প্রকৃতিতে চৈত্রের কাঠফাটা রোদ। এমন ভ্যাপসা গরমে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে আসে ফজলু। আজ বৃহস্পতিবার, তাই তাদের স্কুলও তাড়াতাড়ি ছুটি হয়েছে। কথায় আছে, বৃহস্পতিবার হাফ, শুক্রবার মাফ; শনিবার ওরে বাপরে বাপ! বৃহস্পতিবার স্কুল ছুটির পর ছেলেমেয়েরা জোরসে একটা চিৎকার জুড়ে দেয়। সে চিৎকারে গোটা স্কুল ঘর কেঁপে কেঁপে উঠে। আর চিৎকারের সাথে ছুটির স্লোগান দিতে থাকে। পড়ার টেবিলে বই রেখেই বড় দরজার সামনে এসে বসে ফজলু। দাওয়ায় বসে ফজলু বলে, -মা তুমি কোথায়? কি করছো? -এইতো আমি এখানে। রান্নাঘর থেকে জবাব দেন মা ছলিমা খাতুন। -মা আমাকে এক গ্লাস শরবত দিবা। -ছলিমা খাতুন এক গ্লাস শরবত বানিয়ে দেন ছেলেকে।
দুপুরের ভাত রাঁধছেন মা। মায়ের চুলগুলো মাথার চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। পরণে চকচকে খয়েরি শাড়ি। এবার ঈদে মাকে শাড়িটি কিনে দিয়েছেন বাবা। চুলোর আগুনে মায়ের মুখটি বারবার আলোকিত হয়ে উঠছে। তাদের রান্না ঘরের পিছনে একটা সজনে গাছ। মা আজ সজনে পাতা রান্না করছেন ডাল দিয়ে। সজনে শাক ফজলুর খুব প্রিয়। মা অনেক সময়ই তার পছন্দ মত তরি তরকারি রান্না করেন। এ বয়সের ছেলেরা শাক-সব্জি খেতে চায় না কিন্তু ফজলু সে রকম ছেলেই না; সে হয়েছে উল্টো। শাক-সব্জি না রাঁধলে তার যেন ভাতই পেটে যায় না। তাই তার মা ছলিমা খাতুন কলমির শাক, রাই শাক মাঝে মাঝে বনের আলু কচু রান্না করেন। ঘরের দক্ষিণ পাশে একটা লেবু গাছ। এবার গাছে অনেক ফলন হয়েছে। ফলের ভারে ডাল পড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। তাই মা একটা পুরনো বাঁশ দিয়ে ঠেস লাগিয়ে দিয়েছেন। গত বছর এমন দিনে গাছটি ফজলু বাজার থেকে এনে লাগিয়েছিল। একটুকুন ছেলের গাছের প্রতি এমন ভালবাসা দেখে মা মাঝে মাঝে অবাক হয়ে যান। বড় ঘরের দরজার দক্ষিণ পাশে একটা সজনে গাছ। গাছটি অনেক দিনের পুরনো। সেই ছোটবেলা থেকেই গাছটিকে দেখে আসছে ফজলু। মায়ের মুখে সজনে গাছটির গল্প শুনেছে ফজলু। তাদের নানার বাড়িতে ছিল বড় বড় দু’টো সজনে গাছ। মায়ের বিয়ের পর নানার বাড়ি থেকে একটা ডাল এনে মা লাগিয়েছেন। আজ নিয়ে গাছটির বয়স বিশ বছর। সজনে গাছ সাধারণত বেশিদিন বাঁচে না। গাছটির হতশ্রী চামড়া দেখলে বুঝা যায় গাছটির বয়স হয়েছে। সেই ছোটবেলা থেকেই গাছটিকে দেখে এসেছে ফজলু।
এক ধরণের একাকিতব আর গাম্ভীর্যতা নিয়ে এখানে এখনো দাঁড়িয়ে আছে গাছটি। দিনে দিনে অনেক ডালপালা গজিয়েছে গাছটির। তার উপর অনেক রঙ বেরঙের পাখি এসে বসে গাছটিতে। দোয়েল, চড়ুই, শ্যামা, ময়না, কোকিল এসে বসে গাছটিতে। তবে দু’টি টুনটুনি পাখি এসে বসে প্রতিদিন। বিশেষ করে দুপুরে। বসেই পাখি দু’টি চেঁচামেছি শুরু করে। গান গায়, খুনসুটি করে, মারামারি করে আবার একে অপরের সাথে কথাও বলে। পাখি দু’টি উল্লাস, আনন্দ, গান আর নৃত্যে মুখরিত করে রাখে পুরো বাড়ির পরিবেশটাকে। তবে মাঝে মাঝে পাখি দু’টি মুখ ঘোমড়া করে ভাব ধরে থাকে। মনে হয় তারা স্বামী-স্ত্রীই হবে। তাই অভিমান করে বেশি। ফজলু এক দৃষ্টে স্ত্রী পাখিটিকে দেখে। স্ত্রী পাখিটিরই বেশি অভিমান। একদিন ফজলু দেখলো, স্ত্রী পাখিটি চুপ করে বসে আছে গাছের ডালে। তখন পুরুষ পাখিটি ধীরে ধীরে পাখিটির কাছে যায়। সরি বলে, ভুল হয়ে গেছে বলে, আর করবো না বলে- স্ত্রী পাখিটির তবুও মান ভাঙে না। স্ত্রী পাখিটি তখন সরে পড়ে। আবার যায় আবার সরে পড়ে। এভাবে চলতে চলতে। এক সময় স্ত্রী পাখিটির পালকে ঠোঁট রেখে ক্ষমা চায় পুরুষ পাখিটি। টুনটুনি পাখি দু’টির এরকম মান অভিমান দেখে ফজলু আর তার ছোটবোন আফিয়া। পাখি দু’টির কার্যক্রম ফজলু আর তার ছোট বোন আফিয়াকে আলোড়িত করত। মাঝে মাঝে ভাই-বোন মিলে খুশিতে নেচে উঠত। পাখি দু’টি ডালে বসলেই ভাই-বোন পড়ালেখা বাদ দিয়ে চুপ করে পাখি দু’টিকে দেখত। অনেক সময় মা ছলিমা খাতুন বকা দিতেন তবুও তারা পাখি দু’টিকে নিয়েই মেতে থাকত। মা বলতেন, পাগল দু’টি ছেলে-মেয়ে হয়েছে আমার। পড়ালেখা দিয়ে শুধু পাখি আর পাখি। মায়ের কথার জবাব দেয় ছোট্টবোন আফিয়া।
মা তুমি শুধু শুধু আমাদেরকে বকা দিচ্ছ-জানো আমাদের প্রিয় নবী (সা.) পাখিকে খুব ভালবাসতেন। প্রকৃতিকে ভালবাসতেন। বিনা প্রয়োজনে গাছের পাতা ছিঁড়তে নিষেধ করেছেন। আফিয়ার এমন কথা শুনে মা চুপ হয়ে যেত। ছলিমা খাতুন তখন মুচকি হাসতেন। ফজলু দেখতো, মায়ের সেই হাসি থেকে যেন মুক্তোর জ্যোতি ঝরছে। মায়ের এমন বকাঝকা ফজলু আর আফিয়াকে পাখি দেখা থেকে কিছুতেই বিরত রাখতে পারতো না। আরেকদিনের ঘটনা। আজ সজনে গাছে একা একটি চড়ুই বসে আছে। পাখিটি জোরে জোরে ডাকছে। আর পাশের বনের দিকে উড়ে যাচ্ছে। মনে হয় সেই বনেই তারা বাসা করেছে। ফজলু আর আফিয়া আজও পাখি দেখার জন্য গাছের একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে। পাখিটি মনে হয় তাদের ভাই বোনকে কিছু একটা বলছে। প্রথম প্রথম তারা পাখির কথার তেমন গুরুতব দেয়নি। পাখিটি অনবরত চেঁচাচ্ছেই।
মনে হয় পাখিটি কোনো দুঃখ পেয়েছে কিংবা তার কোনো বিপদ হয়েছে। কোনো দিনতো পাখিটি এভাবে কাঁদে না। এ রকম করে না। পাখিটি আবারও একবার বনের দিকে যাচ্ছে আবার সজনে গাছের ডালের উপর বসছে। ফজলু তার ছোটবোন আফিয়াকে বলল, চলো আমরা বনের দিকে যাই। মনে হয় পাখিটির কোনো বিপদ হয়েছে। পাখিটিকে অনুসরণ করে বনের ভেতর গেল ফজলু আর আফিয়া। পাখিটির এমন কান্নার কারণ অনুসন্ধান করতে লাগল। খুঁজতে খুঁজতে তারা ডমুর গাছের সাথে ঝুলানো একটা ভাঙা বাসা দেখতে পেল। গাছের নিচে কয়েকটি ঝরা পালক পড়ে আছে। ভাঙা বাসাটি দেখে তাদের একথা বুঝতে বাকী রইল না যে রাতে দুষ্টু বিড়াল এসে তার সঙ্গিটিকে মেরে ফেলেছে। পাখিটির এমন কান্না আর চটপট দেখে ফজলু আর অফিয়ার চোখেও পানি চলে এল।