
সূর্যটা ডুবতে না ডুবতেই রুহীদের ছাদে ভিড় জমে উঠল। পশ্চিম আকাশে সাদা আর একটু লালচে মেঘের ফাঁকে-ফাঁকে পলকহীন জোড়া জোড়া চোখের দৃষ্টি তখন আতি-পাতি করে খুঁজছে রমজানের নতুন বাঁকা চাঁদ। কিন্তু কেউই খুঁজে পাচ্ছে না।
হঠাৎ রুহী তার মামাকে বলল, “সামি মামা, তোমার দূরবীনটা নিয়ে আসো, তাহলে ঠিক দেখতে পাবে।”
সামি গমগম কণ্ঠে বলে উঠল, “লাগবে না, আমার চোখ দুটোই তো দূরবীন।”
রুহী বলল, “মোটা মানুষের দৃষ্টি চাঁদের কাছে যাবে না। তুমি তো ট্যান-টেনে-বাতাসী মার্কা। তুমি কি দেখতে পেয়েছো?”
রুহীর বয়স ছয় বছর। এলোমেলো কথার ধার ধারে না সে। যুক্তি দিয়ে চমৎকার কথা বলে। তার মামার বয়স মাত্র বারো। শরীর স্বাস্থ্য মাসআল্লাহ! মামা-ভাগনীর ঝগড়া লেগেই থাকে, আবার কেউ কারও থেকে বেশিক্ষণ দূরেও থাকতে পারে না।
হঠাৎ পাশের বাড়ির ছাদ থেকে ছেলে-মেয়েরা চিৎকার করে উঠল, “ঐ যে ঢেউ ঢেউ মেঘের নিচে! বাবা রে বাবা, কী চিকন চাঁদ উঠেছে! সবাই বলো—
একটি বছর পরে রোজা এলো ঘরে,
নামাজ পড়ো, রোজা রাখো, যাকাত করো দান,
সারা বছর ভালো থাকবে রোজাদারের প্রাণ।”
ঘরে এসে রুহী তার নানাকে বলল, “নানাভাই, আমি কিন্তু সবগুলো রোজাই রাখব।”
নানা কিছু বলার আগেই সামি বলল, “হুঁ! একটা রোজাও রাখতে পারবে না আবার! মোট কয়টা রোজা জানো?”
রুহী উত্তর না দিয়ে চুপ হয়ে গেল। নানা বললেন, “রমজান মাস হয় ত্রিশ দিনে। কখনো ঊনত্রিশ দিনেও হতে পারে। আরবি মাসগুলোর সম্পর্ক চাঁদের সাথে। আমরা চাঁদ দেখে রোজা রাখা শুরু করি এবং নতুন চাঁদ দেখে রোজা শেষ করি। এই মাস ইংরেজি বা বাংলা মাসের মতো নির্দিষ্ট থাকে না। তাই গ্রীষ্মেও রোজা হয়, শীতেও রোজা হয়, আবার বর্ষাতেও রোজা হয়।”
নানা আরও বললেন, “একবার এক বিদেশি মুসলমানদের রোজা রাখতে দেখে বলেছিল, ‘মুসলমানেরা এত কষ্ট করে গরমের মধ্যে কীভাবে রোজা রাখে? পানির অভাবে প্রতিটি জীব কষ্ট পায়, অথচ এদের চোখে-মুখে কষ্টের কোনো ছাপই নেই!’
একজন মুসলমান উত্তরে বলেছিল, ‘সবই আল্লাহর রহমত। সাত-আট বছরের ছেলেমেয়েরাও রোজা রেখে আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায়। কোনো কষ্টই তাদের ছুঁতে পারে না।’
সামি বলল, “আব্বু, তাহলে তো শীতের সময়ের রোজাই ভালো।”
অমনি রুহী বলে উঠল, “না, বৃষ্টির সময়ের রোজাই ভালো।”
নুরউদ্দিন সাহেব হাসতে-হাসতে বললেন, “সব সময়ের রোজাই ভালো। তবে আল্লাহ তাঁর প্রিয় বান্দাদের জন্য এমন ব্যবস্থা করেছেন। প্রতিদিন একই রকম খাবার খেতে দিলে যেমন ভালো লাগে না, তেমনি সব ঋতুতেই রোজার অভিজ্ঞতা আলাদা হয়।”
রুহী বলল, “নানাভাই, প্রতিদিন আমার খাবারের মেনু একরকম থাকে না। কোনদিন সবজি, কোনদিন মাছ, আবার কোনদিন গোশত।”
নানা মৃদু হেসে বললেন, “ঠিক বলেছো। সারা বছর আমরা কত রকম ফল খাই, কিন্তু সব ফল একসাথে পাই না। তোমরা বড় হলে এসব আরও ভালো বুঝতে পারবে।”
রোজার মধ্যে বেশি ভাজাপোড়া খাওয়া ঠিক নয়—এ কথা মাথায় রেখেই নুরউদ্দিন সাহেব বাসায় ফেরার পথে কিছু ফল নিয়ে এলেন। তিনি জানেন, বাসায় ছোলা ছাড়াও কিছু পিঁয়াজু আর মুড়ি থাকবেই।
মাগরিবের আজানের আগেই সবাই অজু করে গোল হয়ে বসেছে। সামনে নানান রকম ইফতারি। বড়দের জন্য বরফকুচি দেওয়া লেবুর শরবত। রুহী বসেছে নানার কোল ঘেঁষে। হঠাৎ সে একজন বিচক্ষণ পরিদর্শকের মতো ধীরে-সুস্থে বলে উঠল, “নানাভাই, তুমি তো অনেক বড় একটা ভুল করে ফেলেছো।”
সবার দৃষ্টি তখন রুহীর দিকে। নানা বললেন, “কী ভুল করেছি?”
রুহী বলল, “তুমি আমার নাম জানো না?”
“জানবো না কেন? তুমি তো রুহী সামারা অনঘ।”
“তাহলে আমার শরবত কোথায়?”
“এই তো জগ ভরা রয়েছে।”
“আহা, এই শরবত না! রুহআবজা কোথায়? তুমি জানো না, রুহী রুহআবজার শরবত খায়!”
নানা অনুতপ্ত হয়ে বললেন, “সত্যি তো! এ কথা যে আমার মনেই আসেনি!” তিনি সঙ্গে সঙ্গেই দোকানে ফোন করলেন রুহআবজার বোতল আনিয়ে দিতে।
রমজান মাসের মাঝামাঝি একদিন ইফতারের পর রুহী বলল, “নানাভাই, তুমি কি হিসেব করেছো, আমার কয়টা রোজা হলো?”
নানা বললেন, “আজ পনেরো রোজা যাচ্ছে।”
“আমার কিন্তু পনেরো রোজার বেশিই হয়েছে!”
সামি খুকখুক করে হেসে উঠল। রুহী বলল, “মাম- আমি তিনদিন দুপুরবেলা খেজুর আর রুহআবজা খেয়ে ইফতার করেছি না? তাহলে পনেরোটার বেশি হলো না?”
নানা হেসে বললেন, “ছোটদের একদিনে দুটো রোজাও হয়!”
রমজান শেষে ঈদের চাঁদ উঠল। খুশির বন্যায় ভাসলো সবাই। ঈদের দিন নতুন জামা পরে রুহী নানাকে সালাম করে বলল, “নানাভাই, আমাকে কেমন দেখাচ্ছে?”
নানা চেয়ে থেকে বললেন, “পরীর মতো।”
রুহী এক ঝলক হাসি ছড়িয়ে নাচতে-নাচতে চলে গেল সমবয়সীদের সঙ্গে। নুরউদ্দিন সাহেব মনে মনে ভাবলেন, ‘সারাটা বছর যদি এমন আনন্দে কাটতো, জীবনে আর কিছু চাওয়ার থাকতো না।’