শীত উপহার

মুনিয়ার চঞ্চলতা যেন আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। সারাক্ষণ কেবল ভাইয়াকে জ্বালাতন করে। ‘ভাইয়া, এটা কী? ওটা কেনো হলো ভাইয়া? সেটা না হলে কী হতো?’ জবাব দিলে ভালো, আর না দিলে ভাইয়াকে তাচ্ছিল্য করে বলবে, ‘দূর! তুমি কিছুই জানো না ভাইয়া। এতো গবেট হলে কীভাবে বলো তো?’ মুরাদ নানাভাবে মুনিয়াকে বোঝাতে চেষ্টা করে। বলে, ‘এটা আমি কেন, কেউই বলতে পারবে না। এটা আসলেই এমন।’ কিন্তু তাতেও কোনো লাভ হবে না। একবার যেটা বলবে, সেটাতেই অটল মুনিয়া। এই তো, আজ রাতের ঘটনাটাই ধরা যাক। মুরাদ পড়াশোনায় মগ্ন। পাশের চেয়ারে বসে পড়ছিল মুনিয়া। হঠাৎ ডাকল, ‘এই ভাইয়া?’ মুরাদ বলল, ‘কিছু বলবে?’ ‘বলব বলেই তো ডাকছি। তুমি তো খেয়ালই করছো না।’ ‘আচ্ছা বলো।’ ‘বইকে মানুষ বই বলে কেনো ভাইয়া?’ মুরাদ পড়ে যায় মহা বেকায়দায়। এ কেমন প্রশ্ন হলো? কী জবাব দেবে এর ও? বলল, ‘মানে, ইয়ে…’ ‘বুঝেছি, তুমি পারবে না বলতে। আচ্ছা ঠিক আছে, এবার বলো তো ভাত কেনো ভাত হলো?’ মুনিয়াকে দেখে মনে হচ্ছে খুবই ভাবনায় পড়ে গেছে ও বিষয়গুলো নিয়ে। ভাত কেনো ভাত হলো এই বিষয়টা জানার উপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। মুরাদ একটা দীর্ঘশ্বাস চাপল। না, পিচ্চিটা আজ শান্তিতে পড়তে দেবে না। ইশ্, আম্মু যদি খেতে ডাকতেন! বলল, ‘শোনো মুনিয়া, এমন কিছু জিনিস থাকে যেগুলোর কোনো উত্তরই হয় না। ভাত কেনো ভাত হলোÑ এটাও তেমনি একটা বিষয়। বুঝেছো? এখন মন দিয়ে পড়ো।’ মুনিয়া মুখ ভেংচে বলল, ‘কিছুই তো বুঝলাম না! তার মানে বলো তুমি জানো না।’ ‘আচ্ছা বাবা বললাম আমি জানি না। এখন হলো তো?’ ‘হুঁহ্!’ শব্দ করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো মুনিয়া। তারপর চুপ হয়ে গেল। কিন্তু মুরাদ জানে এই চুপ থাকা বেশিক্ষণ স্থায়ী হবে না। একটু পরেই আরেকটা প্রশ্ন করে বসবে মুনিয়া। তাই মনে মনে প্রস্তুত হয়েই রইল। এরূপ ব্যাপার তো নিত্যদিনকার। তাই-ই হলো। একটু পরেই মুনিয়া আবার বলে উঠলো, ‘এই ভাইয়া, শোনো শোনো, একটা দারুণ কথা মনে পড়েছে।’ মুনিয়াকে বেশ উৎফুল্ল দেখাচ্ছে। মুরাদও অবাক। কী মনে পড়েছে ওর? আচ্ছা শোনাই যাক আগে। বলল, ‘বলো কী মনে পড়েছে তোমার।’ ‘তুমি রাগ করেছো ভাইয়া, তাই না?’ ‘না আপুমণি, আমি রাগ করিনি। আমি আমার ছোট্ট আপুমণির উপর কিছুতেই রাগ করতে পারি না।’ ‘সত্যিই তুমি রাগ করোনি?’ মুনিয়ার যেন বিশ্বাস হচ্ছে না। ‘হ্যাঁ, সত্যিই আমি তোমার উপর রাগ করিনি।’ সত্যি কথাই বলল মুরাদ। হেসে ফেলল মুনিয়া। বলল, ‘এই জন্যেই তো তুমি আমার ভাইয়া। মিষ্টি ভাইয়া! জানো ভাইয়া, আমি টীনাদের সবাইকে বলে দিয়েছি আমার ভাইয়া ওদের সবার ভাইয়াদের থেকে ভালো। অনেক ভালো। ঠিক বলেছি না ভাইয়া?’ ‘হ্যাঁ মুনিয়া আপুমণি, তুমি ঠিকই বলেছ।’ মুনিয়ার কথায় মুরাদ খুশি হয়ে উঠলো। আসলে ওরা দু’জন দু’জনকে খুব বেশি ভালোবাসে। তাইতো খুনসুটি লেগেই থাকে। অবশ্য দু’জনেই বিষয়টা বেশ উপভোগও করে থাকে। মুরাদ বলল, ‘এখন তোমার দারুণ কথাটা বলে ফেলো আপুমণি।’ মুনিয়া বলল, ‘বলব তো! তুমি কথাটা শুনে আবার মাইন্ড করবে নাতো?’ ‘এ মা! আপুমণি দেখি আবার মাইন্ড কাকে বলে তাও জেনে গেছে! না মুনিয়া আপুমণি, আমি মাইন্ড করবো না। এখন বলো।’ ‘ইয়ে, মানে ভাইয়া…’ ‘হ্যাঁ, কী?’ ‘ইয়ে মানে.. আজ না আমি টীনার সাথে ঝগড়া করেছি।’ ‘কেনো? ঝগড়া করেছো কেনো?’ ‘বারে! ও আমাকে অপমান করবে আর আমি ওকে ছেড়ে দেব?’ গাল ফুলিয়ে ফেলল মুনিয়া। মুরাদও অবাক। টীনা মুনিয়াকে অপমান করেছে? আকর্ষণ আরো বৃদ্ধি পেল শোনার। বলল, ‘টীনা তোমাকে অপমান করেছে? কী বলেছে ও তোমাকে?’ ‘ও বলেছে আমি নাকি হনুমানের ছোট বোন। আমার নাকটা দেখতে একেবারে পেতœীর মতো।’ এক্ষণে মুনিয়ার মুখ দেখে মনে হবে ও টীনাকে সামনে পেলে চুল ছেড়াছিড়ি শুরু করে দেবে। চেহারায় স্পষ্ট অসন্তুষ্টি ও রাগের ছাপ। ‘তাই বলেছে ও তোমাকে?’ মুরাদ সহানুভূতির সুরে জিজ্ঞেস করল। মুনিয়া প্রবলভাবে উপর-নীচ মাথা নাড়ে। মুরাদ সান্ত¡না দেয়ার ভঙ্গিতে বলল, ‘ঠিক আছে, আমি কাল ওকে আচ্ছা করে বকে দেব।’ ‘..না ভাইয়া, ও আরো কী বলেছে শোনো আগে। ও বলেছে, আমি নাকি ঝগড়াটে। কেবল ঝগড়া বাধানোর তালে থাকি। বল ভাইয়া, ও কি ঠিক বলেছে? আমি কি শুধু ঝগড়া বাধাই? আমি কি হনুমানের ছোট বোন? আর আমার নাক? এটা কি পেতœীর মতো?’ হাত দিয়ে নিজের নাক দেখাল। কেঁদে দেবে বুঝি মুনিয়া। অভিমানে ফুলে ফুলে উঠছে ঠোঁট দু’টো। সেই সাথে ফুলে উঠছে গাল দু’টোও। মুরাদ বুঝল ভাব খারাপ। টীনা তাহলে ভালোভাবেই ক্ষেপিয়ে তুলেছে মুনিয়াকে। বলল, ‘ও ঠিক বলেনি আপুমণি। তোমার মতো ভালো মেয়ে এই অঞ্চলে আর আছে নাকি? ও জানে না তাই বলেছে এসব। তুমিও ওকে বলতে পারতে যে, ও তো রাজকন্যার মতো দেখতে। ওর চোখটা খুব সুন্দর। আর ওর কণ্ঠ? সে তো কোকিলের কণ্ঠকেও হার মানাবে! কী সুন্দর ওর চুলের বেনীটা!’ এই কথায় মুনিয়া যারপরনাই অবাক হলো। দু’সেকেন্ড কোনো কথাই বলতে পারল না। শেষে বলল, ‘ও আমাকে অপমান করবে আর আমি ওকে ভালো ভালো কথা বলব? তা কী করে হয়?’ ‘এটাই করতে হয় মুনিয়া। তুমি যদি এগুলো বলতে, তাহলে দেখতে ও তোমাকে ‘নাইস’ মেয়ে বলত। তোমার সাথে আর ঝগড়া বাধানোর তালে না থেকে তোমার সাথে হেসে হেসে কথা বলত। তোমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু হয়ে যেতো। সবসময় তোমার পক্ষ নিয়ে কথা বলত।’ ‘তুমি সত্যি বলছ ভাইয়া?’ ‘হ্যাঁ, আমি সত্যি বলছি। আমি কি আমার প্রিয় বোনটিকে মিথ্যে বলতে পারি?’ ‘তার মানে কেউ আমাকে পেত্নী বলল, তারপরও আমি তাকে ভালো বলব? বকব না? তার সাথে ঝগড়াও করব না?’ ‘হ্যাঁ, তাকে ভালো বলবে, বকবে না এবং তার সাথে ঝগড়াও করবে না।’ ‘তুমি আমার সাথে জোক করছ, তাই না ভাইয়া? হেসে ফেলল মুরাদ, ‘না, আপুমণি, আমি তোমার সাথে জোক করছি না। যা সত্যি তাই বলছি। এটাই নিয়ম। আমাদের প্রিয় নবীও তাই বলে গেছেন।’ ‘আমাদের নবী এই কথা বলে গেছেন?’ ‘হ্যাঁ, তিনি আরো অনেক ভালো ভালো কথা বলে গেছেন। জানো, তিনি ছোটদের অনেক বেশি ভালোবাসতেন। ছোট-বড় সবাইকে সবার আগে সালাম দিতেন।’ ‘বলো না ভাইয়া তিনি আর কী কী বলে গেছেন?’ ‘অন্য একদিন বলব সেসব। এখন শোনো, কালই তুমি টীনার কাছে গিয়ে ক্ষমা চাইবে। বলবে, তোমার ভুল হয়ে গেছে। আর কখনও তার সাথে ঝগড়া করবে না। কি, পারবে না বলতে?’ মুনিয়া মুখে কিছু না বলে মুখ নিচু করে রেখে উপর-নীচ মাথা ঝাঁকাল। অর্থাৎ পারবে। কিছুক্ষণ নীরবে কাটল। নীরবতা ভাঙলো মুনিয়াই। বলল, ‘ভাইয়া, এখন তো শীতকাল। আমার তো তিনটা সোয়েটার আছে। আব্বু বলেছেন এবার আরো একটা কিনে দেবেন। কিন্তু জানো ভাইয়া, গত শীতে না নাদিয়ার কোনো শীতের পোশাক ছিল না। সারা শীতকালটা ও খুব কষ্টে কাটিয়েছে। ওর মনটাও তাই খুব খারাপ ছিল। এবারও বোধহয় কোনো শীতের পোশাক নেই ওর। বিকেলে খেলতেও আসেনি আমাদের সাথে।’ মুরাদ একটু অবাক হলো। বুঝতে পারল না মুনিয়ার হঠাৎ এই কথার কারণ। বলল, ‘সেটা তো খুবই খারাপ কথা!’ ‘ভাইয়া, একটা কথা বললে তুমি রাগ করবে না তো?’ বেশ ভয়ে ভয়েই জিজ্ঞেস করল মুনিয়া। ‘আমি কি আমার আপুমণির উপর কখনও রাগ করতে পারি? নির্ভয়ে বলতে পারো তোমার কথা।’ ‘আমি না ঠিক করেছি এবার একসেট শীতের পোশাক নাদিয়াকে দিয়ে দেব।’ একদমেই হরহর করে কথাটা বলে ফেলল মুনিয়া। কিছুক্ষণ থমকালো মুরাদ। আনন্দে ওর বুকের মধ্যে কুলুকুলু ঢেউ বয়ে যাচ্ছে। ও অবশ্য আন্দাজ করেছিল মুনিয়া এমনই কিছু একটা বলবে। শেষে বলল, ‘এটা তো খুবই ভালো কথা। তুমি তোমার বন্ধুকে সহযোগিতা করবে, এটা অনেক সওয়াবের কাজও।’ ‘কিন্তু ভাইয়া, আব্বু-আম্মু যদি …’ ‘আরে না, আমাদের আব্বু-আম্মু সে রকম না। তারা কিছুই বলবেন না।’ ‘আচ্ছা ভাইয়া, নাদিয়াদের দুঃখ কি কোনোদিন শেষ হবে না?’ প্রশ্নটা বেশ কঠিন মনে হলো মুরাদের কাছে। কী জবাব দেবে এর? কিন্তু কিছু তো একটা বলতে হবে। নইলে মুনিয়ার মনে এই নিয়ে একটা চিন্তার ক্ষেত্র তৈরি হবে। ক্রমে সেটা প্রসারিত হতে থাকবে। আর মুরাদ তো তার আদরের বোনটিকে সঠিকভাবে গড়ে তুলতে চায়। কোনো প্রকার নেতিবাচক প্রভাব তার মনে পড়তে দিতে চায় না। এসব ভেবে শেষে বলল, ‘অবশ্যই শেষে হবে। তুমি আল্লাহর কাছে ওদের জন্য দোয়া করো, দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে।’ ‘হ্যাঁ ভাইয়া, আমি ওদের জন্য দোয়া করব। প্রাণ খুলে দোয়া করব। আল্লাহ নিশ্চয়ই আমার দোয়া শুনবেন। আম্মু বলেছেন মন দিয়ে আল্লাহর কাছে কিছু চাইলে আল্লাহ তা অবশ্যই দেন।’ ‘বাহ্ আপুমণি, তুমি তো অনেক কিছু জেনে গেছ দেখছি।’ ‘দূর! তোমার চেয়ে বেশি আমি জানি নাকি? তুমি কত সুন্দর সুন্দর কথা বলো। আমি তো তোমার কাছ থেকেই শেখার চেষ্টা করছি।’ ‘আমার মিষ্টি আপুমণি!’ ‘কিন্তু…’ কথা থেমে যায় মুনিয়ার। তাকিয়ে থাকে দরোজার দিকে। মুনিয়ার দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকাল মুরাদও। আব্বু ও আম্মু কখন এসে দাঁড়িয়েছেন তা ওরা কেউই খেয়াল করেনি। বলল, ‘আব্বু-আম্মু, তোমরা…?’ আব্বু বললেন, মুচকি হেসে, ‘তোমাদের সব কথাই আমরা শুনেছি।’ মুরাদ বলল ভয়ে ভয়ে, ‘আমরা আসলে আব্বু…’ ‘থাক, তোমাকে কিছু বলতে হবে না। আমরা কিছু মনে করিনি। তোমরা ভালো বিষয় নিয়েই কথা বলছিলে। সেজন্য ধন্যবাদ তোমাদের। তবে…’ মুনিয়া আব্বুর কথার মধ্যে বলে উঠলো, ‘আসলেআব্বু, আমিই ভাইয়াকে…’ আব্বুও তাকে বাধা দিয়ে বললেন, ‘তোমাদের আলোচনার বিষয়টা ভালো। তবে পড়ার সময় এসব বিষয়ে আলোচনা না করাই ভালো। অন্য সময়, বিশেষ করে অবসর সময়ে আলোচনা করাই শ্রেয়। তারপরেও আমরা কিছু মনে করিনি।’ সমর্থনের আশায় স্ত্রীর দিকে তাকালেন। তিনিও মাথা নেড়ে সায় দিলেন। বললেন, ‘হ্যাঁ, আমরা কিছু মনে করিনি। এখন এসো তো, খাবার ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। ভুনা খিচুরি আর ইলিশ ভাজা আবার ঠাণ্ডা হয়ে গেলে ভালো লাগবে না।’ ভুনা খিচুরি মুরাদ ও মুনিয়া দু’জনেরই প্রিয়। তাই খলবল করে দু’জনেই প্রায় একসাথে বলে উঠল, ‘ভুনা খিচুরি! ইলিশ ভাজা! চলো চলো।’ আব্বু-আম্মুর পাশ ঘেষে বেরিয়ে গেল দু’ভাই-বোন। মাথা নেড়ে হাসতে হাসতে তাদের পিছু নিলেন আব্বু-আম্মুও। ঠিক সেই মুহূর্তে আরশের দিকে উড়ে যেতে লাগল দু’টি সাদা পায়রা। খুশির বার্তাটা আরশের মালিকের কাছে পৌঁছে দিতে ব্যস্ততা তাদের মধ্যে স্পষ্ট। খুশির একটা আভা যেন চারদিকে ঝরে ঝরে পড়তে লাগল। এই প্রচণ্ড শীতের রাতেও মনটা ভীষণ হালকা অনুভূত হতে লাগল মুনিয়া ও মুরাদের আব্বু-আম্মুর। ছেলেমেয়ে দু’টোকে তাদের মনে হলো এই শীতে আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের জন্য সেরা উপহার। —-জুবায়ের হুসাইন

অদ্ভূত সম্পর্ক !

দেবতার নেশা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *