আবিরদের সদ্য কেনা সাদা গরুটি দেখেই মনটা খারাপ হয়ে যায় রন্টির। রন্টি- আবিরের বন্ধু। একই ক্লাসে পড়ে ওরা। গলায় গলায় ভাব দু’জনের। কিন্তু বিবির হাট থেকে গরুটা আনার পর আবির যেন অন্য রকম হয়ে যায়। শুধু রন্টি কেন, কোনো বন্ধুকেই পাত্তা দিচ্ছে না সে। সারাক্ষণ শুধু গরুর পিছনেই লেগে আছে। তাদের গরুটি পাড়ার কোরবানের জন্যে এ পর্যন্ত কেনা সবার গরু থেকে সেরা গরু। এ কথাটিই শুধু সে ইনিয়ে বিনিয়ে বন্ধু মহলে বলে বেড়াচ্ছে। তার বলার ধরনটা অনেকটা অহংকারী টাইপের।
শুনলেই গায়ে জ্বালা ধরে। কাল দুপুরে গরুটা দেখতে গিয়েই মনটা বিগড়ে যায় রন্টির। কোথায় তাকে একটু বসাবে, চা-নাস্তা খাইয়ে খাতির যত্ন করবে তা না উল্টো কিনা সে বলে, তোদের গত বারের গরুটি না খুব পিচ্চি এবং রুগ্ন ছিল। এবার আঙ্কেলকে বলিস বড় থেকে একটা গরু কেনার জন্যে। আবিরের ঠোঁট বাঁকানো কথার উত্তর দিতে গিয়ে থমকে যায় রন্টি। গেলো বছর আববু- ছোট বাচ্চুর সাথে শেয়ার করে ছোট্ট একটি সুন্দর গরু দিয়ে কোরবানি করেছিলেন বটে। সে গরুটির গায়ে রং ছিল লাল। শিং ছিল ঈষৎ বাঁকানো। দেখলেই মনে হতো যেন একটি ঢাউস হরিণ। গরুটি পেয়ে রন্টি আর চাচাত ভাই মন্টি যা না খুশি হয়েছিল। গরুকে খৈল-ভুঁষি খাওয়ানো থেকে শুরু করে গোসল পর্যন্ত করিয়ে দিত তারা। ছোট বোন নাতাশা হীরা ভাইকে দিয়ে বাঁকানো শিং-এ কাগজের ফুল কিনে গেঁথে দেয়। ছোট্ট লাল গরুটি তখন আদর পেয়ে মাথাটা দুলাতে থাকে। রন্টির মনে পড়ে, কোরবানির আগের দিন রাতের কথা। সে রাতে রন্টি, মন্টি, হীরা ভাই, ছোট বোন নাতাশা কেউ তারা ঘুমায়নি।
বাড়ির বৌ-ঝি’রা চালের গুড়ো দিয়ে রুটি বানাতে ব্যস্ত। ছোট চাচ্চু কিরিচে শান দিচেছন। কাজের ছেলে আনিস হঠাৎ দেŠড়ে এসে রন্টির কানে কানে বলল, ভাইয়া আমাদের গরুটি না কিছুই খাচ্ছে না। আমার মনে হয় সে সবকিছু জেনে গেছে। আনিসের কথা শুনে রন্টির বুকটা ছেঁৎ করে উঠলো। তড়াক করে লাফ দিয়ে সিঁড়ি ভেঙে রন্টি গরুকে দেখতে চলে যায়। পিছন পিছন মন্টি ও নাতাশা যোগ দেয়। রন্টি পরম মমতায় গরুটির গায়ে হাত বুলিয়ে দেয়। একটু খেয়াল করতেই ওরা দেখলো, লাল গরুটির দু’চোখ জলে ভেজা। দৃশ্যটি দেখে নাতাশার মনটা বিষিয়ে উঠে। ফুঁপিয়ে কেঁদে নাতাশা বলে উঠলো, ভাইয়া আমরা লাল গরুটিকে কোরবানি দেব না। লাল গরুটিকে আমরা পালন করব। সে রাতে নাতাশার বাঁধ ভাঙা কান্না দেখে মা তাকে কোলে তুলে নিয়ে অনেক সান্ত্বনা দেয়। বলে, কোরবানি দেওয়ার জন্য নিয়ত করে আনা গরু কোরবানি না দিলে আল্লাহ্ অখুশি হবেন।
তখন আমরা হব গুনাহ্গার। শেষ পর্যন্ত প্রিয় লাল গরুটিকে কোরবানি দেয়া থেকে আমরা রক্ষা করতে পারিনি। নাতাশাতো লাল গরুটির মাংস ছুঁয়েও দেখেনি। সারাদিন শুধু মনমরা হয়ে থেকেছিলো। ঝুল বারান্দা থেকে আবিরের মা’র ডাক পাড়ে, বাবা রন্টি চা খেয়ে যেও। কাল আসবে বলেই রন্টি যেন পালিয়ে বাঁচে। আবিরদের গেইট পেরিয়ে রাস্তায় নেমে আসে রন্টি। তাদের ভালোবাসার লালগরুটি সম্পর্কে আবিরের বিরূপ মন্তব্য শুনে তার মনটা ভারি হয়ে ওঠে। রন্টি ভাবে, বন্ধুর মন এমন নিষ্ঠুর হয় কি করে?