লাল চোখ

রাত দশটা খড়মপাড়া গ্রামের জন্য বেশ অনেকই রাত। ফইজু মেম্বার ভাবে নাই কাজ শেষ করতে করতে এত রাত হয়ে যাবে।
কিন্তু এই এলাকার মাতবর সে। চেয়ারম্যান থাকে সদরে। তাই গ্রামের বিচার আচার আর শালিশ-দরবার সব ফইজু মিঞাকেই সমলাতে হয়।
দেখা যায় দরবার শেষ হয়ে গেলেও অনেকে ঘিরে ধরে তাকে, মিষ্টি পিচ্ছিল কথা বলে। তো আজকেও এমনি একটা বিচার ছিল।
প্রবাসী শ্রমিক মনির হোসেনের স্ত্রী বেলায়াতীর সাথে প্রতিবেশী আছির মন্ডলের একটা গোপন কচলাকচলি দেখে ফেলে ভাতৃবধু সুফিয়া।
তারপর হাকডাক, কান্নাকাটি আর ঝগড়া-ঝাটির পর আজকের এই শালিস।
এরই মধ্যে ফইজু মিঞার সমবয়সী আছির মন্ডল তলে তলে রসময় সমঝোতায় চলে আসে তার সাথে।
শালিস শেষে বেলায়েতীর সাবিত্রী রায় নিয়ে জনসমাগম বাড়ী চলে যায়।
আর সাঝবেলা আধো আলো আঁধারে কি দেখতে কি দেখা আর সেটা নিয়ে হাক ডাক করার জন্য তিরস্কৃত হয় সুফিয়া।
তারও আধা ঘন্টা পর ফইজু মিঞা বুঝতে পারে আসলেই বেলায়াতী বেশ উদার। তার বাধানো তাগড়া শরীরেও হাপ ধরে গিয়েছে এক দ্রুত আপ্যায়নে।
কাজ কাম শেষে বাড়ীর পথ ধরে ফইজু মিঞা। ফটফটে জোৎস্না আছে, গ্রাম্য পথ চলতে তেমন কোন সমস্যাই হচ্ছিল না।
নিথর গভীর রাত, নুন্যতম শব্দহীন সুনসান চরাচর। তেল মারা বয়সী হারকিউলিস সাইকেল প্যাডেলে প্যাডেলে সামান্য কোঁকিয়ে উঠছে শুধু।
ফজিুর সারা শরীরে একটা আরামদায়ক অবসাদ। তবে, নাপাক শরীরে একটু অস্বস্তি লাগছে।
কারন গায়েবী মাখলুকাতগুলো নাপাক শরীরের গন্ধ পায়, একা পেলে যা তা উৎপাত করে। কার্তিকের মাঝরাত।
ঝলক ঝলক হিমেল হাওয়া প্রবাহিত হচ্ছে মাঝে মধ্যে। হঠাৎ একটা কালো বিড়াল হুস করে রাস্তার এপাশ থেকে ওপাশে দৌড়ে পার হয়ে গেলো।
আর একটু হলে সাইকেলের নীচে চাপা পড়তো। ফইজু মিঞা থামে। লুঙ্গীর কোট থেকে বিড়ি ম্যাচ বের করে আগুন জ্বালায়।
কষিয়ে টান বসায়। কেমন যেন একটা অব্যক্ত অস্বস্তি ফুটে উঠছে মনের পটে। নাহ্! এত রাতে এমন একা একা বের হওয়া ঠিক হয় নি।
আবজইল্ল্যা আসতে চেয়ে ছিল সাথে। কিন্তু সাইকেলে ডাবলিং করার হ্যাপায় তাকে ফিরিয়ে দিয়ে ছিল ফইজু। এখন সামান্য আফসোস হচ্ছে।
কেমন যেন একটা বোবা ভয় ধীরে ধীরে কুয়াশার মত দলা পাকাচ্ছে অসম সাহসী ফইজু মিঞার গোটা অস্তিত্বকে কেন্দ্র করে।
পল পল করে পার হয় কিছু বোবা সময়। উষ্ণ ঘাম বুক গলা ভিজিয়ে দিচ্ছে তার।
একটা দিশেহারা ভাব তাকে যখন গ্রাস করতে যাচ্ছিল ঠিক তখন দূর থেকে ভেসে আসলো কয়েকজন মানুষের কন্ঠস্বর।
উঠে দাঁড়িয়ে পাছায় ঘাম ভেজা করতল মোছে ফইজু। অবারিত জোৎস্নায় চোখ সরু করে তাকায়।
তিনজন ছেলে বয়সী মানুষ আসছে। হঠাৎ যেন কর্পূরের মত উবে গেল সব ভয়। জাদরেলী হাঁক ছাড়লো, ‘ কারা যায়’? কাছে এসে পাশের গ্রামের যুবকত্রয়ের সলাজ উত্তর, বাজারের ভিডিও দোকানে রাতের বিদেশী ফিলিম দেখে বাড়ী ফিরছে তারা।
ফইজু মিঞা সাইকেল ঠেলে হাটতে থাকলো তাদের সাথে। বেশ অনেকটা পথ এক সাথে যাওয়া যাবে।
সংকোচিত যুবকদের বিদেশী ফিলিম দেখার কুফল বর্ণনা করতে করতে দিঘীর পাড়ে পৌছে গেল।
এবার যুবকত্রয় ভিন্ন পথে যাবে। ফইজু মিঞার বাড়ী এখান থেকে আর মাইলখানেক মাত্র। চলে যাওয়া যাবে একটানে।
বিদায় নিল যুবকেরা। তারা চোখের আড়ালে যেতেই আবার স্বমহিমায় ফিরে এল সেই পুরাতন ভয়।
যেন কাছাকাছি কোথাও ঘাপটি মেরে লুকিয়ে ছিল এতক্ষণ। নিরিবিলি পেয়ে লাফিয়ে চেপে বসেছে ফইজু মিঞার ঘাড়ে।
বাতাসে হাত চালিয়ে কি যেন উড়িয়ে দিয়ে আবার রওনা হল দোটানায় পড়া ফইজু। দিঘীর উঁচু পাড় থেকে নিচে নেমে গেছে রাস্তাটা।
অনেক দূর পর্যন্ত প্যাডেল মারতে হয় না। শুধু হ্যান্ডেল ধরে বসে থাকলেই হয়।
জোরে জোরে কয়েকটি চাপ দিয়ে পা দুটোকে জিরাতে দিল ফইজু। ঝড়ের বেগে সা সা করে ছুটে চলছে সাইকেল।
আরো কিছু বাড়তি গতি দিতে সজোরে প্যাডেল দাবায় ফইজু। হঠাৎ আবিস্কার করে চেইন পড়ে গেছে।
হতাশ হয়ে সাইকেল থেকে নামে সে। মনের মধ্যে কেমন যেন কু ডাকছে।
বোধ হচ্ছে সাইকেল থেকে নামাটা মোটেও ঠিক হচ্ছে না, কিন্তু কি আর করা। না, চেইনটা পড়েনি! মাঝ বরাবর দুই খন্ড হয়ে ছিঁড়ে গেছে! বাকীটা পথ সাইকেল ঠেলে নিয়ে যেতে হবে।
দিঘী পাড়ে রাস্তার দুপাশে যেমন ঘন ছনের ঝোপ ছিল, এখানটা একদম পরিস্কার।
সামনের দিকে যতদূর দৃষ্টি যায় ধূ ধূ চরাচর। হাশেম মুন্সীর পাথার।
এই বিস্তীর্ণ পাথারের পরই শুরু হয়েছে ফইজুদের গ্রাম। গ্রামের একেবারে মাঝামাঝিতে তার বাড়ী ।
কিছু দূর যাবার পর ফইজু মিঞা দেখলো মেটে রাস্তার উত্তর পাশে বেশ কয়েকজন মানুষ বসে আছে।
আরো একটু এগিয়ে গিয়ে দেখা গেল দশ-বারো জন যুবক বয়সী ছেলে রাস্তার পাশে বসে দুলে দুলে কি যেন বই পড়ছে।
পরনে লম্বা সাদা জামা আর মাথায় গোল টুপি। চারপাশটা কেমন যেন একটা লালাচে আভায় আলোকিত হয়ে আছে।
এই কটকটে জোৎস্না চেষ্টা করলে হয়তো কিছু পড়া যায় কিন্তু এতো জায়গা থাকতে রাস্তায় বসে পড়াশুনা করতে দেখে ফইজুর মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে উঠলো। ‘কে রে তোমরা, এখানে কি কর’? পিলে চমকানো হাঁক দাগালো ফইজু মিঞা।
সবগুলো যুবক শান্তভাবে এক সাথে তাকালো ফইজু মিঞার দিকে। হঠাৎ অন্তরাত্মা খাঁচা হয়ে গেল ফইজু মিঞার।
যুবক গুলোর চোখের জায়গায় যেন গনগনে অঙ্গার বসানো। ধক্ব ধক্ব করে জ্বলছে। লাল আলোয় আলোকিত হয়ে উঠেছে চারপাশ।
কেমন একটা পোড়া পোড়া গন্ধ। পড়া বন্ধ করে ধীরগতিতে নড়ে উঠে যুবকেরা। যেন তার অপোতেই বসে ছিল এতো সময়।
বিস্ফোরিত চোখে ফইজু দেখে চার হাত পায়ে ভর করে দ্রুতগতিতে তার দিকেই ছুটে আসছে তারা। ওওওরে…. বাবা গো……! বলে উর্দ্ধশ্বাসে দৌড় দিল ফইজু মিঞা।
ঢেলায় আঘাত খেয়ে পায়ের নখ উল্টে গেছে, কাদায় পিছলা খেয়ে লুঙ্গী ছিড়ে গেছে, কোন অনুভূতি নেই ফইজুর।
যে কোন মূহুর্তে যেন ফেটে যাবে ফুসফুস। বাড়ীর পেছনের ডেঙ্গা দিয়ে ট্টটি ও মুরগীর ঘরের ফাঁক গলে দাওয়ায় আছড়ে পড়ে সে। গোঁ গোঁ শব্দ করে হঠাৎ নীথর হয়ে যায় সে।
বাড়ীর লোকজন কুপি হারিকেন নিয়ে বের হয়ে এসে দেখে চিৎ হয়ে পড়ে আছে নিস্পন্দন ফইজু মিঞার প্রাণহীন দেহ।
চোখ দুটো আর দাতের পাটিগুলো বিস্ফোরিত ভাবে খুলে আছে। দাঁতের ফাক গলে বের হয়ে আছে লম্বাটে শুষ্ক জিহবা।
মারা গেছে ফইজু মিঞা। চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে আলগা বাতাস লাগা লাশ।
কান্নার রোল উঠলো ফইজুর বউ আর বাধা মুনীদের মাঝে। আর্তনাদে যেন চিরে দুই ভাগ হয়ে যাবে কালো আকাশ।
হিম শীতল দেহটাকে গোসল করালো পড়শীরা। নিঃসন্তান ফইজু মিঞার জন্য বিলাপ করার জন্য আধবুড়ো বউ ছাড়া আর তেমন কেউ নেই।
বউও মূর্চ্ছা খেয়ে পড়ে আছে। তার শুশ্র“সা করছে পাড়ার নারীরা। সিদ্ধান্ত হলো আলগা লাগা মরা গোর দিতে দেরী করা যাবে না।
রাত পোহালেই ফজরের নামাজ শেষে জানাজা দিয়ে দেয়া হবে। ফজরের নামাজ শেষ পর্যায়ে লম্বা সালাম দিয়ে ডানে বামে ঘাড় ঘোরালেন ঈমাম সাহেব।
মুসল্লীরা অবাক হয়ে দেখলেন জামাতে শরীক হয়েছে অপরিচিত দশ-বারো জন যুবক বয়সী তালিবুল এলেম।
তাদের আচার আচরনে কেমন যেন অদ্ভুত একটা মিল। সবাই যেন একজন কিংবা একজনেরই প্রতিচ্ছায়া সবাই।
এপাড়া বা আশেপাশের গ্রামের নয় এটা নিশ্চিত। কারন, এই এলাকার মানুষেরা এমন তুষার সফেদ কুর্তা গায়ে দেয় না।
এবার জানাজা নামাজ। এক কাতারে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে নামাজ পড়লো যুবকেরা।
জানাজা শেষে অন্যদের একরকম জোর করে সরিয়ে দিয়েই লাশের খাটিয়া কাঁধে তুলে নিল চার যুবক।
তারপর হন হন করে হাঁটা ধরলো গোরস্থানের দিকে। অন্ধকার ভোরে কোন মুসল্লীই তাদের গতির সাথে তাল মেলাতে পারছে না।
মসজিদের বয়স্ক ঈমাম আর হাফেজ মুয়াজ্জিন কিছু একটা সন্দেহ করতে লাগলো।
কিন্তু সবকিছু বুঝে উঠার আগে হামিদার ছাড়া বাড়ীর মোড় ঘুরেই যেন শুণ্যে মিলিয়ে গেল লাশের খাটিয়া আর তার বাহকেরা।
কোথাও দেখা গেল না তাদের। শুধু চারপাশ ম ম করছে আতর আর লোবান পোড়া গন্ধে। ফইজু মিঞার লাশ আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় নি।

খুপড়ি ঘর-ভূতের গল্প

কে, ওখানে.?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *