
সোরাব ভাই ? সোরাব ভাই ?
মতির ডাকে ঘুম ভাঙল সোহরাবের। অল্প ঘুমের মানুষ সে। এক ডাকেই জেগে উঠলো। কিন্তু বিছানা ছাড়ল না। শরীরটা আর আগের মত নেই।
– সোরাব ভাই ? ও সোরাব ভাই ?
পুরোপুরি ঘুম ভেঙে গেছে সোহরাবের। জোয়ান বয়সের মত এখন আর লাফ দিয়ে উঠে বসতে পারে না। সময় লাগে। বয়সকালে ঘোড়ার মত তেজি ছিল সে। কাঠের চৌকিতে মট মট শব্দ করে উঠে বসে সোহরাব।
– খাড়া মতি, আইতাছি।
জগ থেকে এক গ্লাস পানি খায় সে। আজকে উত্তরের বিলে যাওয়ার কথা মতির সাথে। জাল বাছতে হবে। মানুষে কারেন্ট জাল পাতে ওদিকে। অনেক মাছ আটকা পরে। নিজেদের জালের মাছ ছাড়াও অন্যদেরও জাল বাছে ওরা। তাই এই ভোর রাতে যাওয়া। বারতি সাবধানতা। ভোরের আলো ফোটার আগে মাছগুলো তাজা তাজা হাটে নিতে হবে। তাজা মাছের দাম ভালো। সকাল বেলা ভালো দাম মেলে। কত বেলা হল? ভাবে সোহরাব। চোখে এখনো ঘুম ঘুম। ফযরের বেলাতেও তার ঘুম পায়? ভেবে অবাক হয় সে। হায়রে বয়স!
– সোরাব ভাই ? ও সোরাব ভাই ?
- আইতাছি কইলাম না! খাড়া!
মতি থেমে যায়। নতুন বিয়ে করেছে সে। অল্প বয়স – উত্তেজনা বেশি। এক সময় এ দিন তারও ছিল। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে সোহরাব। হাতে একটা বেতের ঝুড়ি আর মাছ মারার আট ফলার ট্যাঁটা নিয়ে কবাট খুলে বেরিয়ে এল সোহরাব। বাইরে অন্ধকার। কিন্তু পথ চলা যায়। এইবার কিছু টাকা পয়সা জমিয়ে একটা টর্চ লাইট কিনতে হবে। না হয় কোনদিন আবার সাপখোপে কামড়িয়ে বসে!
– বউডা ভালো নি তর, মতি?
আস্তে গলায় জানতে চায় সোহরাব।
– হ।
ফিসফিসিয়ে জবাব দিল মতি। পাছে কেউ শুনে ফেলে! আশেপাশে ঘর বাড়ি আছে। মাঝে মাঝে বাঁশঝাড়। এবড়ো থেবড়ো মাটির রাস্তা। উষ্টা খেল সোহরাব। খিস্তি করল সে। মতি হাঁটছে সাচ্ছন্দে। যেন উড়ে উড়ে যাচ্ছে। হায়রে বয়সকাল! ভাবে সোহরাব।
হঠাৎই এক বাড়ির আড়াল থেকে বেরিয়ে এল একটি কালো ছায়া। চারপায়ে হাঁটছে। দাড়িয়ে পড়েছে মতি। সোহরাবের সামনে। দাড়িয়ে পড়েছে সোহরাবও। অন্ধকারে চোখ জ্বলছে সে কালো ছায়ার। ওরা এক চুলও নড়ছে না। নিঃশ্বাস বন্ধ করে দাড়িয়ে আছে। আরও কিছুটা এগিয়ে আসে ছায়াটি। হাফ ছাড়ে সোহরাব। একটা কুকুর! হাড় জিরজিরে। ওদের থেকে হাত দশেক দূরে দাড়িয়ে পড়লো কুকুরটি। ডাকছে না। শুধু মুখ দিয়ে ঘড়ঘড় শব্দ বের হচ্ছে। গায়ে রোম ওঠা শব্দ। হঠাৎই যেভাবে এসেছিলো, সে ভাবেই পিছিয়ে গেলো। মিলিয়ে গেল বাড়ির ভিটার আড়ালে।
ওরা হাটতে শুরু করল আবার।
এবার আর কথা বলল না সোহরাব। বাড়তি সাবধানতা। কেউ চিনে ফেললে সমস্যা। কুকুরটি ঘেউ ঘেউ করলে বিপদ ছিল। করল না কেন? সোহরাব বুঝে উঠছে না! ভাবল হয় রোগে ধরেছে, না হয় তার মতই বুড়িয়ে যাচ্ছে।
হাটতে হাটতে গ্রামের শেষ মাথায় চলে এল ওরা। সামনে একটা খাল। তার উপরে ব্রিজ। মান্ধাতা আমলের লোহার ব্রিজ। কাঠের পাটাতন। ক্ষয়ে গেছে জায়গায় জায়গায়। ব্রিজের ওপারে একসারি তালগাছ। একটা পুরান ভিটাও আছে। কেউ থাকে না। তার মাঝ দিয়ে সরু মাটির রাস্তা। দু’ধারে আগাছা ঘাসে ভরা। বৃষ্টি হয়েছিল হয়ত। রাস্তা কাদা প্যাচপ্যাচে হয়ে আছে।
এই রাস্তা নিয়ে গ্রামে অনেক গল্প আছে। অশুভ সব গল্প। এইখানে নাকি উনারা থাকেন। নাম নিতে হয় না। উনাদের পথে পরলে নাকি খারাপ কিছু হয়। এরকম অনেক হয়েছে। একবার একজনকে পেয়েছিল গ্রামবাসী। মরা। কিন্তু তার মাথা থেকে কোমর অবধি ছিল মাটির নিচে গাথা। শুধু পা দুইটা উপরে। আর একবার পেয়েছিল একজনের গাই গরু। শুধু চার পা মাটির উপরে। গা শিরশির করা গল্প এগুলো। কিন্তু গল্প। হাসে সোহরাব। কত এলো গেলো এই রাস্তায়! আর সোহরাব এমন কাউকেই দেখে নাই যে নিজের চোখে ঘটনাগুলো দেখেছে। সবই শোনা গল্প।
অনেকদূর এগিয়ে গেছে মতি।
চিন্তা করতে করতে খেয়ালই করে নি সে।
– ঐ। খাড়া – আস্তে হাট ব্যাটা!
মতি দাড়ায় না। তালগাছগুলোর মাঝ দিয়ে সরসর করে হাটতে থাকে। দৌড়াচ্ছে যেন।
সোহরাব ভড়কে যায়।
মতির পায়ের দিকে তাকায় সে। গোল বাঁশের মত সে পা। কোন আঙ্গুল নেই! পায়ের পাতা বলে কিছু নেই! সোহরাব গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠে – খাড়া কইছি – ট্যাঁটা মারুম কইলাম!
দাড়িয়ে পরল মতি। ধীরে ধীরে ঘুরে দাড়ায় সে। শরীর কেপে উঠলো সোহরাবের। জ্ঞান হারাল না সে। বড় সাহসী মানুষ। ছুড়ে মারল হাতের ট্যাঁটা। এ আর যাই হোক – মতিনয়।
বাতাস খান খান করে হেসে উঠলো মতি। সোরাব ভাই ? সোরাব ভাই ?
পুবের আকাশে আলো।
– সোরাব ভাই ? ও সোরাব ভাই ?
– তোমার ভাই না একটু আগেই বাইরে গেলো তোমার লগে!
– কন কি? আমি তো আইলাম মাত্রই।
দরজা খুলে বেরিয়ে এল সোহরাবের স্ত্রী। মোমেনা। চোখে মুখে প্রশ্ন নিয়ে তাকিয়ে আছে মতির দিকে। সোহরাব কে পাওয়া গিয়েছিল। পুরাতন লোহার ব্রিজের সেই খানে। তালগাছগুলোর কাছে। খালের পাড়ে। মরা। মাথা থেকে কোমর অবধি খালের পাড়ে কাদায় গাথা। শুধু পা দুইটা বেরিয়ে ছিল।
মতি ভাই ? মতি ভাই ?
মতির টিনের ঘর। শীতের দিন। গলা পর্যন্ত দুইটা মোটা কাথা আর লেপ টেনে শুয়ে আছে। চোখে ঘুম নেই। গত কয়েক রাত ধরেই এমন হচ্ছে। পাশে তার ঘুমান দেড় বছরের ছেলে – আজিজুল, আর তার বউ। রাতে ঘুমাতে পারে না মতি।
– মতি ভাই ? মতি ভাই ?
মতির মাথার কাছ থেকে আধ হাত দূরে টিনের বেড়া। তার ঠিক ওপাশে দাড়িয়েই যেন ডাকছে তাঁকে। মাঘ মাসের শীতেও ঘেমে গেছে মতি। ঘাড় ঘুরিয়ে বউ – বাচ্চার দিকে তাকাল মতি। না, ওরা কিছু শুনতে পায় নি। পা টেনে লেপের নিচে গুটিয়ে আনে মতি। মুখ পর্যন্ত টেনে দেয় লেপ। আজিজুলকে জড়িয়ে ধরে সে। তার মাথার কাছের টিনের বেড়ায় খচখচ শব্দ। আবার ডেকে উঠে – মতি ভাই ? ও মতি ভাই ?
কয়েক রাত ধরে তিনবার ডেকেই চলে যায় সে। মতি সাড়া দেয় না।