লোকটা – সুস্ময় পাল

-বাবা? -কি বাবা? -ঐটা কি? -কোনটা? -ঐযে বারান্দায়? -বারান্দায়, বারান্দার কোথায়? -ঐ ত কোণায়,কালো করে। -কালো করে ঐটা? ও আচ্ছা,ঐটা ত বাবা কাপড়।এখন তুমি ঘুমাও,চোখ বন্ধ করে ঘুমাও। -কিন্তু বাবা, ঐটা ত কাপড় না। ঐটা একটা মানুষ। আমাদের দিকে পিঠ দেখিয়ে আছে। -না বাবা, ঐখানটায় কাপড় ছাড়া কিছুই নেই।তুমি এখন ঘুমাও। -কিন্তু বাবা……। -তোমাকে না ঘুমাতে বলেছি? চুপ করে ঘুমাও। ধমক খেয়ে রিপন চোখ বন্ধ করে ফেলল।আমি তার বুকে হাত দিয়ে চাপড় মারতে থাকি। রিপন আমার ছেলে,একমাত্র ছেলে।তার বয়স ছয় বছর,একটা প্রাইমারি স্কুলের নার্সারীতে পড়ে।সে আমাকে ভয় পায়।তার মা মানে আমার স্ত্রী মারা যাবার পর থেকে সে আমাকে ভয় পাওয়া শুরু করে।কেন ভয় পায় জানি না।হয়ত আমার মুখটা তার কাছে ভয়ঙ্কর মনে হয়েছে। আমি একজন শিক্ষক।

বাসার কাছের একটা হাই স্কুলে গণিতের সিক্ষক হিসেবে আমার বেশ নামডাক আছে।ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণীর সব অঙ্ক আমিই করিয়ে থাকি।সে কারণে অনেক ছাত্রই আমার কাছে পড়তে আসে।আমার বাসাটা ছোট,তাই আলাদা বাসা নিয়ে সেখানে প্রাইভেট পড়াই।এ কারণে আমাকে সারাদিন ব্যস্ত থাকতে হয়।বাসায় ফিরি রাত নয়টায়,সাড়ে নয়টায়।বাসায় আসার পর হাত মুখ ধুয়ে টেবিলে বসে শংকরের রান্না করা খাবারগুলো খেয়ে ছেলেটার কাছে যাই।রিপন আমাকে ভয় পেলেও রাতের বেলা খেয়েদেয়ে না ঘুমিয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করে।

তাই খাবার খেয়ে এসে তাকে ঘুম পাড়াতে হয় আমাকে।সে ঘুমিয়ে গেলে আমি আমার কিছু কাজ করে এরপর ঘুমাতে আসি।ততক্ষণে বারোটার কাছাকাছি বেজে যায়। আজ শুক্রবার ছিল।তাই তাড়াতাড়ি খেয়ে বাপ-বেটায় মিলে কিছুক্ষণ টিভি দেখেছি।টিভিতে এ চ্যানেল ও চ্যানেল ঘুরতে ঘুরতে এক চ্যানেলে এসে দেখি ভূতের সিনেমা চলছে।তা-ই দেখলাম গত দেড় ঘন্টা ধরে।আর রাত জেগে সে ভূতের সিনেমা দেখে এখন রিপন ভুলভাল বকতে আরম্ভ করেছে। আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলি।শেলি মারা গেছে এক বছর হল।এ এক বছরে রিপনের মাঝে কিছু পরিবর্তন এসেছে।সে কিছুটা লম্বা হয়েছে,তার গায়ের রঙ আরেকটু পরিষ্কার হয়েছে,সে এক ক্লাস উপরে উঠেছে এবং সবচেয়ে যে পরিবর্তনটা চোখে পড়ে সেটা হচ্ছে সে আগের থেকে চুপচাপ হয়েছে।আগে সে সারা ঘর দৌড়াদৌড়ি করত।

এখন তার মা নেই,তার মধ্যে সেই চঞ্চলতাও আর চোখে পড়ে না।শংকরের কাছে শুনেছি রিপন স্কুল থেকে ঘরে ফিরে মন খারাপ করে তার নিজের ঘরে বসে থাকে।তখন শংকরকেই মানে আমাদের ঘরের কাজের ছেলেটাকে ওকে ধরে নিয়ে স্নান করাতে হয়,খাবার খাওয়াতে হয়,পড়াতে বসাতে হয়।অবশ্য রিপন পড়ায় ফাঁকি দেয় না। রিপন ঘুমিয়ে গেছে।তার গায়ে চাদরটা দিয়ে আমি লাইট নিভিয়ে নিজের ঘরে চলে আসি।এখন আমাকে কিছু কাজ করতে হবে।আগামীকাল ষষ্ঠ শ্রেণীর বার্ষিক পরীক্ষার গণিত প্রশ্নটা জমা দিতে হবে।সেটাই তৈরি করব এখন। -বাবা? -কি? -জানো,আজকে আবার ঐ লোকটাকে দেখেছি। -কোন লোকটা? -ঐ যে,ঐ দিন যে লোকটা আমার দিকে হেঁটে আসছিল,সে লোকটা। -কে তোমার দিকে হেঁটে আসছিল? -ঐ যে,কালো পোশাক পরা লোকটা।বাবা জানো,ওর মুখটা না রক্তে মাখা।বাবা,আমার খুব ভয় করে।

-বাবা শোন,তুমি যাকে দেখ,সে আসলে কেউ না।তুমি ভুল দেখেছ।আসলে তুমি বিকেলে খেল না ত,তাই এমন সব দেখ।কালকে থেকে তুমি সামনের মাঠে খেলতে যাবে।তাহলে দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে।কেমন বাবা? -কিন্তু বাবা,ঐ লোকটাকে আমি দেখেছি।সে আমাকে ধরতে চাইছিল।আমি মানা করায় সে ধরেনি।বাবা,ও ধরলে আমি মারা যাব। আমি চমকে উঠি।রিপন এসব কি বলছে?ঐদিন রাতের বেলা ভূতের সিনেমাটা দেখার পর থেকে সে এমন করছে।আমাকে সে এখন বিভিন্ন কথা বলে।একদিন বলেছিল,সে ঐ বারান্দায় মানুষটাকে দেখেছে,তার মুখ রক্তে মাখা ছিল।এরপর একদিন বলে সে লোকটাকে তার দিকে হেঁটে আসতে দেখেছে।ঐদিন সে খুব ভয় পেয়েছিল।আর আজ বলছে লোকটা তাকে ধরতে চায়।ধরলে সে নাকি মারা যাবে।কি অলুক্ষণে কথা! আমি রিপনকে জড়িয়ে ধরি।তার কানের কাছে মুখটা এনে ফিসফিস করে বলি,“শোনো বাবা,তুমি ভয় পেও না।

লোকটা তোমার কিছু করতে পারবে না।আমি তোমায় বাঁচাব,ঠিক আছে?” রিপন আস্তে করে মাথা নেড়ে বলে,“ঠিক আছে”। “তাহলে তুমি এখন ঘুমাও।কালকে বাবার স্কুল আছে না?ঘুমাও।”রিপন চোখ বন্ধ করে।আমি তার বুকে ক্রমাগত হাত দিয়ে চাপড়াতে থাকি। -বাবা? -কি বাবা? -লোকটা আমাকে ধরতে আসছে বাবা।বাবা আমাকে বাঁচাও। রিপন ছটফট করতে থাকে।আমি তাড়াতাড়ি তার পাশ থেকে উঠে একটা ঘুমের ওষুধ আর টেবিলের ওপর রাখা জলের গ্লাসটা নিয়ে তার কাছে এগিয়ে যাই।দেখি রিপন চোখ বড়বড় করে কিসের দিকে যেন তাকিয়ে আছে।আমি আর দেরি করি না।তাকে ওষুধটা খাইয়ে দিই।দশ-পনের মিনিট ধরে হাত-পা ছোঁড়াছুঁড়ি করে সে নিস্তেজ হয়ে যায় এবং এক সময় ঘুমিয়ে পড়ে। আমি লাইটটা বন্ধ করে তার পাশে শুয়ে পড়ি।ঘুমানোর চেষ্টা করতে করতে ভাবি রিপন কি এমন দেখে ভয় পাচ্ছে।তার কি কোন মানসিক সমস্যা হল নাকি সত্যিই কোন অশরীরী……..। আমার হাত-পা কাঁটা দিয়ে উঠে।

তাড়াতাড়ি রিপনকে জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করে ফেলি। আজ রিপনকে সমাধিস্থ করা হবে।তাকে নতুন কাপড় পড়ানো হয়েছে,কাপড় পড়ানোর আগে তাকে স্নান করানো হয়েছে।এখন সামনে খুঁড়ে রাখা কবরে তাকে শুইয়ে আমাকে চিরদিনের মত বিদায় জানাতে হবে। আমার সব আত্মীয়স্বজন এসেছে।তারা অবাক হয়ে দেখছে আমাকে কারণ আমার চোখে জল নেই,আমি কান্না করতে পারছি না।সব কান্না গলায় এসে আটকে যাচ্ছে।তারা আরো বেশি অবাক হচ্ছে আরেকটা ব্যাপার দেখে।সেটা হচ্ছে আমি তাদের রিপনের মৃত্যুর কারণ বলতে পারছি না।এ না বলতে পারাটা লোকেরা ঠিক মানতে পারছে না। ঐ রাতের পরদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে দেখি রিপন আমার দিকে বড় বড় চোখে তাকিয়ে আছে।তার হলদে ফর্সা মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে এবং ঠোঁট দুটো ফাঁক হয়ে আছে।সেই ফাঁকের কাছে দুটো মাছি ভনভন করে উড়ছে।

এ দৃশ্যটা আমি সহ্য করতে পারিনি।শুধু আমি কেন,কোন বাবাই তার ছেলের এ ভয়ঙ্কর অবস্থা দেখে ঠিক থাকতে পারবে না।আমি অজ্ঞান হয়ে যাবার আগ মুহূর্তে শংকরের নাম ধরে দুটো ডাক দিয়েছিলাম। এরপর কিছু সময়ের জন্য আমার জ্ঞান ফিরেছিল।আমি তখন দেখেছি শংকর রিপনের পাশে দাঁড়িয়ে ভেউভেউ করে কাঁদছে আর একজন ডাক্তার রিপনকে চেক করছে।আমি আবার জ্ঞান হারাই। পরে বহু কষ্টে শংকর আমার জ্ঞান ফিরিয়ে এনেছিল।জ্ঞান আসার পর আমি চিৎকার করছিলাম ‘রিপন’ ‘রিপন’ বলে। রিপনকে বিদায় জানাবার পর শংকরের দাদা এসে তাকে নিয়ে যায়।সে চায় না তার ভাই এমন ‘অভিশপ্ত’ ঘরে থাকুক।শংকর যেতে চায়নি।কিন্তু আমি তাকে পাঠিয়ে দিয়েছি।আমিও চাই না এখানে থেকে তার কিছু হোক। শংকরটা চলে যাবার পর আমি একা হয়ে গেছি।

এ একাকিত্ব আমার সহ্য হচ্ছে না,তাছাড়া এ বাসাটা আমার কাছে আর ভালোও লাগছে না।তাই অন্য বাসা খুঁজছি,যেখানে গেলে রিপনের স্মৃতি মাখা এ ঘরটা আমাকে আর কষ্ট দিবে না। বাসা ছাড়ার পিছনে অবশ্য আরো একটা কারণ আছে।সে কারণটা সম্পর্কে আমি কাউকে কিছু বলিনি।কারণ আমি যদি বলি তাহলে লোকেরা আমাকে পাগল মনে করবে।কারণটা সম্পর্কে ভাবলেই আমার গা শিউরে উঠে আর মনে হয় রিপন এক বর্ণ মিথ্যে বলেনি! কারণটা আর কিছুই না। কয়েকদিন আগে আমি একটা কালো পোশাক পরা লোককে রিপনের বিছানার উপর বসে থাকতে দেখেছি যে আমার দিকে পিছন ফিরে ছিল!

ভয়ংকর সেই কালা পোল

মৃত্যুর পরে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *