরং আল্লাহ্র সৌন্দর্যের বৈদ্যুতিক প্রভাব তাঁর আত্মারূপী মোরগ চোখের পলকে উড়ে গিয়েছে। সুতরাং এ ব্যাপারে আমার কোন দোষ নেই। হযরত আবু বকর (রঃ)-এর কথা শুনে খলীফা বললেন, একে এখনই দরবার থেকে বের করে দাও। কেননা, যদি আর কিছুক্ষণ এর কথা শুনি, তা হলে আমিও হয়ত জ্ঞান হারিয়ে ফেলব।
কেউ তাঁর কাছে তওবা করতে এলে তিনি তাঁকে তওবা করিয়ে মাঠে গিয়ে আল্লাহ্র ওপর নির্ভর করতে বলতেন। বলতেন, পাথেয় ও যানবাহন ছাড়াই হজ্জ করতে, তাতে নির্ভরতা ও সহিষ্ণুতা সৃষ্টি হবে। তবে ঐ দু’টি বস্তু আয়ত্তে হলে তিনি তাকে তাঁর কাছে আসতে বলতেন। কেননা, এখন তাঁর মধ্যে তাঁর সাহচর্য লাভের সামর্থ্য নেই। দরবারে নবাগতদের বলতেন, তোমরা পাথেয় ও রসদ ছাড়াই আমার সহচরদের সঙ্গে সফর করে এস। কেউ কেউ বলত, আপনি তো মানুষের ধ্বংস কামনা করেন। তিনি তা অস্বীকার করে বলতেন, কথাটা আল্লাহ্র মারেফাত।
অতএব এক্ষেত্রে তাঁরা যদি আমার সান্নিধ্য কামনা করে, তবে তা নিশ্চয় প্রতিমা পূজার তুল্য। এর চেয়ে উত্তম, তারা দরবেশের দরবারে না গিয়ে বরং পূর্বাবস্থায় বহাল থাকুক। তা এজন্য যে, তওহীদবাদী সংসারী বৈরাগ্যপ্রিয় সংসারত্যাগী থেকে বহু গুণে উত্তম, এজন্য আমার কাছে যারা আসে, তাদের আল্লাহ্র পথ বাতলে দিই। সে পথে গিয়ে যদি সে মৃত্যুও বরণ করে, তবুও সে সাফল্য বঞ্চিত হবে না। আল্লাহ্র পথে কেউ যদি ক্লেশ ও সহিঞ্চুতা অর্জন করতে পারে, তবে সে এমন মর্যাদা লাভ করে- যা দীর্ঘ দশ বছরের সাধনা দ্বারাও অর্জিত হয় না। তিনি বলেন, বাইরে চলার কালে যখন আমার দৃষ্টি মানুষের ওপরে পড়ে, তখন দেখি সৌভাগ্যবানদের কপালে সাঈদ ও হতভাগ্যদের কপালে শাকী শব্দটি আঁকা আছে।
সূত্রঃ তাযকিরাতুল আউলিয়া