‘সুঁইয়ের সূতোটা ছোটো রাখতে হয়’

টেইলার বলতে ইদানীং আমরা বুঝি যারা জামা কাপড় সেলাই করে তাদেরকে। এটি একটি সভ্য পেশা। সভ্যতার শুরু থেকেই এ পেশাটির গুরুত্ব ছিল, আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। টেইলার শব্দের বাংলা প্রতিরূপ হলো দর্জি। আগেকার দিনে এই দর্জিদেরকে খলিফাও বলা হতো। তবে ইসলামের পরিভাষায় খলিফা বলতে বোঝায় পৃথিবীর বুকে আল্লাহর প্রতিনিধিকে। বাংলাদেশে কিন্তু এখনো দর্জি অর্থে খলিফা শব্দটির প্রচলন আছে। তো খলিফা কিংবা দর্জি যাই বলা হোক না কেন সেলাই করাই ছিল তাদের কাজ। আজকাল তো বিভিন্ন ধরনের সেলাই মেশিনের সাহায্যে জামা কাপড় সেলাইয়ের কাজ হয়। প্যাডেল চেপে, বৈদ্যুতিক সেলাই মেশিনে কিংবা কম্পিউটারাইজড মেশিনে সেলাইয়ের কাজ হয়। বাংলাদেশের কোনো একটি গার্মেন্টে গেলেই দেখতে পাওয়া যাবে সেলাই কাজে কতো ধরনের মেশিন ব্যবহার করা হয়। কিন্তু আগেকার দিনে এসব মেশিন ছিল না। সে সময়কার দর্জিরা সুঁই সূতা দিয়ে হাতের সাহায্যে এফোঁড় ওফোঁড় করেই জামা কাপড় সেলাই করতো। তাই দ্রুত সেলাই করতে পারাটা সে সময়কার দর্জিদের একটা বড়ো গুণ হিসেবে বিবেচনা করা হতো।

এ রকমই একজন অভিজ্ঞ দর্জি বাস করতেন কোনো এক শহরে। শহর না বলে উপশহর বলাই ভালো। নাম হলো রামগঞ্জ। রামগঞ্জের এই অভিজ্ঞ দর্জির নাম ছিল কালাম। আশে পাশের সকল গ্রামে গঞ্জেই জামা কাপড় সেলাই করার জন্যে কালাম দর্জির ব্যাপক সুনাম সুখ্যাতি ছিল। যে-ই কালাম দর্জির কাছে একবার জামা কাপড় সেলাই করাতো সে-ই তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে যেত। এই ভালো সেলাই কাজের কারণে তাঁর দোকানে কাজের চাপটাও ছিল বেশি। এ কারণে একা সব কাজ করে উঠতে পারছিলেন না তিনি। সে কারণে কালাম দর্জি শহরের কিছু উৎসাহী ছেলেকে সেলাই কাজ শেখালো। তার শাগরেদরাও অল্প সময়ের মধ্যেই ভালো কাজ শিখে ফেললো।

ভালো ওস্তাদের শাগরেদও ভালো হয়। শাগরেদরা যথেষ্ট বিনয়ী এবং আন্তরিক ছিল। তবে এদের মাঝে একটি শাগরেদ ছিল বেশ চালাক চতুর। সে বহুদিন ধরে কালাম দর্জির সাথে কাজ করে অনেক কিছু শিখেছে। অন্যান্য শাগরেদরা এসেছে পরে। সে কারণে চতুর শাগরেদ কালাম দর্জির কাজের অনেক কলা কৌশল আয়ত্ত্ব করে নিতে পেরেছে। দর্জিকে তার ছাত্ররা ওস্তাদ বলে ডাকতো। চতুর শাগরেদটির কাজের সাথে ওস্তাদের কাজের খুব একটা পার্থক্য ছিল না। সেলাইয়ের সৌন্দর্য, ডিজাইন, ফিনিশিং ইত্যাদি সকল দিক থেকেই ওস্তাদের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল সে। তবে একটাই খালি সমস্যা ছিল তার। সেটা হলো কাজের গতি। অর্থাৎ ওস্তাদ যত তাড়াতাড়ি একটা জামা সেলাই করে ফেলতে পারতো, শাগরেদ ততো দ্রুত কিছুতেই জামাটি সেলাই করতে পারতো না, তার অনেক বেশি সময় লেগে যেত।

ওস্তাদ বড়ো জোর এক সপ্তার মধ্যে একজনের জামা কাপড় আরাম্‌সে সেলাই করে ফেলতো। কিন্তু শাগরেদ যতো চেষ্টাই করতো তার দু’ সপ্তার মতো সময় লেগে যেত। শাগরেদ তাই বহু চেষ্টা করতো ওস্তাদের এই দ্রুত কাজ করতে পারার রহস্যটা আবিষ্কার করতে। ওস্তাদ যখন কাজ করতো সে তখন গভীর মনোযোগের সাথে লক্ষ্য করতো ওস্তাদকে। ওস্তাদ কীভাবে কাপড় ধরে, কীভাবে সুঁইয়ে সূতা ঢোকায়, কীভাবে সেলাই করে ইত্যাদি সবকিছু সে দেখে। কিন্তু কোনো পার্থক্যই সে খুঁজে বের করতে পারতো না। অথচ ওস্তাদের কাজের গতির সাথে পেরে উঠতো না। এই রহস্যটা তার ভেতরে বদহজমের মতোই ঘুরে ফিরে ঢেকুর তুলতো। তার মন থেকে কিছুতেই বিষয়টা যেত না।

মনে মনে সে শপথ নিলো যে করেই হোক ওস্তাদের কাজের দ্রুত গতির গোপন রহস্যটা সে জানবেই। সুযোগ বুঝে সে একদিন ওস্তাদকে জিজ্ঞেস করে বসলোঃ
“ওস্তাদ! আমার কাজের ব্যাপারে আপনার মূল্যায়ন কী! আপনার পছন্দ হচ্ছে তো আমার কাজ?”
ওস্তাদ হাঁসিমুখে বললোঃ “তোমার কাজ তো বেশ সুন্দর। ভালোই সেলাই করো তুমি।”
শাগরেদ বললোঃ “কিন্তু ওস্তাদ! একটা বিষয় আমার বুঝে আসে না।”
ওস্তাদ বললেনঃ “কোন্‌ বিষয়টা?”
শাগরেদ বললোঃ “আমি বহু চেষ্টা করেছি কিন্তু তোমার মতো তাড়াতাড়ি সেলাই করতে পারি না। আমি কিন্তু অলসতাও করি না। চেষ্টা করি দ্রুত করার। কিন্তু কেন যে পারি না, সেটা সত্যিই আমার বুঝে আসে না। আমার বুঝে আসে না যে কাজটা আমি দু’ সপ্তা লাগিয়ে করি সেই কাজটা তুমি অনায়াসে এক সপ্তায় শেষ করে ফেল। এটা যে তুমি কী করে করো- আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে। তুমি যেটা পারো, আমি কেন পারি না। নিশ্চয়ই আমার কাজের কোথাও না কোথাও কোনো ত্রুটি আছে, যেই ত্রুটিটা তোমার কাজে নেই। এ জন্যে আমার খুউব জানতে ইচ্ছে করছে আমার কাজের ত্রুটিটা কোথায়। একটু বলবে?”

ওস্তাদ সম্মতি সূচক মাথা নেড়ে বললোঃ “আমার কাজের একটা গোপন রহস্য আছে, সে রহস্যের কথাটা আমি এক্ষুণি তোমাকে বলতে চাচ্ছি না।”
শাগরেদ বললোঃ “তুমি তো বলেছো আমার ওপরে এবং আমার কাজের ব্যাপারে তুমি সন্তুষ্ট। তাহলে আমার কাজের ত্রুটিটা কোথায় কিংবা তোমার কাজের রহস্যটা কী সেটা কেন বলতে চাচ্ছো না?”
ওস্তাদ কাস্টমারদের দেখিয়ে শাগরেদকে বললোঃ “এখন এ নিয়ে কথা বলার সময় নয়। দেখতে পাচ্ছো না কাস্টমাররা এসে বসে আছে! অনেক কাস্টমার। আমাদের এখন কাজের চাপ অনেক, ব্যস্ততাও অনেক। এখন রহস্যের গল্প বলার সময় নেই। তাছাড়া তোমার কাজের ব্যাপারে আমি সন্তুষ্ট আছি ঠিকই কিন্তু তোমার প্রতি আমার এখনো পরিপূর্ণ আস্থা নেই। আমি এই মুহূর্তে যদি তোমাকে দ্রুত কাজ করার গোপন রহস্যটা ফাঁস করে দিই, তুমি যে কালই আমার দোকানের সামনে নিজেই আরেকটা দোকান খুলে বসবে না তার কি কোনো নিশ্চয়তা আছে? নেই। তখন যেহেতু কাজের গোপন ভেদ বা রহস্যটাও তোমার জানা, আর আমার এখানে কাজ করার অভিজ্ঞতাও যেহেতু তোমার প্রচুর, সুতরাং আমার কাস্টমাররা স্বাভাবিকভাবেই তোমার দোকানে গিয়ে ভিড় জমাবে। আমি তখন কী করবো?”

শাগরেদ নাছোড়বান্দা। সে বললোঃ “তাহলে ওস্তাদ! আমাকে কবে গোপন রহস্যটার কথা বলতে চাও?”
ওস্তাদ বললোঃ “দেখি! যখনি আমি ভাববো তোমার ওপর আস্থা রাখা যায়, তখনি বলবো।”

এপরে বহু বছর কেটে গেল। শাগরেদ অপেক্ষা করতে লাগলো আর মনোযোগের সাথে কাজকর্ম করে ওস্তাদের আস্থা অর্জন করার চেষ্টা করতে লাগলো। অপেক্ষার পর অপেক্ষা- কখোন ওস্তাদ রহস্যের কথাটা তাকে বলবে। তার কিন্তু বিন্দুমাত্র চিন্তা ছিল না আরেকটা দোকান খোলার কিংবা ওস্তাদের রুটি রুজিতে ব্যাঘাত সৃষ্টি করার। তবে ইচ্ছে ছিল দ্রুত কাজ করতে পারার রহস্যটা জানার। সে জন্যেই মন দিল্‌ লাগিয়ে পরিপূর্ণ আন্তরিকতার সাথে কাজ করে ওস্তাদের আজ্ঞাভাজন এবং বিশ্বাসভাজন হবার চেষ্টায় ত্রুট করলো না। অবশেষে সে সফলও হলো।

একদিন ওস্তাদ অসুস্থ হয়ে পড়লো। ডাক্তাররা বললো ওস্তাদ ভীষণ বুড়ো হয়ে গেছে, বেশিদিন হয়তো না ও বাঁচতে পারে। জীবনের অন্তিম দিনগুলো কাটাচ্ছে সে এখন। এগুলো জানার পর ওস্তাদ একদিন তার সেই শাগরেদকে নিজের কাছে ডেকে আনলো। খোঁজখবর নেওয়ার পর বললোঃ “তুমি আমার শাগরেদ। আমার তো জীবন প্রায় শেষের দিকে। তুমি আমার সাথে দীর্ঘদিন কাজ করেছো। তোমার কাজে আমি খুবই খুশি। তুমি আমার কাছে একটা বিষয়ে জানতে চেয়েছিলে-দ্রুত সেলাই করতে পারার রহস্যটা কী? আমি তোমাকে কোনোদিন বলি নি। এখন ভাবছি মারা যাবার আগে ব্যাপারটা তোমাকে বলে যাই।”

শাগরেদ গভীর আগ্রহ এবং কৌতূহলের সাথে অপেক্ষা করছিল সেই রহস্যটা জানার জন্যে। কিন্তু রহস্যের যে কথাটা সে ওস্তাদের মুখ থেকে শুনলো সেটা তার কাছে একেবারেই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হলো না। একদম তার বিশ্বাসই হলো না যে দ্রুত কাজ করার রহস্যটা এতো সহজ হতে পারে বা আদৌ এটাই মূল রহস্য। ওস্তাদ তাকে বলেছিলঃ “তুমি যখন সুঁইতে সূতা লাগাও তখন লম্বা করে লাগাও, অথচ সূতা হওয়া চাই ছোট।”
শাগরেদ বললোঃ “তার মানে এটাই আসল রহস্য! অ্যাতো সোজা! সুঁইতে সূতা ছোটো করে লাগালেই কাজের গতি বেড়ে যাবে!”
ওস্তাদ বললোঃ “হ্যাঁ! ঠিক তাই। তুমি যে লম্বা সূতোটি সুঁইতে লাগাও, যতোবার তুমি কাপড়ে সুঁই ঢুকাও, এফোঁড় ওফোঁড় করো ততোবার তুমি লম্বা সূতাটিকে টেনে বের করে সেলাইটাকে মসৃণ করতে বাধ্য। আর তোমাকে তো হাজার বার এ কাজটি করতে হয়। এভাবে লম্বা সূতা টানতে তোমার অনেক সময় লেগে যায়। যদি তুমি সূতা ছোটো রাখতে তাহলে ঐ অতিরিক্ত সময়টা তোমার লাগতো না, তোমার সময় অনেক বেঁচে যেত।”

এরপর থেকে যখনই কেউ কোনো কাজের প্রান্তিক ঝামেলা কমিয়ে গতি বাড়াতে চায় কিংবা কারো সঙ্গী হতে চায় অথবা বাড়াবাড়ি থেকে বিরত থাকতে চায় তখনই বলেঃ “সেলাইয়ের সূতোটা ছোটোই রাখতে হয়।”

দেয়ালে পেরেকের ক্ষতচিহ্ন

‘মিস্ত্রীগিরি বানরের কাজ না’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *