লোভের পরিণতি

বন্ধুরা, আশাকরি সুস্থ দেহ আর সুন্দর মন নিয়ে তোমরা সবাই ভালোভাবেই পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছো। তোমরা সবাই এ কথাটা স্বীকার করবে যে, কেবল শারীরিকভাবে সুস্থ থাকলেই কাউকে পুরোপুরি সুস্থ বলা যায় না। তাই সুস্থ থাকার প্রয়োজনেই এসব বদগুণ থেকে বিরত থাকার জন্য সবাইকে চেষ্টা চালাতে হবে।

মানব চরিত্রের খারাপ গুণগুলোর মধ্যে লোভ-লালসা একটি মারাত্মক গুণ। মূলত লোভের কারণেই মানুষ মিথ্যা বলে, বিশ্বাসঘাতকতা করে, ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হয়; এমনকি ওয়াদার খেলাপ করে।

বন্ধুরা, তোমরা নিশ্চয়ই ‘লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু’ এই প্রবাদটি শুনেছ। এই প্রবাদটি মধ্যেই কিন্তু লোভের ফল ও এর পরিণতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তারপরও অনেক মানুষ লোভ-লালসার কাছে নিজেকে বন্দি করে ফেলে। একজন লোভী ব্যক্তি সমাজের জন্য দুঃখ-কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কেননা লোভী ব্যক্তিরা তাদের লোভের পথে পা বাড়াতে গিয়ে অন্যের ধনসম্পদ অবৈধভাবে দখল করে থাকে। আর এ কারণেই রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, তোমরা লোভ থেকে বিরত থাকো, কারণ তোমাদের পূর্ববর্তীদের অনেকেই লোভের কারণে ধ্বংস হয়েছে।

লোভ থেকেই যে দুঃখ-কষ্টের সৃষ্টি হয় সে সম্পর্কে আমিরুল মোমেনীন হযরত আলী (আ.) বলেছেন, লোভ পরিহার কর। কেননা লোভী ব্যক্তি অপমানের হাতে বন্দী। তার এ বন্দীদশা কখনও শেষ হবে না। তিনি আরো বলেন, লোভ আত্মাকে অপবিত্র করে, ধর্মকে দুর্নীতিগ্রস্ত করে এবং যৌবনকে ধ্বংস করে।

বন্ধুরা, লোভের পরিণতি সম্পর্কে মূল্যবান কিছু কথা জানতে। এ সম্পর্কেই আমরা একটি গল্প প্রচার করেছি। তাহলে প্রথমেই গল্পটি শোনা যাক।

লোভের পরিণতি
অনেক অনেক দিন আগের কথা। এক গাঁয়ের একটি ভাঙা কুটিরে বাস করত এক বুড়ো আর এক বুড়ি। কুটিরের পেছনেই ছিল একটি পাহাড় আর পাহাড়ের পরই ছিল একটি অথৈ নীল সাগর। বুড়ো প্রতিদিনই জাল নিয়ে নীল সাগরে মাছ ধরতে যেত। হাটে মাছ বিক্রি করেই বুড়োবুড়ির সংসার কোনোমতে চলে যেত।

একদিনের ঘটনা। ভোরবেলায় বুড়ো তীরে দাঁড়িয়ে সাগরে জাল ফেলল। কিছুক্ষণ পর জাল বেশ ভারি মনে হল। বুড়ো মনে মনে ভাবতে লাগল-আশ্চর্য! এরকম তো এর আগে কখনও হয়নি! জালে বড়সড় মাছ আটকালো নাকি! জাল এত ভারি ছিল যে টেনে তোলাই যাচ্ছে না। যাহোক, বহু কষ্টে জাল টেনে তুলল বুড়ো। জালে একটি সোনালি রঙের ছোট মাছ ছটফট করছে। আর কোনো মাছ না থাকায় বুড়ো দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

এ সময় বুড়োকে অবাক করে দিয়ে মাছটি কথা বলে উঠল! মিনতি করে মাছ বলল,
মাছ: দাদু, ও বুড়ো দাদু। আমাকে না ধরে নীল সাগরে ফেলে দাও না! আমি কথা দিচ্ছি, তোমার সব ইচ্ছে পূরণ করব।

জেলে বুড়োটা ছিল খুব ভালোমানুষ। মাছের কথায় তার মনে দয়া হলো। সে বলল:
বুড়ো: আমি কিছু চাইনে বাপু। তোমায় আমি ছেড়ে দিলাম। তুমি মনের সুখে নীল সাগরে সাঁতার কাটো গে যাও।
এই বলে বুড়ো ছোট্ট সোনালি মাছটিকে নীল সাগরে ছেড়ে দিল। এরপর জাল গুটিয়ে বাড়ি ফিরে এল।

বুড়োকে খালি হাতে ফিরতে দেখেই বুড়ি খেঁকিয়ে উঠল। বলল- আজ ক’টা মাছ পেলে শুনি?
বুড়ো: না রে। আজ মাছ-টাস কিছু পাইনি।
বুড়ি: মাছ পাওনি মানে! এটা কেমন কথা! তাহলে কি আজ না-খেয়ে থাকতে হবে?
বুড়ো: মাছ একদম যে পাইনি সে কথা ঠিক না। আজ জালে একটা ছোট সোনালি মাছ উঠেছিল। ছেড়ে দিয়েছি।
বুড়ি: ছেড়ে দিয়েছ!
বুড়ো: হ্যাঁ ছেড়ে দিলাম। ওইটুকুন মাছ। বেচে কয় টাকাইবা পাব।

বুড়ি এবার কান্না থামিয়ে বুড়োর দিকে কঠোর দৃষ্টিতে তাকাল। অবস্থা বেগতিক দেখে বুড়ো আসল কথা খুলে বলল:
বুড়ো: আজ কি কাণ্ড হয়েছে জানো? যে মাছটি ধরেছিলাম সেটি মানুষের মত কথা বলতে পারে! কাকতি-মিনতি করে বলল, আমাকে সাগরে যেতে দাও। আমি তোমাকে সাহায্য করব। তোমার যা ইচ্ছা তাই পূরণ করে দেব।

বুড়োর কথা শুনে বুড়ি রেগে উঠল। চেঁচিয়ে বলতে লাগল,
বুড়ি: মাছটি তোমার ইচ্ছে পূরণ করার কথা বলল তারপরও তুমি কিছুই চাইলে না! তুমি কি জানো না, ঘরে রুটি নেই? কয়েকটা রুটি অন্তত চাইতে পারতে!
এই বলেই বুড়ি রাগে-দুঃখে কাঁদতে লাগল।

বুড়ির গজগজানি বুড়োর সহ্য হল না। তাই সে আবার নীল সাগরের দিকে যেতে লাগল। সাগর তীরে পৌঁছার পর বুড়ো চিৎকার করে বলল,
বুড়ো: মাছ, ও সোনালী মাছ। তোমার সাথে আমার কিছু জরুরি কথা আছে। আমার দিকে মুখ করে লেজের ওপর ভর দিকে একটু দাঁড়াও না।

বুড়োর ডাক শুনে সোনালি মাছটি সাঁতরে তীরে এল। তারপর জিজ্ঞেস করল,
মাছ: কি হল বুড়ো? তুমি আমায় ডাকছ কেন?
বুড়ো: তুমি তখন আমায় বললে না যে তুমি আমার ইচ্ছে পূরণ করবে!
মাছ: হ্যাঁ। বলেছি তো। তা,তুমি কি পেতে চাও?
বুড়ো: আমার আসলে চাওয়ার কিছু নেই। তবে তোমার কাছে কিছু চাইনি বলে আমার বউ আমার উপর ভীষণ ক্ষেপেছে।
মাছ: বুঝতে পেরেছি তোমার মনের অবস্থা। এবার ঝটপট বলে ফেল-তুমি আমার কাছে কি চাও?
বুড়ো: আমার ঘরে রুটি নেই। তুমি কি আমাকে ক’টা রুটি দিতে পারবে?
মাছ: ও, এই কথা। ঠিক আছে আল্লাহর কাছে দোয়া করতে করতে ঘরে যাও। দেখবে ঘরে রুটি পৌঁছে গেছে।

বুড়ো আর কথা না বাড়িয়ে দোয়া করতে করতে ঘরে এল। বুড়িকে জিজ্ঞেস করল,
বুড়ো: ঘরে কি কোনো রুটি পেয়েছে?
বুড়ি: হ্যাঁ, ঘরে অনেক রুটি পেয়েছি। কিন্তু আমাদের কাপড় ধোয়ার পাত্রটা ভেঙে গেছে। তুমি আবার মাছের কাছে যাও। নতুন একটা কাপড় ধোয়ার পাত্র নিয়ে এসো।

কী আর করা! কাপড় ধোয়ার পাত্র চাইতে বুড়ো আবার গেল নীল সাগরের পাড়ে। আগের মতই চিৎকার করে বলল,
বুড়ো: ওহে সোনালি মাছ, তুমি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছ? যদি শুনতে পাও তাহলে আমার দিকে মুখ করে লেজের ওপর আরেকবার দাঁড়াও না!

বুড়োর ডাক শুনে সোনালি মাছটি সাঁতরে সৈকতে এল। তারপর জিজ্ঞেস করল,
মাছ: আবার কি হল বুড়ো?
বুড়ো: তোমার কাছে সাহায্য চাইতে এসেছি। আমাদের কাপড় ধোয়ার পাত্রটি ভেঙে গেছে। তুমি কি নতুন একটা পাত্র দিতে পারবে?
মাছ: কাপড় ধোয়ার পাত্র? অবশ্যই পাবে। আগে ঘরে যাও। তারপর প্রার্থনা কর।

বুড়ো ঘরে ফিরে এল। ঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই বুড়ি চেঁচিয়ে বলল,
বুড়ি: কাপড় ধোয়ার পাত্র পেলেই কি চলে? এরকম ভাঙা ঘরে আর কতদিন থাকব? তুমি এক্ষুনি মাছের কাছে যাও। নতুন বাড়ি চাও। নতুন বাড়ি না দিলে আমার দু’চোখ যে দিকে যায় আমি সে দিকেই চলে যাব।

বুড়ির চিল্লিচিল্লি বুড়োর সহ্য হল না। নতুন বাড়ি চাইতে নীল সাগরের পাড়ে এল বুড়ো। তাকে দেখে সোনালি মাছটি সাঁতরে সাগর পাড়ে এল। তারপর জিজ্ঞেস করল,
মাছ: এবার কি হল বুড়ো?
বুড়ো: আমার বউ একটা নতুন বাড়ির আব্দার করেছে। নতুন বাড়ি না পেলে যে দিকে দু’চোখ যায় চলে যাবে বলে হুমকি দিয়েছে।
মাছ: ঠিক আছে। তুমি এখন ঘরে ফিরে যাও। তারপর প্রার্থনা কর। একটা নতুন বাড়ি তুমি ঠিকই পাবে।

বাড়ির দিকে যেতে লাগল বুড়ো। বাড়ি কাছাকাছি এসে বুড়ো অবাক হয়ে গেল। ভাঙা কুঁড়ের জায়গার সুন্দর একখানি বাড়ি। একেবারে নতুন। বাদামি রঙের দরজা। সবুজ রঙের জানালা। জানালার ওপরে সবুজ আঙুর লতা ছড়ানো। ছাদে একটা টিনের তৈরি লাল রঙের মোরগ। বাতাসে ঘুরছে।

বুড়োকে দেখেই বুড়ি দৌড়ে এল। বলল,
বুড়ি: শুধু ভালো বাড়ি হলেই কি সুখ হবে? গাঁয়ের লোকেরা আমাকে পাত্তা দেবে ভেবেছ?

বুড়ো: এত সুন্দর বাড়ি পাওয়ার পরও তোমার লোভ কমল না? আর কি চাও তুমি?
বুড়ি: আমি কি চাই সেটা কি তোমায় মুখে বলে দিতে হবে?
বুড়ো: আহা রাগ করছ কেন? বলই না। না-বললে বুঝব কেমন করে তুমি কি চাও?
বুড়ি: আমি এ রাজ্যের রানী হতে চাই। তুমি মাছকে গিয়ে বল।

বুড়ি এ অন্যায় আব্দার শুনে বুড়ো অবাক হয়ে গেল। কিন্তু উপায় নেই। একরাশ বিরক্তি নিয়ে বুড়ো আবার গেল নীল সাগরের পাড়ে। সোনালি মাছকে তার স্ত্রীর ইচ্ছার কথা বলার পর মাছটি বলল:
মাছ: ঠিকাছে তোমার বউয়ের এ ইচ্ছেটাও পূরণ হবে। তবে এর পর আর কোনো আব্দার নিয়ে আসবে না।

বুড়ো গাঁয়ে ফিরে এল। বাড়ির কাছে এসেই তাজ্জব বনে গেল। পুরনো বাড়ির জায়গায় বিশাল একটি রাজপ্রাসাদ। প্রাসাদের সামনে লোহার তৈরি ফটক। একদল সৈন্য ফটকের সামনে কাঁধে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে। প্রাসাদের পেছনে একটি মনোরম বাগান। প্রাসাদের সামনে বিশাল একটা মাঠ। সেখানে সৈন্যরা সারিবদ্ধ হয়ে কুচকাওয়াজ করছে। বুড়ির পরণে রানীর পোশাক। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে সৈন্যদের সালাম গ্রহণ করছে।

বুড়ো রানীর কাছে যেতেই সৈন্যরা তাকে ঘাড় ধরে সেখান থেকে সরিয়ে দিল। বুড়োর আফসোসের সীমা রইল না। অন্যদিকে আরাম-আয়েশে কাটলে লাগল বুড়ির দিনরাত। কয়েক মাস এভাবে কাটার পর বুড়ি একদিন সেনাপতিকে নির্দেশ দিল,
বুড়ি: যেখান থেকেই পার বুড়োটাকে খুঁজে বের কর। আর তাকে বল- নীল সাগরের রানী হতে চাই। আমি চাই সাগরের সব মাছ যে আমার কথামত চলে।

হুকুম পেয়ে সেনাপতি বুড়োকে খুঁজে বের করল। তারপর রানীর মনের আকাঙ্ক্ষার কথা বলল। বুড়ো নিরুপায় হয়ে আবার গেল নীল সাগরে। চিৎকার করে ডাকার পরও মাছটি আর এল না। বুড়ো বেশ হতাশ হয়ে পড়ল।

কিছুক্ষণ পর বুড়ো দেখতে পেল সোনালি মাছ মাথা উঁচু করে ভেসে উঠেছে। বুড়োকে উদ্দেশ করে মাছ বলল,
মাছ: এবার কি চাইতে এসেছ?
বুড়ো কাঁপতে কাঁপতে বলল,
বুড়ো: আমার বুড়ি মনে হয় পাগল হয়ে গেছে। সে এখন সাগরের রানী হতে চায়। তুমি কি তার আব্দার রাখবে?

বুড়োর কথার কোনো জবাব দিল না সোনালী মাছ। একটু মাছটি নীল সাগরের অতলে তলিয়ে গেল। বুড়ো বিষন্ন মনে গাঁয়ে ফিরে এল।

ফিরে এসে এক অবিশ্বাস্য দৃশ্য দেখল বুড়ো। সেই আকাশচুম্বি প্রাসাদটি আর নেই। সৈন্যসামন্ত কিছুই নেই। তার বদলে সেই পুরনো ভাঙা কুঁড়েঘর। ঘরের ভেতর বসে আছে বুড়ি। বুড়োকে দেখে সে কাঁদতে কাঁদতে মাফ চাইল। অতিরিক্ত লোভ যে তাকে অমানুষ করে তুলেছিল তা বুঝতে পারায় বুড়িতে মাফ করে দিল বুড়ো।

বন্ধুরা, রূপকথার গল্পটি শুনলে। বাস্তবে যদিও এ ধরনের ঘটনা ঘটে না তবে এ কথা পরীক্ষিত যে, লোভের ফল কখনই ভালো হয় না। তাই আমাদের সবারই উচিত লোভ-লালসা থেকে মুক্ত থাকার চেষ্টা করা।

ওস্তাদের মার

পানি ও রুটি-রুজি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *