সুস্থ থাকার জন্য মানসিক সুস্থতার গুরুত্ব অপরিসীম। আর মানসিক সুস্থতা নির্ভর করে অনেকগুলো সৎগুণাবলীর ওপর। সত্যবাদিতা হচ্ছে এমনই একটি গুণ। আর এ কারণেই ইসলামে চারিত্রিক গুণাবলীর মধ্যে সত্যবাদিতাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। মহাননবী (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের সত্য কথা বলা উচিত, কেননা সত্যবাদিতা অবশ্যই পুণ্যের দিকে পরিচালিত করে, আর নিশ্চয়ই পুণ্য জান্নাতের দিকে পরিচালিত করে।’ তিনি আরো বলেছেন, ‘সত্য হলো প্রশান্তির মাধ্যম এবং মিথ্যা হলো দুশ্চিন্তা বা ভয়ের উৎস।’
মিথ্যা কেবল দুশ্চিন্তার সৃষ্টিই করে না, মিথ্যাবাদীরা দুর্বল স্মৃতিশক্তির অধিকারীও হয়। তাই আমাদের সবাইকে মিথ্যা বলা বাদ দিয়ে সত্যবাদী হতে হবে। সত্যবাদিতা সম্পর্কে রংধনু আসরে খানিকটা আলোচনা করেছি। আমরা সবাই নিশ্চয়ই Truth is beauty and beauty is truth এ প্রবাদটির কথা শুনেছি। এর অর্থ হচ্ছে, সত্যই সুন্দর, সুন্দরই সত্য। সত্য-সুন্দর বলেই মানুষ সত্যবাদিতাকে পছন্দ করে মিথ্যাকে ঘৃণা করে।
আমাদের মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) ছিলেন সত্যবাদিতা ও আমানতদারীর মূর্ত প্রতীক। তাঁর চরম শত্রুরাও কখনও তাকে মিথ্যাবাদী বলে অপবাদ দিতে পারেনি। তিনি যখন মহান আল্লাহর নির্দেশে মানুষের কাছে ইসলাম ধর্ম ও তাওহীদের দাওয়াত দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন, তখন তিনি প্রথমে সাফা পর্বতের একটি উঁচু স্থানে দাঁড়িয়ে জনগণকে তাঁর কাছে আসার আহবান জানান।
এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে প্রথমেই তিনি জনগণের কাছে জানতে চাইলেন, “হে জনগণ! তোমরা কি এ পর্যন্ত আমাকে মিথ্যা বলতে শুনেছ?” আমি যদি এখন তোমাদের কাছে বলি শত্রুরা সকালে অথবা সন্ধ্যার সময় হঠাৎ করে তোমাদের ওপর হামলা শুরু করবে, তাহলে কি তোমরা আমার এ কথা বিশ্বাস করবে?” সবাই সমস্বরে জবাব দিয়েছিলঃ “হ্যাঁ, বিশ্বাস করবো! কারণ, আপনি জীবনে কখনও মিথ্যা বলেননি।”
মহানবী (সাঃ)’র জীবনের এই ঘটনা থেকে বোঝা যায়, মানুষের কাছে মহান আল্লাহর বাণী পৌঁছানোর ক্ষেত্রে তিনি সাহসিকতার পাশাপাশি সত্যবাদিতা ও সততা বজায় রেখেছেন। মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, যাঁরা নৈতিক বা চারিত্রিক দিক থেকে সাহসী, তাঁরা কখনও মিথ্যা, প্রবঞ্চনা ও প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে নিজ চরিত্রকে কলুষিত করেন না।
অন্যদিকে যাদের চিত্ত দূর্বল, অক্ষম বা যারা হতাশাগ্রস্ত ও ভীরু, তারাই মিথ্যার আশ্রয় নেন। ডক্টর এলেক্সিস কার্ল বলেছেন, “মিথ্যা বা প্রবঞ্চনা মানসিক উন্নতির পথে প্রধান বাধা। কারণ, মানুষের মন মিথ্যা ও দুর্নীতির মধ্যে কখনও বিকশিত হয় না।” মানুষের প্রকৃতি সত্য ও সত্যবাদিতাকেই পছন্দ করে। মানুষ যদি এই প্রাকৃতিক বা স্বভাবগত পথ থেকে বিচ্যুত না হয়, তাহলে সে অনেক উন্নত গুণাবলীর অধিকারী হয় এবং এভাবে কলুষতা ও পাপাচার থেকেও দূরে থাকতে পারে।
প্রকৃত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের অভাবে এবং কখনো বা অসুস্থ পরিবেশের প্রভাবে মানুষের ইতিবাচক গুণাবলী বিকশিত হতে পারে না। ফলে তার মধ্যে নেতিবাচক ও অপরাধমূলক স্বভাব বিকশিত হয়। সত্য কথার মতো সত্যবাদী মানুষও সমাজে সম্মান অর্জন করে। বিভিন্ন ঝগড়া বিবাদসহ আমাদের পারিবারিক, সামাজিক ও আচরণগত অনেক সংকটের মূল হয়ে থাকে মিথ্যার আশ্রয় নেয়া বা সততার অভাব এবং ব্যক্তিগত ও সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে পারস্পরিক অবিশ্বাস, তথা সত্য থেকে দূরে থাকা।
যে ব্যক্তি বন্ধুদের প্রতি বিশ্বস্ত এবং বন্ধুত্বের দাবীগুলো পূরণ করে, এবং সেইসাথে বন্ধুদের ভুলগুলো ক্ষমা করে দেয়, সে ব্যক্তি সংকটে বা বিপদের সময়ও সহানুভূতিপূর্ণ বা দয়ালু সাহায্যকারী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। আর এ ধরনের আন্তরিক বা সত্যিকারের সুসম্পর্কই সমাজের স্থিতিশীলতা বা স্থায়ীত্বকে রক্ষা করে। অন্যকথায়, মানুষের মধ্যে আন্তরিক সম্পর্ক এবং তাদের পারস্পরিক বিশ্বাসই সামাজিক সুস্থতা রক্ষার চাবিকাঠি।
সত্য কথা বা সততার সুফল সম্পর্কে বিশ্বনবী (সাঃ) বলেছেন, “সত্য হলো প্রশান্তির মাধ্যম এবং মিথ্যা হলো দুশ্চিন্তা বা ভয়ের উৎসমূল।”