গহর মামা আমাদের খুব দুর সম্পর্কের মামা; কিন্তু আপন মামাদের থেকে তাঁর সঙ্গে আমাদের বেশি খাতির ছিল। আমি যখনকার কথা বলছি, তখন ভদ্রতার ব্যাপার-স্যাপারগুলো সেভাবে চালু হয় নাই। হাঁচি দিয়ে কেউ ‘এক্সকিউজ মি’ বলত না, চা-নাশতা খেয়ে কেউ ‘থ্যাংকু’ বলত না। পেটভরে খেয়ে সবাই ‘ঘেউক’ করে বিকট শব্দ করে ঢেকুর তুলত এবং সে জন্য কেউ তার দিকে ভুরু কুঁচকে তাকাত না।
এখন যে রকম কেউ আগে থেকে খোঁজখবর না দিয়ে আসে না, তখন সে রকম ছিল না−আত্মীয়স্বজন দুইটা মুরগি, না হয় এক জোড়া নারকেল নিয়ে রাত-বিরেতে চলে আসত। আমাদের গহর মামাও সে রকম চলে আসতেন−অন্য কেউ এলে আমরা যেটুকু খুশি হতাম, গহর মামা এলে তার চেয়ে অনেক বেশি খুশি হতাম।
কারণ গহর মামা খুব সুন্দর গল্প করতে পারতেন। তাঁর নানা রকম গল্প ছিল। কিছু গল্প ছিল খুব হাসির। আজকালকার ছেলেমেয়েরা শুনলে নিশ্চয়ই নাক-মুখ কুঁচকে বলবে, ‘হাউ ডার্টি’। কিন্তু আমরা শুনে হেসে কুটি কুটি হতাম। কিছু কিছু গল্প ছিল বিচিত্র। ডাকাতেরা এসেছে এবং গৃহস্থরা কীভাবে সেই ডাকাতদের ধরে ফেলছে−সে রকম গল্প।
কিছু কিছু গল্প ছিল ভয়ংকর। গরুচোরদের ধরে কীভাবে খেজুর কাঁটা দিয়ে তার চোখ গেলে দেওয়া হচ্ছে তার বীভৎস বর্ণনা। তবে গহর মামার সবচেয়ে মজার গল্প হচ্ছে ভুতের গল্প। আমরা ভয় পাব বলে ভুতের গল্প বেশি বলতে চাইতেন না, অনেক জোরাজুরি করলে একটা-দুইটা বলতেন; সেগুলো শুনে ভয়ে আমাদের পেটের ভাত চাল হয়ে যেত! গহর মামার কাছে শোনা একটা গল্প ছিল এ রকম−তাঁর নিজের ভাষাতেই বলি: এখন যে রকম নানা ধরনের স্কুল আছে−কোনোটা বাংলা, কোনোটা ইংরেজি, আমাদের সময় সে রকম কিছু ছিল না। দশ-বিশ মাইলের মধ্যে কোনো স্কুল খুঁজে পাওয়া যেত না। বেশির ভাগ মানুষ লেখাপড়াই করত না। লেখাপড়ার কোনো দরকারও ছিল না। খুব যদি কারও লেখাপড়ার শখ হতো, সে কোনো মক্তব, না হয় মাদ্রাসায় পড়ত। আমার নিজের লেখাপড়া করার কোনো ইচ্ছা ছিল না, কিন্তু আমার বাবার খুব শখ ছেলেকে মাওলানা বানাবেন। তাই একদিন আমাকে ধরে জোর করে নিয়ে একটা মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিয়ে এলেন। সেই মাদ্রাসায় থাকা, খাওয়া, লেখাপড়া সবকিছু। মাদ্রাসার বড় হুজুরের নাম করিমুল্লা। শক্ত পেটা শরীর, মুখে লম্বা দাড়ি, মাথায় সাদা পাগড়ি। বাবা চলে আসার সময় করিমুল্লা হুজুরকে বলে এলেন, ‘হুজুর আমার ছেলেকে আমি আপনাকে দিয়ে গেলাম।’ হুজুর বললেন, ‘তোমার কোনো চিন্তা নাই। আমি তোমার ছেলেরে মানুষ করে ফেরত দিব।
’ বাবা বললেন, ‘হুজুর, খালি চামড়াটা দিলেই হবে। আমার ছেলের হাড্ডি আর মাংস আপনার খেদমতের জন্য। মানুষ করার জন্য হাড্ডি-মাংস ছেঁচে ফেলেন, আমার কোনো আপত্তি নাই।’ সেই যুগে সবাই জানত, যে হুজুর যত শক্ত পিটুনি দিতে পারেন তাঁর ছাত্র তত ভালো লেখাপড়া করতে পারে। করিমুল্লা হুজুরের মারপিটের অনেক সুনাম ছিল, অনেক দুর থেকে মারপিটের শব্দ শোনা যেত। তাই দুর দুর থেকে বাবা-চাচারা তাঁদের ছেলেদের এই মাদ্রাসায় ভর্তি করে দিয়ে যেতেন। যা-ই হোক, বাবা কিছু ভালোমন্দ উপদেশ দিয়ে চলে গেলেন। আমার ইচ্ছা হলো ডাক ছেড়ে কাঁদি। কিন্তু কেঁদে লাভ কী, আমার কান্না শুনবে কে? মাদ্রাসায় মতিনের সঙ্গে আমার পরিচয় হলো। সে আমার পিঠে হাত দিয়ে বলল, ‘ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে খামোখা কাঁদবি না। তোর কান্না কেউ শুনতে পাবে না। যদি আস্ত থাকতে চাস, তাহলে রেডি হ।’ আমার মাদ্রাসার জীবন শুরু হলো। হুজুর করিমুল্লা ছাড়া মাদ্রাসার আরও দুইজন শিক্ষক আছেন, তাঁরা একে অন্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে ছাত্রদের পেটান।
প্রথম প্রথম আমরা পিটুনি খেয়ে গলা ছেড়ে কাঁদতাম, ধীরে ধীরে অভ্যাস হয়ে গেল। মাদ্রাসার অন্য ছাত্রদের সঙ্গে পরিচয় হলো। সারা দিন আমরা হাদিস শরিফ, ফিকাহ মুখস্থ করি; রাতের বেলা যখন কেউ থাকে না, তখন আমরা নানা রকম দুষ্টুমি করি। এভাবে কয়েক বছর কেটে গেল। লেখাপড়া খুব একটা শিখি না, সুর করে আরবি পড়তে পারি, দুই-চারটা সুরা মুখস্থ হয়েছে, কোন কাজ করলে কী রকম গুনাহ হয় আর তার জন্য দোজখের আগুনে কত দিন ধরে পুড়তে হয়, সেগুলো মোটামুটি জেনেছি। এ রকম সময়ে একদিন একটা ঘটনা ঘটল। ঘটনাটার কথা বলার আগে হুজুর করিমুল্লার আরেকটা কথা বলা দরকার। ছাত্রদের পিটিয়ে মানুষ করা ছাড়াও তাঁর আরও একটা বিষয়ে সুনাম ছিল, সেটা হচ্ছে জিন-ভুতের চিকিৎসা। আজকালকার দিনে লোকজনের ওপর জিন-ভুতের সেই রকম আছর হয় না, আমাদের সময় সেটা ছিল একটা নিয়মিত ঘটনা। এমন কোনো বাড়ি ছিল না যে বাড়িতে দুই-চারজন বউ-ঝিকে জিনে ধরত না।
হুজুর করিমুল্লা সেসব জিন-ভুতে পাওয়া রোগীর চিকিৎসা করতেন। চিকিৎসাটা ছিল মোটামুটি সহজ। বিড়বিড় করে কিছু দোয়া-দরুদ পড়া আর রোগীটাকে অত্যাচার করা। কঠিন কঠিন অত্যাচার−যে রকম মাঘ মাসের শীতে পুকুরের পানিতে একশ একবার ডুব দেওয়া, কাঁচামরিচ বেটে চোখের মধ্যে ডলে দেওয়া, শুকনা মরিচ পুড়ে নাকের মধ্যে ধোঁয়া দেওয়া, আর মাদার গাছে বেঁধে বড়ইগাছের ডাল দিয়ে পেটানো−এগুলো তো আছেই। সেই ভয়ংকর অত্যাচারে জিন-ভুতের বাবার সাধ্য আছে থাকে? জিন-ভুতে পাওয়া রোগীকে মাঝেমধ্যেই মাদ্রাসায় নিয়ে আসা হতো−আমরা সুরা মুখস্থ করতে করতে দেখতাম রোগীকে গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে−আর সন্ধ্যার পর চিকিৎসার নামে শুরু হতো অত্যাচার। সব মিলিয়ে একেবারে ভয়াবহ ব্যাপার! এক কোরবানির ঈদের ঘটনা। ঈদের আগে মাদ্রাসায় ছুটি হয়েছে। মাদ্রাসার সবাই চলে গেছে, রয়ে গেছি খালি আমি আর মতিন। মতিনের বাড়িতে কেউ নেই, রোজা-রমজান বা ঈদের ছুটিছাটাতেও সে মাদ্রাসায় থাকে। আমার বাড়ি অনেক দুর−গয়না নৌকার সঙ্গে যোগাযোগ করে যেতে হবে, সে জন্য দেরি হচ্ছে। হুজুর করিমুল্লার বাসা মাদ্রাসার সঙ্গে লাগানো, সেখানে হুজুর তাঁর দুই বিবি নিয়ে থাকেন। সেই বিবিরা খুব পর্দানশিন। আমরা কখনো দেখি নাই। পরপুরুষদের মহিলাদের গলার আওয়াজ শোনা ঠিক না; কিন্তু আমরা শুনতাম দুই বিবি ক্যাট ক্যাট করে রাতদিন ঝগড়া করছে। হুজুর খেপে গিয়ে মাঝেমধ্যে তাঁর দুই বিবিকে শাসন করতেন, সেটা ছিল আরও ভয়াবহ ব্যাপার।
একদিন হুজুর করিমুল্লা তাঁর এক বিবিকে বাপের বাড়িতে রেখে আরেক বিবিকে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি গেছেন। আমার আর মতিনের ওপর পুরো মাদ্রাসার দায়িত্ব। হুজুর ফিরে এলে আমরা বাড়ি যাব। পুরো মাদ্রাসা খালি, গাছপালায় ঢাকা পুরোনো দালান, দিনের বেলাতেই অন্ধকার হয়ে থাকে। যখন অন্য ছাত্ররা ছিল, ভয়ডর করে নাই; কিন্তু একা কেমন জানি গা ছম ছম করে। মতিন ছিল বদমাইশের ঝাড়, দিনরাত খালি জিন-ভুতের গল্প করে ভয় দেখাত। আমি যে দিনের কথা বলছি সে দিন দুপুরবেলা দুরের কোনো একটা গ্রাম থেকে দুইজন মানুষ জিনে পাওয়া একটা রোগী নিয়ে এসেছে হুজুরের কাছে। যখন শুনল হুজুর নেই, তখন তারা একটু বিপদে পড়ে গেল−রোগী নিয়ে থাকবে না চলে যাবে বুঝতে পারছে না।
আমরা জিন-ভুতের রোগী দেখে অভ্যস্ত। রোগীগুলোর মধ্যে একটা মিল থাকে। সবাই কেমন যেন ভয়ের মধ্যে থাকে, হাত-পা কাঁপে, ভালো করে হাঁটতে পারে না, বিড়বিড় করে কথা বলে হাউমাউ করে কাঁদে। কিন্তু এই রোগীটা একেবারে অন্য রকম। দেখে মনে হয় পুরো স্বাভাবিক। রোগীর বয়স বেশি না, ২৩-২৪ বছর। গায়ের রং ফরসা, মাথার চুলগুলো একটু লম্বা। দেখে মনে হয় যাত্রাদলে অভিনয় করে। পায়জামা আর শার্ট পরে আছে, শরীরে একটা চাদর জড়ানো। মানুষটা বেশি কথা বলে না, কিন্তু কী রকম জানি মেরুদন্ড সোজা করে শক্ত হয়ে বসে থেকে শুধু এদিক-সেদিক তাকায়। চোখের দৃষ্টিটা একটু অন্য রকম, চোখে চোখ পড়লে কেমন জানি বুক কেঁপে ওঠে। মতিন সঙ্গের মানুষ দুইজনকে জিজ্ঞেস করল, ‘এই আপনাদের রোগী?’ মানুষ দুইজন মাথা নাড়ল। আমি বললাম, ‘দেখে তো কোনো সমস্যা আছে মনে হয় না।’ আমার কথা শুনে রোগী দাঁত বের করে হাসল, দাঁতগুলো লালচে দেখে কেমন যেন অস্বস্তি লাগে। মতিন বলল, ‘রোগীর কোনো সমস্যা নেই। নিয়ে যান।’ আমি বললাম, ‘হুজুর আসবে পরশু দিন, তখন আসবেন।
’ সঙ্গের দুইজন মানুষ নিজেদের মধ্যে বিড়বিড় করে কী যেন কথা বলে, আমাদের কিছু বলে না। একটু পর দেখি রোগীকে রেখে মানুষ দুইজন পালিয়ে গেছে। আমি আর মতিন তখন রোগীর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলাম। মতিন মানুষটাকে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনার সঙ্গে দুইজন কই?’ মানুষটা তার লাল দাঁত বের করে হাসার মতো ভঙ্গি করে বলল, ‘চলে গেছে।’ ‘কোথায় চলে গেছে।’ ‘মনে হয় বাড়ি চলে গেছে।’ ‘আপনাকে রেখে বাড়ি চলে গেছে?’ মানুষটা মাথা নাড়াল। বলল, ‘হ্যাঁ।’ ‘কেন?’ ‘ভয় পায় তো সেই জন্য।’ ‘আপনাকে ভয় পায়?’ ‘হ্যাঁ।’ ‘কেন? আপনাকে দেখে তো ভয় পাওয়ার কিছু আছে বলে মনে হয় না?’ মানুষটা কোনো কথা না বলে এদিক-সেদিক তাকাল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘আছে?’ ‘এখন নাই। তবে−’ ‘তবে কী?’ ‘রাতে যখন ও আসবে−’ ‘কে আসবে?’ ‘ও।’ ‘ও-টা কে?’ মানুষটা কথার উত্তর না দিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে রইল। মতিন তখন একটু রেগে উঠে বলল, ‘আপনি এখন যান। আপনার সঙ্গে যারা আসছে তাদের সঙ্গে বাড়ি যান।’ মানুষটা এমন একটা ভাব করল যেন মতিনের কথা শুনতেই পায় নাই। মতিন তখন গলা উঁচিয়ে ধমক দিয়ে বলল, ‘যান। বাড়ি যান।’ মানুষটা মাথা নাড়ল। বলল, ‘নাহ্। যাব না।’ ‘যাবেন না?’ ‘না।’
‘কেন যাবেন না?’ ‘জায়গাটা ভালো, আমার পছন্দ হয়েছে।’ ‘পছন্দ হয়েছে?’ ‘হ্যাঁ। অন্ধকার, লোকজন বেশি নেই। নিরিবিলি। ও যখন আসে, লোকজন থাকলে রাগ হয়।’ আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, ‘ও-টা কে?’ মানুষটা আমার কথার উত্তর দিল না। চাদর মুড়ি দিয়ে চুপচাপ বসে রইল। মতিন জিজ্ঞেস করল, ‘ও কেন আসে?’ ‘খিদে পায় তো, তাই খেতে আসে।’ ‘কী খায়?’ ‘রক্ত খায়।’ শুনে আমরা দুইজনই চমকে উঠলাম, ‘রক্ত খায়?’ মানুষটা তার দাঁত বের করে হাসল, দাঁতগুলো লাল। এবারে আমার গা ঘিন ঘিন করতে লাগল। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কিসের রক্ত?’ ‘যখন যেটা পায়। গরু-ছাগল।’ একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘মানুষ।’
আমি চিৎকার করে বললাম, ‘মানুষ?’ মানুষটা কোনো কথা না বলে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে, তার চোখের দৃষ্টি দেখে আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল। আমি আর মতিন নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করতে বসলাম। মতিন বলল, ‘এই লোকরে এইখানে রাখা যাবে না।’ আমি বললাম, ‘না। দিনের বেলাতেই দেখে এত ভয় লাগে, রাতে কী হবে?’ মতিন বলল, ‘আজ আবার অমাবস্যা।’ আমি বললাম, ‘চল, মানুষটাকে বের করে দেই।’ মতিন জিজ্ঞেস করল, ‘কোথায় বের করে দিবি?’ ‘ধরে নিয়ে বাজারে ছেড়ে দিব।’ আমার পরামর্শটা মতিনের পছন্দ হলো। বলল, ঠিক আছে। আমি আর মতিন তখন গেলাম মানুষটাকে ধরে বের করে দিতে, গিয়ে দেখি মানুষটা নেই। চারদিকে গাছগাছালি, ঝোপঝাড়। মাদ্রাসার ভাঙা দালানের মধ্যে কেউ যদি লুকিয়ে থাকে, তাকে খুঁজে বের করা অসম্ভব ব্যাপার। তবুও আমি আর মতিন চেষ্টা করলাম, কোনো লাভ হলো না। রাতের বেলা আমরা তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়েছি। আলো কমিয়ে হারিকেনটা মাথার কাছে রেখেছি, ঘরের ভেতরে আবছা অন্ধকার। বাইরে ঝিঁঝিঁ পোকা ডাকছে, গাছের পাতার শরশর একরকম শব্দ হচ্ছে। কাছাকাছি কোথা থেকে জানি শেয়াল ডাকল, শেয়ালের ডাক খুব ভয়ের−মনে হয় একটা খারাপ কিছু ঘটতে যাচ্ছে। শেয়ালের ডাকটা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা শুনলাম, উঁ উঁ করে কে যেন কান্নার মতো শব্দ করছে। প্রথমে আস্তে আস্তে, তার পরে একটু জোরে। একটু পরে আরও জোরে। আমি আর মতিন দুইজনেই তখন বিছানায় উঠে বসলাম।
মতিন জিজ্ঞেস করল, ‘কে? কে কাঁদে? আমি বললাম, ‘ওই মানুষটা হবে নিশ্চয়ই।’ ‘কোথায় আছে দেখবি?’ আমি বললাম, ‘যদি কিছু করে?’ ‘কী করবে? আমরা দুইজন আছি না?’ সেটা অবশ্য সত্যি কথা, আমরা দুইজন, পনেরো-ষোল বছর বয়স। গ্রামের ছেলে, হাট্টাকাট্টা জওয়ান আমাদের কী করবে? খুঁজে খুঁজে ঘরের ভেতর থেকে দুইটা লাঠি বের করে হারিকেনটা হাতে নিয়ে বের হলাম। ঘর থেকে বের হতেই শব্দটা থেমে গেল। একটু পরে আবার শুরু হলো। প্রথমে আস্তে, তার পরে একটু জোরে। শব্দটা শুনতে শুনতে আমরা এগিয়ে যাই, দালানটার শেষ মাথায় একটা ছোট ঘর, পুরোনো বই-খাতা জঞ্জাল দিয়ে ভরা, মনে হচ্ছে শব্দটা সেখান থেকে আসছে। আমরা ঘরটার দরজা ধাক্কা দিয়ে খুলে ভেতরে ঢুকে একেবারে হকচকিয়ে গেলাম। ঘরের জঞ্জাল পরিষ্ককার করে সেখানে সাদা চাদরটা বিছিয়ে মানুষটা উদোম হয়ে শুয়ে আছে−দুই হাত, দুই পা লম্বা করে ছড়িয়ে রেখেছে। তার মুখ ঘামে ভেজা আর সেখান থেকে কান্নার মতো শব্দ বের হচ্ছে।
মতিন জিজ্ঞেস করল, ‘কী হচ্ছে? কী হচ্ছে এখানে?’ মানুষটা ভাঙা গলায় বলল, ‘ভয় করে। আমার ভয় করে।’ ‘কী ভয় করে?’ ‘ওরে ভয় করে।’ ‘কেন ভয় করে?’ ‘আমারে খুব কষ্ট দেয়।’ ‘তাহলে ওকে আসতে দেও কেন?’ মানুষটা কোনো উত্তর দিল না। মতিন আবার জিজ্ঞেস করল, ‘কেন আসতে দাও?’ ‘না দিয়ে উপায় নাই। লোভে পড়ে বিক্রি করে দিছি।’ ‘কী বিক্রি করেছ?’ ‘শরীরটা। এই শরীরটা। এখন দরকার হলে ও ব্যবহার করে।’ ‘কী করে ব্যবহার করে?’ ‘জানি না। একেক সময় একেকটা করে। খায়, অত্যাচার করে। আমি তো জানি না।’ আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘খালি গায়ে শুয়ে আছ কেন?’ ‘গরম। অনেক গরম।’ পৌষ মাসের কনকনে শীত, আমরা চাদর মুড়ি দিয়ে আছি, তার মধ্যে এই মানুষটার গরম লাগছে। ঘামে শরীর ভিজে জবজবে হয়ে আছে। আমি আর মতিন একজন আরেকজনের দিকে তাকালাম, ঠিক কী করব বুঝতে পারছিলাম না।
মতিন বলল, ‘আয়, আমরা যাই।’ মানুষটা বলল, ‘দাঁড়াও।’ ‘কী হয়েছে।’ ‘তোমরা একটা কাজ করো।’ ‘কী কাজ?’ ‘আমাকে বেঁধে রেখে যাও।’ ‘বেঁধে রেখে যাব?’ ‘হ্যাঁ।’ মানুষটা বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে বলল, ‘আমাকে শক্ত করে বেঁধে রেখে যাও। আল্লাহর কসম লাগে।’ ‘কেন?’ ‘তা না হলে তোমাদের বিপদ হবে−অনেক বিপদ। সময় নাই−তাড়াতাড়ি। ও আসছে।’ এই মানুষটার কথা ঠিক বিশ্বাস করব কি না বুঝতে পারছিলাম না; কিন্তু কোনো কারণ নেই, কিছু নেই, একটা মানুষকে বেঁধে রাখে কেমন করে? আমরা কী করব ঠিক বুঝতে পারছিলাম না, তখন খুব অদ্ভুত একটা ব্যাপার ঘটল। হঠাৎ করে চারদিক কেমন যেন নীরব হয়ে গেল−প্রথমে আমরা বুঝতে পারলাম না কেন, একটু পর টের পেলাম ঝিঁঝিঁ পোকাগুলোও থেমে গেছে, গাছের পাতার শরশর শব্দও শোনা যাচ্ছে না। এতক্ষণ মানুষটা ছটফট করছিল, হঠাৎ করে সে-ও একেবারে থেমে গেছে, শক্ত হয়ে শুয়ে আছে। আমি আর মতিন নিঃশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছি−হঠাৎ মনে হলো বাইরে দিয়ে কে যেন এক মাথা থেকে অন্য মাথায় দৌড়ে গেল।
গাছের ওপর কিছু পাখি ছিল, পাখিগুলো কিচিরমিচির করে উড়ে গেল। একটু পরে আমরা আবার পায়ের শব্দ শুনতে পেলাম, মনে হলো দুদ্দাড় করে কেউ ছুটে আসছে। আমরা যে ঘরে দাঁড়িয়েছিলাম হঠাৎ সেই ঘরের দরজা দড়াম করে খুলে গেল, মনে হলো ঘরের ভেতর আগুনের হলকার মতোন একটা গরম বাতাস ঢুকেছে। তখন আমার জীবনের সবচেয়ে অবাক ব্যাপারটা ঘটতে দেখলাম, চিৎ হয়ে শুয়ে থাকা মানুষটার পুরো শরীর হঠাৎ করে ছিটকে ওপরে উঠে গেল। মনে হলো তার সারা শরীরের ভেতরে যেন কিছু কিলবিল করছে। মানুষটার শরীরটা কয়েক সেকেন্ড ওপরে ঝুলে থেকে হঠাৎ আছাড় খেয়ে নিচে এসে পড়ল। মানুষটা গোঙাতে থাকে। আমরা বিস্কারিত চোখে দেখলাম তার চেহারাটা অন্যরকম হয়ে যাচ্ছে। চোয়ালের হাড়গুলো উঁচু হয়ে উঠল, মনে হলো চোখ দুটো কোটর থেকে বের হয়ে আসবে। জিব লম্বা হয়ে মুখ থেকে বের হয়ে আসে, মাঢ়ি উঁচু হয়ে দাঁতগুলো মুখের বাইরে চলে আসে।
মানুষটার সারা শরীর কেমন যেন দোমড়াতে-মোচড়াতে থাকে। আমি ও মতিন ভয়ে আর আতঙ্কে একেবারে পাথরের মতো জমে গেছি, নড়তে পারছি না। আমার হাতের হারিকেনটা বারকয়েক দপদপ করে জ্বলে উঠে নিভে গেল। ঠিক নিভে যাওয়ার আগে আমার মনে হলো মানুষটা কুকুরের মতো উঠে বসেছে, তারপর আমাদের দিকে লাফ দিয়েছে। আমি চিৎকার করে ঘরের দরজা খুলে বের হয়ে ছুটতে শুরু করলাম। পাগলের মতো ছুটছি আর ছুটছি। মনে হচ্ছে আমার পেছনে পেছনে লক্ষ লক্ষ জানোয়ার ছুটে আসছে, এই বুঝি আমাকে ধরে ফেলবে! ছুটতে ছুটতে আমি নিশ্চয়ই হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলাম, তার পরে আমার আর কিছু মনে নাই। গহর মামা এই রকম সময়ে তাঁর কথা শেষ করে কান চুলকাতে লাগলেন। আমরা নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসেছিলাম। এবার জিজ্ঞেস করলাম, ‘তার পরে কী হলো মামা? কী হলো?’ ‘সকাল বেলা লোকজন আমাকে পেয়েছে। জ্ঞান নাই, মুখ দিয়ে গ্যাজলা বের হচ্ছে।’ ‘গ্যাজলা কী মামা?’ ‘গ্যাজলা চিনিস না? লালার মতোন। অনেক ভয় পেলে মুখ দিয়ে বের হয়।’ ‘তারপর কী হলো? তোমার গল্প শেষ করো মামা।’ ‘গল্প তো শেষ। অনেক দিন জ্বরে ভুগে আমি সুস্থ হয়েছি। তবে একটা লাভ হয়েছে।’ ‘কী লাভ হয়েছে মামা?’ ‘আমার আর মাদ্রাসায় যেতে হয় নাই।’ ‘আর মতিন? মতিনের কী হলো?’ গহর মামা কোনো কথা না বলে খুব মনোযোগ দিয়ে কানে একটা আঙুল ঢুকিয়ে চুলকাতে লাগলেন। আমরা আবার জিজ্ঞেস করলাম, ‘মতিনের কী হলো মামা?’ ‘যা-যা, ঘুমাতে যা।’
‘কিন্তু মতিনের কী হলো?’ ‘যা হবার হয়েছে, তোরা শুনে কী করবি?’ ‘কী আশ্চর্য!’ আমি অধৈর্য হয়ে বললাম, ‘একটা গল্প শুরু করেছ, সেটা শেষ করবে না? সব গল্পের একটা শেষ থাকে, তুমি জানো না?’ ‘থাকলে থাকে। আমার গল্প যেটুকু বলেছি, সেটুকুই।’ আমি বললাম, ‘ঠিক আছে, তাহলে আমি বাকিটা বলি?’ গহর মামা বললেন, ‘বল।’ ‘পরদিন সকালে মতিনের ডেডবডি পাওয়া গেছে। শরীরটা সাদা আর ফ্যাকাসে। কোনো রক্ত নাই−’ গহর মামা চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকালেন। কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেলেন।
আমি বললাম, ‘আর সেই মানুষটা−’ ‘মানুষটা কী?’ ‘মানুষটা ভালোই আছে। মোটাতাজা হয়েছে।’ ‘কেন? মোটাতাজা কেন হয়েছে?’ ‘রক্ত খুব ভালো প্রোটিন মামা, তুমি জানো না?’*