
”ডুমনীগড় ফরেস্ট রেঞ্জে আমার পোস্টিং অনেক দিন হলো।”….লাভলু মামা গল্প বলা শুরু করলেন।
ডুমনীগড় যে মানচিত্রের ঠিক কোন জায়গাটায়, আমরা কেউই মালুম করতে পারলামনা, কিন্তু ঐ এক ধরন লাভলু মামার….. গল্পের মাঝখানে ফোঁড়ন কাটলেই মহা ক্ষেপে যান তিনি… তাই মাথা নেড়ে চুপচাপ গল্প শুনছি আমরা….. ”জায়গাটা আমার মনের মত।
বড় বড় চাপালিশ আর শিরীশ গাছে ঢাকা বন…. গোটা বন জুড়ে আছে বাঁশ আর বেতের ঘন ঝোপ।
সাপ, বেজি, বানর ছাড়াও আরও কত কি বন্য প্রাণী যে আছে ডুমনীগড় বনে.. তার কোন ইয়ত্তা নাই।”হারিকেনের ভৌতিক আলোয় কাচারী ঘরে মামার গল্প শুনতে বসেছি আমরা চার কাজিন… পল্টু, বিল্টু, টগর আর আমি।
অনেকদিন পরে লাভলু মামাকে পেয়েছি। সারাদেশে যুদ্ধ চলছে…. জানের ভয়ে আমরা শহর ছেড়ে গেছি নানার বাড়ীতে… গ্রামে। বড় খালা, সেজ খালা কয়েকদিন আগেই ছেলে মেয়ে নিয়ে চলে এসেছেন গ্রামে।
চির ব্যাচেলর লাভলু মামা বাড়ী এসেছেন আজই সন্ধ্যায়।
বাড়ী ভর্তি লোকজন। বড়দের চোখ ফাঁকি দিয়ে লাভলু মামা আমাদের গল্প শোনাতে নিয়ে গেছেন কাচারী ঘরে… আমরাও তাঁর গল্পের খুব ভক্ত।
মামার অভিজ্ঞতার ভান্ডার খুব সমৃদ্ধ…. গল্প বলেনও খুব জম্পেস করে! ” খাসিয়া পল্লীতে পরব অনুষ্ঠান.. সেখানে আমার নেমন্তন্ন।” বলে চলেছেন মামা…” ডুমনীগড় বনে দশ-বারো ঘর খাসিয়ার বাস।
নেমন্তন্ন খেয়ে ফিরছি আমার বাংলোয়। রাত তখন.. এই ধর, দশটা।
বন বাঁদারেই-তো জীবনের অনেকটা সময় কাটিয়ে দিলাম…. বনে জঙ্গলে আমার কোন ভয়-ডর লাগেনা।
সাথে আছে তিন ব্যাটারীর টর্চ লাইট আর আমার অফিসের দারোয়ান প্রদীপ। সেদিন ছিল কৃষ্ণপক্ষ… চারদিকে অন্ধকার।
টর্চের আলোয় ঝর্ণার ধার ধরে চলছি। পাতার ঝিরিঝিরি শব্দ… আর ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক।
এরইমধ্যে হঠাৎ খেয়াল করলাম পাতা মাড়ানোর খসখস শব্দ!” অন্ধকার রাতে বন জঙ্গলের পরিবেশ, কাহিনীতে একটা ছমছম ভাব! আমরা নড়েচড়ে বসলাম……” ভাবলাম কোন বন্য শুকর বা শেয়াল-টেয়াল হবে হয়তো! চারদিকে টর্চ মেরে কিছু দেখতে পেলামনা।
কিছুদূর এগুতেই আবার সেই খসখস শব্দ! আমরা চলতে শুরু করলেই খসখস শব্দটা যেন আমাদের পিছু নিচ্ছে… আমরা থেমে গেলেই শব্দটাও থেমে যাচ্ছে! উহু… বুঝলাম কিছু একটা আমাদের ফলো করছে।” গল্পে এখনই হয়তো কোন অশরীরি আত্মার আবির্ভাব ঘটবে… ভৌতিক পরিবেশ.. আর মামার গল্প বলার মুন্সিয়ানার ফলে তেমনই আশা করছিলাম আমরা।
গুটিশুটি মেরে ভয়ে ভয়ে গল্প শুনছি…” শীতের রাত! সাপ-খোপ হবার সম্ভাবনা কম। রাতের বেলায় এই এলাকায় মানুষেরও যাতায়াত নাই।
প্রদীপ একটু ভয় পেয়েছে মনে হচ্ছে….. ভূত-প্রেতে বিশ্বাস আছে ওর। কিন্তু আমি ভাবছি অন্য কিছু। ডুমনীগড় বনের পরেই যে পাহাড়টা… ওটা ইন্ডিয়ায় পরেছে।
কোন অপারেশনে গেলে এ পথ দিয়েই ওপার থেকে গোলাবারুদ নিয়ে ঢোকে মুক্তিযোদ্ধারা।
কিন্তু আজ-তো কোন অপারেশনের ইনফরমেশন নাই! কোন অপারেশন হলেই আগাম ইনফরমেশন পেতাম আমি।
মুক্তিযোদ্ধাদের নির্বিঘ্নে পাড় করার দায়িত্ব ছিল আমার।” প্রায় জমে ওঠা একটা ভুতের গল্প হঠাৎ করে অন্যদিকে টার্ন নেওয়ায় আমরা সবাই আশাহত!… তারপরও অধীর আগ্রহ নিয়ে শুনছি…” আবছা অলোয় হঠাৎ দেখলাম প্রদীপের চোখ কপালে.. কিছু একটা দেখে প্রচন্ড ভয় পেয়েছে ও…ভয়ে ওর মুখ হা হয়ে আছে! পিছন ফিরতেই দেখি… অন্ধকারের আড়ালে সাদা আলখেল্লা পড়া এক মূর্তি…মাথায় সাদা টুপি! বাতাসে নড়ছে আলখেল্লার আস্তিন! সাক্ষাত যেন যমদূত!” গল্পটা এবার কোন দিকে টার্ন নেবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছিনা…”ভুত-প্রেতে আমার বিশ্বাস নাই।
আমি টর্চ মারতে যাব…এমন সময় কেউ একজন আমার হাত দু’টো পেছনমোড়া করে শক্ত করে বেঁধে ফেললো।
সাদা আলখেল্লা-টা দু’পা এগিয়ে এলো আমার দিকে… পরিচিত গলার আওয়াজ পেলাম -‘মাফ করবেন জনাব, আপনার বড্ড বাড় বেড়েছে… আপনি পাকিস্তান বিরোধী।… বেজন্মা মুক্তির সাথে হাত মিলিয়েছেন… আপনি দেশের শত্রু… আপনাকে উপযুক্ত শাস্তি পেতে হবে।’….. গলা শুনেই বুঝলাম আমার অফিসেরই বড়বাবু (সিনিয়র ক্লার্ক) আব্দুল লতিফ পাটোয়ারী…. ব্যাটা রাজাকারের বাচ্চা!” চুপচাপ শুনছি আমরা…” বনের নির্জনতাকে ভেঙে দিয়ে হঠাৎ ঠা ঠা করে পরপর চারটা গুলির আওয়াজ।
একটা আমার বুক ভেদ করে চলে গেল… আর একটা লাগলো তলপেটে! প্রদীপের লাশটা গড়াতে গড়াতে গিয়ে পড়লো ঝিরির পানিতে…. আমার লাশটা গিয়ে পড়লো বিশ ফুট নীচে ঝিরির খাদে।” গল্পের এই পর্যায়ে এসে একটু দম নিলেন মামা।
তিনি খুব চমৎকার গল্প বলেন বটে, তাঁর গল্প বলার স্টাইলই আলাদা…. গল্পের আবহ ফুটিয়ে তুলে এমনভাবে বলেন যেন সব সত্যি বলছেন!… তাই বলে এতটা?! জলজ্যান্ত শরীরে নিজের মরার গল্প বলে গেলেন অবলিলায়?! … মামা পারেনও বটে! কিন্তু বিটকেল বিল্টুটা এবার আর চুপ থাকতে পারলো না…. ”চাপাটা একটু বেশী হয়ে গেলনা মামা? আপনি নিশ্চয়ই এটা সত্যি কাহিনী বলে চালিয়ে দিচ্ছেন না?!” ….. কিন্তু আমাদের সবাইকে অবাক করে দিয়ে মামা নিজের স্বপক্ষে অবস্থান নিলেন…” তোদের ওই এক দোষ! তোরা সব কিছুকেই বানোয়াট ভাবিস! ডুমনীগড় বনের ঝিরির খাদে গিয়ে এখনও লাশটা দেখতে পাবি।
আর হ্যাঁ…. তোদের যেটা বলার জন্য আজ এই গল্প বলা… যে যুদ্ধ আমরা শুরু করে গেছি… সেই যুদ্ধে একদিন বিজয় নিশ্চিত করতে হবে তোদেরকেই।
কথাটা মনে রাখিস।” মামার ধমক খেয়ে আমরা বিনা বাক্য ব্যয়ে চুপচাপ উঠে ঘুমাতে গেলাম।
বুঝলামনা…. এমন জলজ্যান্ত ডাহা মিথ্যা গল্পটা সত্যি বলে চালিয়ে দেবার হাস্যকর প্রয়াস পেলেন কেন তিনি?! রাতে ভাল ঘুম হয়নি…. সকালে অনেক্ষণ বিছানাতেই গড়াড়ড়ি করছি।
হঠাৎ শুনি বাড়ীর ভিতরে শোরগোল… সবাই কান্নাকাটি করছে। ….. ডাক পিওন চিঠি দিয়ে গেছে…. ডুমনীগড় থেকে লাভলু মামার এক সহকর্মীর চিঠি! গত প্রায় এক মাস যাবৎ মামা বিনা নোটিশে দপ্তরে অনুপস্থিত।
তিন দিন আগে বনের ভিতর ঝর্ণার খাদের নীচে একটা অর্ধগলিত বিকৃত লাশ পাওয়া গেছে… পোষাক দেখে লাশটা লাভলু মামার বলে ধারনা করা হচ্ছে…… আমি আর বিল্টু মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে লাগলাম।
তারপর চারজনে ছুটলাম বাড়ীর আশপাশে লাভলু মামাকে খুঁজতে…. কোথাও খুঁজে পেলামনা তাঁকে… আমরা চারজন…. অনেক খুঁজেছি…… কিন্তু আর কখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি তাঁকে।