আকাশে তেমন মেঘ নেই , তারপরেও সারাটা দিন ধরে বৃষ্টি । এত পানি আকাশের কোন কোনায় জমা হয়ে এতদিন ছিল তা সবাই ভাবছে । বর্ষার শেষ হলো সেই কবে এরপরেও যদি মেঘ দেবতা মানুষের দৈনন্দিন কাজে বাধা দেবার জন্যে এভাবে উঠে পরে লাগেন তাহলে মানুষের আর কি ই বা করার থাকে? কেউ কেউ বলল এই যে বৃষ্টি শুরু হলো তা তিন দিন ধরে একটানা চলবে । আরেক জন বলল না না তিন দিন খুব মনে হচ্ছে । মাত্র তিন দিনে মেঘ দেবতার সখ মিটবে বলে মনে হয় না । সব কিছু ঠিক ঠাক থাকলেও সাত আট দিন নিয়ে টান দিতে পারে। আরেক জন বলল বাবা, আদার ব্যাপারি হয়ে জাহাজের খবর নিচ্ছ কেন ? মেঘ দেবতার ইচ্ছে হয় তিন দিন চালাবেন না হয় সাত দিন চালাবেন , এতে তোমাদের কি ? হো ?তোমাদের ভেজা দরকার তোমরা ভেজ , ইচ্ছে না করলেও ভেজ ।
ঘর বাড়ি , গরু ছাগল মাঠের ফসল সব বৃষ্টির ডাকে আসা বন্যায় ভেসে যাবে তা অসহায় হয়ে দেখ , মন না চাইলেও দেখ । কেন অযথা মেঘের খবর মাটিতে বসে নিতে চাইছো ? পারবে মেঘের কিছু করতে? না পারবে মেঘকে ছুইতে না পারবে মেঘকে লাটি দিয়ে পুকুরের কচুরীফেনা সরানুর মত সরাতে। পারবে বল? তারচেয় বরং দেখাই ভাল যে কীভাবে মাথার উপরে বসে বসে আমাদের কান্না দেখার জন্যে মেঘের বৃষ্টি কতদিন চলে। সাত দিন কেন শুনেছি মাস খানেক নাকি এ বৃষ্টি চলবে। এই কথা বলে লোকটি এমন ভাব নিলো যেন এই মাত্র মেঘ থেকে দুনিয়ায় নেমে এসেছে। তাও আবার এই খবর টুকু সবাইকে জানানুর জন্যে। সবই তার কৃপা ।উপরের কৃপা থাকিলেই নিচ থেকে মানুষ খবর টবর জানতে পারে , তা না হলে উপরে কখন কি হয় তা নিচ থেকে কে কীভাবে জানবে ?অথচ কত সহজেই না উপর থেকে নিচের হাড়ির সব খবর কত সুন্দর ভাবে সবাই জেনে যায় । বৃষ্টি কতদিন চলবে তা যাদের মাথা ব্যথা আছে তারাই ভাববে । বরং বৃষ্টি আছে বলে খুব খুশি হয়েছে এ গ্রামের অলস জোয়ান কিছু ছেলে, আহ্লাদি সেই বউ , যে সামান্য কিছু হলেই ওমাগো, ও মাইগো বলে চারদিক ফাটিয়ে বলে, অপেক্ষায় তাকে কখন স্বামী খুব আদর করে নিজের মাকে অর্ডার দিয়ে বলবে , মা আজ বাইরে যে বৃষ্টি হচ্ছে তাতে তোমার বউয়ের চলা ফেরা করা ঠিক হবে না। কোন জায়গায় কোন হোচুট খায় কিবা পা পিছলে পরে যায় তা কে জানে।তাতে তোমার বউয়ের কোন ক্ষতি না হলেও ক্ষতিটা হবে তোমার অনাগত নাতি বা নাতনীর । নিজের মাকে আর কি এত কিছু বুঝিয়ে বলতে হয় । ছেলে বলেছে তা এ যুগেত করতেই হবে , কারন মায়েরা জেনে গেছে অনেক আগেই, ছেলের বিয়ের পর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পিতা মাতা ডিমের খোলস ছাড়া আর কিছু নয় । তাই আজকালের মায়েরা সব কিছু মেনে নিয়েই খুব সহজে সব বুঝে নেয়। তবে এ বৃষ্টি যাদের মনে খুব আনন্দের দোলা দেয় তারা হল গ্রামের সহজ সরল শিশু কিশোররা । স্কুলে যেতে হবে না, স্যারদের গ্যান গ্যানানি শুনতে হবে না, পথে ঘাটে হৈ হুল্লোর করে লাফা লাফি করা যাবে, লুকিয়ে লুকিয়ে বৃষ্টির পানি ডুবা মাঠে ফুটবল খেলা যাবে । আর কি চাই জীবনে। এ যে তাদের জীবনে বড় এক আশীর্বাদ । এ বৃষ্টি ছাড়াও দেশে হরতাল নামে আরেক আজব শব্দ আছে । যা আসলেই গাড়ি ঘোড়া সব থেমে যায় , এমনকি রাস্তার আশে পাশে যে চায়ের দোকান গুলো আছে তাও বন্ধ হয়ে যায় ।
যে ফেরিওয়ালার জন্যে গ্রামের ছেলে মেয়েরা অপেক্ষার দিন গুনে সে ফেরিওয়ালাও যথা দিনে আসে না। বুট বাদাম , চানাচুর , জ্বাল মুড়ি কিছুই খাওয়া হয় না তাদের । হরতালের নাম শুনলেই যা কিছু ঘটে তা গ্রামের ছেলে মেয়েরা দেখেছে সেই কয়েক বছর আগে হওয়া এক বিশাল ঘূর্নিঝড়ের সময় । সেই ঘূর্নিঝড়টাকেও কেউ বলত সিডর , কেউ বলত আইলা, আবার কেউ কেউ বলত আইরা। পপি নামের দশ বার বছরের মেয়ে কানা মাছি খেলার সময় হোট করে তের বছরের ছেলে বিমল কে জিজ্ঞাসা করেছিল একদিন, আচ্ছা বিমল শুন হরতাল কি রে? বিমল মুখটা বাকিয়ে ভ্রু কুচিয়ে উত্তর দিয়েছিল জানি না , তবে দাদি যে বলেছিল তুফানের কথা সেই একটা তুফানের নাম হতে পারে। হে আমি বললাম দেখিস হরতাল তুফানই হবে। দেখিস না হরতাল হলে তুফানের মত কোন গাড়ি ঘোড়া চলে না । দোকান পাট খুলে না। তা হয় , কই হরতাল হলে তো আর বৃষ্টি হয় না । হয় বৃষ্টিও হয় । তবে আমরা তা কেউ দেখি না। আকাশের মাঝে কেবল হয় । আর হরতাল তুফান না হইলে আমার বাবা তা কোন দিন ভয় পাইত না। তুই জানিস আমার বাবা কিছুই ভয় পায় না । কেবল তুফান ছাড়া । আমার বাবাও কোনদিন সে তার দোকান বন্ধ রাখে না কেবল তুফান ছাড়া । তুই ঠিকই বলেছিস হরতাল তুফানই হবে। এই বাচ্চা দুটি সেদিন কি আলাপ করেছিল পাঠক আমরা আর জানতে চাই না, বাচ্চা সুলভ মন হয়তো একদিন জেনে যাবে সবকিছুই। সেদিন হয়তো লজ্জায় তারা মনে মনে তাদের পূর্ব পুরুষদের সাথে নানান কিছু বাকবিতন্ডা ভদ্রতার সাথেই করবে। আর ভেবে ভেবে বলবে,হায়রে আমার পূর্বপুরুষ!!!এভাবে ভাববে আর দীর্ঘশ্বাস ফেলবে, ভাববে আর দীর্ঘশ্বাস ফেলবে। জানি না সেদিন আমাদের অবস্থা তাদের কাছে কেমন হবে? তবে বিশ্বাস আপনাদের সাথে আমারো এই যে সেদিন আমরাও তাদের কাছে তুফানের চেয়ে ছোট কিছু হব না। আজ যে বৃষ্টি আকাশে ভেংগে নেমেছে সে এক আসেনি । মুষলধারের সাথে সাথে নিয়ে এসেছে হরতালো। এঈ দুটি ছুটির আনন্দ পপি কিবা বিমলদের জীবনে খুবই কমই আসে। আসলেও যে তারা নেচে গেয়ে হাসি খুশিতে মনের মত উপভোগ করতে পারে তা কিন্তু নয় । একটা না একটা কাজ ওদের অভিভাবক ওদের উপর চাপিয়ে দেয়। পপির মা বলেন, পপি ছুটি হয়েছেতো কি হয়েছে যা পড়তে বস। নামতা গুলো শেষ মুখস্থ কর। ওমুকের ছেলে কত সুন্দর করে টিয়া পাখির মত সব বলে ফেলে আর তুই এখন তিনের ঘরের নামতাই পারস না। মা কে বাধা দিতে গিয়ে যদি পপি বলে নামা আমি পারি , তাহলে বলবে , বল দেখি এখন। তখন পপি বলা শুরু করে এভাবে, তিন একে তিন তিন দুগুনে ছয় তিন তিনে নয় তিন চারা বিশ তিন পাচা পঁচিশ অমনি দু একটা ঠাস টোস শব্দের সাথে পপির কান্না বাতাসে ভেসে যাবে।আর পপির মায়ের গর্জনের সাথে সবার কানে পৌছে যাবে এই একটি আদেশ, ছুটি হয়েছোত কি হয়েছে যা পড়তে যা, বস গিয়ে এখনি। ছুটি যে কি জিনিস তা ঘরের গৃহিনীরা কোনদিন জানে নি বলে কাউকে জানাতেও চায় না। এই কর ঐ করো বলতে বলতে পরিবারের বাকি মানুষের ছুটিকে পুড়া রুটি বানিয়ে আরামের সময় ব্যারামের গান জুরে দেয়। ভাগ্য ভাল এই জন্যে যে পপিদের ঘরে পপি আর পপির মা ছাড়া কেউ নেই।
মায়ের কাছে পপি শুনেছে আর কেদেছে এই জেনে যে, এক হরতাল তুফানে বাসের মধ্যেই পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছে তার বাবা। কবে যে সে তার বাবাকে বাবা ডেকেছিল বা আদৌ নিজের বাবাকে সে দেখেছে কিনা তা পপির জানা নেই । খুব কষ্ট করে বাবার মুখ খানি যখন মনে মনে দেখতে চায় তখন নানান চেহারার হিজিবিজি দেখে সে বাবা বাবা বলে কেদে উঠে। জানি না বাবা হারানুর দুঃখ এই ছোট মেয়েটির মনে সমাজের বাকি সবার বাবা হারানুর মত কিনা?কিন্তু এ জানি যে বাবা কি জিনিস তা পপি নামের ছোট মেয়েটি জানে না। জানলে মাঝে মাঝে নিজের গাল টা হাতিয়ে হলেও বাবার হাতের ছুঁয়ার কথা ভাবতে পারত, কিবা বাবা যে বিছানায় ঘুমাত সে বিছানার দিকে তাকিয়ে হলেও, ও বাবা ,বাবাগো বলে চিৎকার করে না হোক ফুফিয়ে ফুফিয়েও হলেও কাদতে পারত। বাবা হীন জীবন যে কত কষ্টের তা যাদের জীবনে ঘটেছে কেবল তারাই বুঝতে পারবে। কিবা বাবা না থাকলে কি হবে সাহস করে তা যারা কল্পনা কোরতে পারবে কেবল তারাই জানবে বাবা হারানুর ব্যথা জীবনকে কত অসহায় করে দেয়।এতো গেল পপির কথা কিন্তু তার খুব কাছের খেলার সাথী বিমল তার অভিভাবকগন তারা কি করেন বিমলের সাথে। বিমল সে কতটা ভাল ছেলে তা আমি বললে একটু বেশিই বলা হয়ে যাবে। তবে প্রায়ই পাড়া প্রতিবেশিদের কাছে শুনি এতটুকু বয়সে এত ভাল ছেলে কেউ কারো জনমে দেখে নি ।একবছরের বাচ্চা রেখে মা টা মারা গিয়েছিল। মা মরা বাচ্চাকে নিয়ে বিমলের বাবার যতটা কষ্ট হওয়ার কথা ছিল ততটুকু নাকি হয় নি। সেই ছোটকাল থেকেই বাবা তাকে যা বলেছে তা সে অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে। এমনকি যখন সে কিছুটা বড় হলো তখন সে রান্না বান্না থেকে ঘরের সব কাজে বাবাকে সহযোগিতা করত। বাবা যদি রান্না করতে বসেছে তাহলে সে নিজের ইচ্ছায় গিয়ে বলত বাবা তোমার পিয়াজ টা কেটে দিব। এতটুকু বাচ্চা বাবার দুঃখ বুঝতে পেরে বলে পিয়াজ কেটে দেবার কথা? তা শুনে দুনিয়ার কোন মানুষটি কেদে উঠবে না? কোন পাষানীর বুক গলে চোখ দিয়ে পানি বের হবে না? কোন সীমার কিবা ডাকাতের হাতের তলোয়ারো মাটিতে পরে যাবে না ?কোন পশু পাখিটিও বলো এই বাচ্চার মুখে এই কথা শুনে ভেতরে ভেতরে কেদে ফেলবে না?
দুনিয়া যদি আজো দুনিয়া থাকে তাহলে সবাই এই বিমলের কথা শুনে নিজের লোমটা সামলাবে দূরের থাক মনটাকে বেধে রাখতে পারবে না। সেদিন বিমলের বাবাও পারে নি , তাই কেবল বিমলের কথা ভেবেই আরেকবার আরেকটি বিয়ে করেনি । তবে মায়ের আদরে যাতে কোন ব্যঘাত না ঘটে সেজন্যে সে মাঝে মধ্যে পপির মাকে বলত, বৌদি মা মরা ছেলে। যদি একটু পপির মা বিমলের বাবার মুখের কথা শেষ না হতেই বলেছিল, ভাইরে দুখিনী বুঝে দুঃখের বেদন । আমাকে আর বলতে হবে না। আজ থেকে পপি শুধু একা নয় এই বিমলও আমার আরেকটি সন্তান। সেই থেকে বিমল আর পপি এক রক্তের না হয়েও খুব কাছা কাছি থেকে বড় হচ্ছে। সেই সাথে সাথে ওদের বাবা কিবা মায়ের মনেও নানান স্বপন নানা বাস্না লতা পাতার মত গজাচ্ছে। কিন্তু কার মনে কি আছে তা পপি আর বিমল জানে না। তারা জানে দুজনে একসাথে খেলা করলে খেলার মজাটাই হয় আলাদা। তাই তারা আজ এই পথ ঘাট ভাসানি বৃষ্টিতে খেলার জন্যে কাউকে কিছু না বলেই সোজা গ্রামের পাশ দিয়ে চলে যাওয়া যোগিনীর খালে গিয়ে ঝাপ দিল। এই ঝাপের শব্দ বৃষ্টির শব্দকে হার মানায় নি বলে রক্ষা । নয়তো পপির মা , বিমল কইরে? ও ও বিমল।কিবা পপি কইরে ও পপি কই গেলি ? বলতে বলতে ঠিকই এখানে এসে হাজির হত। কিন্তু না তা আজ হবার সূযোগ নেই । কারন জীবনের এই প্রথম তারা তাদের বাবা মাকে না বলে বৃষ্টির সাথে খেলতে এসেছে, হরতালের ছুটি ঊপভোগ করতে এসেছে। অনেকক্ষন সাতার কাটা কাটি শেষ হলে কয়েকটা কচুরী ফেনা হাতে নিয়ে পপি বলল চল মাছ ধরি ? কোথায় ধরবি ? কোন উত্তর পপির কাছ থেকে পাওয়া গেল না। সোজা বিমলের হাতটা ধরে দৌড়াতে দৌড়াতে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। ও মা এ আর কোথায় ? এ তো বিমল জানতই। সে কতবার ওর বাবার সাথে এখানে মাছ ধরতে এসেছে!! ছোট্ট একটা নালা কয়েকটা ধানি জমির বুক বেয়ে বড় একটা পুকুরে নেমে গেছে। আর সেই নালা দিয়ে বৃষ্টির পানি এত বেগে নামতেছে যে মনে হচ্ছে পাহাড় ভেংগে পানি নামতেছে। তবে পাহাড় ভেংগে নামা পানিতে নানা বালু কনা মিশ্রিত থাকলেও এই নালার পানি এতই পরিষ্কার যে যতটা পুটি মাছ সেখানে দৌড়াচ্ছিল তা সবই দেখা যাচ্ছে। বৃষ্টির চপ চপ শব্দের কারনে সেই মাছ গুলান বিমল আর পপির পায়ের শব্দ বুঝতে পারে নাই বলেই তারা দুজনে বেশ ঝাপা ঝাপি করেও কয়েকটা মাছ ধরতে পারলো । পরে যদিও পপি তার গায়ের জামাটা মেলে জালের মত ধরে রেখেছিল নালার মুখে তবে এতে কয়েকটা চিংড়ির বাচ্চা ছাড়া আর কিছুই মিলে নি। অপরদিকে বিমল তার শার্ট টা খুলে শার্ট টা দিয়েই অনেকক্ষন জাল টানল ,না কয়েকটা ব্যংগের বাচ্চা ছাড়া সে আর কিছুই পায় নি ।
তবে দুজনে যতগুলো মাছ ধরেছে তা তাদের জন্যে যথেষ্ট। মাছ ধরা শেষ হয়ে গেলে , দু জনেই দুজনকে জিজ্ঞাসা করল, মাছ গুলান দিয়ে তারা কি করবে? এটাই দুনিয়ার নিয়ম যাদের হাতে যা মানায় না তাদের হাতে তা পড়লে যে মহা চিন্তার উদয় হয় , হয়ে এতে রাবন পুরী পূনবার নির্মান হয় না হয় রাম দ্বারা সব পুড়ে ছাড়খার হয়ে যায় ।অনেক চিন্তা ভাবনা করে দুজনেই ঠিক করল , যেহেতু পপিও পপির মাকে বলতে পারবে নে যে সে আজ কোথায় ছিল সেহেতু সে মাছগুলো নিজেই রান্না করবে। যেই কথা সেই কাজ। মাছ রান্না হবে সেই সাথে বিমলও কিছু একটা রান্না করবে। হয়তো আলু সিদ্ধ করে কাচা মরিচ আর পেয়াজ মাখিয়ে ভর্তা, সঙ্গে যদি একটু সরিষার তেল দেওয়া যায়, ট্যাট্যা যা হবে না!!! একেবারে ফাটাফাটি । খুব গর্ব করে বিমল বলল, পপি আমি এমন ভর্তা বানাবো না যে , তোই তোর হাত ছাটতে ছাটতে একসময় আঙ্গুল গুলান আর খুজে পাবি না! ও তাই? হ্যা হ্যা হ্যা। তাহলে আর বানাস না। আমার আঙ্গুল গুলান এমনিতে খুব সাদ । আমি তোর আলু ভর্তা না খেয়ে আঙ্গুল গুলোই চুষব। কেমন? মাঝে মাঝে পপি এমন কথা বার্তা বলে যে মনে সে আইদ্যা কালের পাইদ্যা বুড়ি।না জানি কত জনমের আগেকার কথা মনে করে করে সে মাঝে মধ্যে কথা বলে।বিমল তা ভাবে কিনা তা বিমলই জানবে অন্য কেউ নয় । তবে মাছ ধরে বাড়ির কাছা কাছি সাপের মত পথ টার উপরে আসলে বিমল সাপ সাপ বলে লাফাতে লাগল। যেমনি সাপ শব্দটি পপির কানে পৌছল ওমনি সে দু চোখ বন্ধ করে এক জায়গায় মূর্তির মত দাঁড়িয়ে চিতকার কোরতে লাগল।তবে মুখ দিয়ে আর সাপ শব্দটি বলতে পারল না। ভয়ে কাতর হয়ে সাপের বদলে বাপ বাপ বাপ বাপ বাপ বাপ বলতে লাগল। পপির এই কান্ড দেখে বিমল হাসতে হাসতে মাটিতে গড়া গড়ি দিয়ে বলল, এই পপি তুই বাপ বাপ বলছিস কেন? তখনো পপি বাপ বাপ বাপ বলছে। কিছুক্ষন পর কি জানি কি বুঝতে পেরে সেও হাসতে লাগলো। হাসতে হাসতে বলল না আমি বাপ বলি নি ,বলেছি সাপ। না তোই বাপ বলেছিস না সাপ বলেছি না বাপ না সাপ না বাপ না সাপ এভাবে দূজনের মাঝে তর্ক চললেও বেশিক্ষন স্থায়ি হল না। কারন রান্নার তাড়া যে দুজনের পেছনে চুম্বকের মত টানতেছে। এমন গৃহ গৃহ খেলার সুখ যে কত অনাবিল তা যারা জীবনে খেলেনি তারা জানবে না। পিপড়ার মাটি দিয়েও যদি রান্না রান্না খেলা যায় তখন মনের ভেতরে যে সুখ পাওয়া যায় তা তে বয়স তাড়াতাড়ি বাড়ে না কেন তার জ্বালাটাও টের পাওয়া যায়।
যাহোক দুজনেরই যখন রান্না প্রায় শেষ তখন, বিমল বলল ভাগ্যিস আজ বাবা বাড়িতে নেই। তাহলে আমরা কোথায় রান্না করতাম পপি বলল হ্যারে কাকু থাকলে কিছুই হত না। পড়তে বসত হত। তারপর কিছুক্ষন পাকা গৃহিনীর মত এদিক সেদিক তাকাইয়া বলল চল খেতে বসি। থালা গুলো আমি সাজিয়ে দিচ্ছি তুই হাত পা ধুয়ে আস। বিমল মাথা নেড়ে গৃহকর্তার মত বুঝিয়ে দিল সেও খাবার ভোজন করবার জন্যে প্রস্তুত । খাবার খেতে বসে বিমল বলল যা রেধেছিস না পপি এ যেন অমৃত।বাবা প্রায় সময়ই বলেন , মাইয়ের উপর যেদিন বাজ পরেছিল সেদিনো নাকি মা খুব স্বাদ কিছু একটা রান্না করেছিলেন।বাইওরে তুফান ছিল বলে বাবা খেতে পারে নি । এই তুফানের মাঝেই মা পানি আনতে বাইরে গেলে বাজ পরে মারা যান। বলেই চোখটা আড়াল করে ফেলল বিমল। কি এক অজানা দুঃখ তার মনে আছে তা সবাই জানলেও কারো কোন কিছু করার নেই। শুধু বিমলের কান্নাটা দেখা ছাড়া। গত এক দশক ধরে বিমলের আশে পাশের মানুষ গুলো তাই করে আসছে। তবে এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম পপি । কেন জানি সে বিমলের চোখের পানি কোনভাবেই সহ্য কোরতে পারে না। বিমল কাদলে সেও কেদে ঊঠে , বিমল হাসলে সেও হেসে উঠে। কেন? তা পপি নিজেও কি জানে? না জানারই কথা। কারন মনের ব্যাপার ঈশ্বরও জানে না। কাদটে কাদতে পপি বলল, পুটি মাছের ভাজি আরেকটা দেই? না না , তোর জন্যে রেখে দে।(চোখটা আগুনের শিখার মত লাল হয়ে আছে বিমলের ) দুটি বাচ্চা একাকী একাকী একটি ঘরের মাঝে গৃহ গৃহ খেলা খেলতেছে । এই খেলাটি যে কি তারা জানে না, এমনকি পুরা জগতটাও আজো জানে না , কি এই খেলা। তবে বিমল আর পপি যা খেলল তা সত্যিই অনেকের কপালে জুটে না, জুটলেও ঠিকে থাকে না। বিমলের খাবার তখন শেষ হয় নি , যে রাস্তাটি গাড়ি ঘোড়া বহন করার জন্যে বিমলদের বাড়ির কাছ দিয়ে চলে গেছে , তার উপর দিয়ে একটা মিছিল চলে গেল। যারা মুখে মুখে তুফানের আওয়াজের মত আকাশ বাতাস কাপাইয়া বলল শুধু, হরতাল , হরতাল , হরতাল বিমলদের ঘরটা ইটের দালান কোন কালেই ছিল না, আজো নয় । টিনের বেড়ার উপর টিনের চালার ঘরটি এমন ভাবে হরতাল বলার আওয়াজে কেপে উঠলো , মনে হল বিধাতা ইচ্ছা করেই মাটি কাপিয়ে ভুমিকম্প দিয়ে ঘরটা নাড়িয়ে দিল। তাও শুধু এই দটি বাচ্চাকে ভয় দেখানুর জন্যে। না তারা ভয় পেলেও নড়িলো না।
একেবারে সোজা দাঁড়িয়ে চারদিকের আওয়াজটা ভাল্ভাবে বুঝে নিল। পপির দিকে তাকিয়ে বিমল বলল, ভয় পাইছিস? ভয় পাস না ও কিছু না। এই হরতাল তুফান গাড়ি ভাংগে, ঘর ভাংগে না, গাড়ি পুড়ায় ঘর পুড়ায় না। তবে আতশ বাজি করে খুব বেশি। বিমলের কথায় পপি নিজের ভয় সরাতে পারলেও বিমলের মনে কি জানি একটা আতংক তখন ছিল।তবে ভয়ের জিনিস যদি মানুষের পাশে বেশিক্ষন স্থায়ী হয়ে যায় তাহলে এক সময় তাতে আর ভয়ের কিছু রয় না।মানুষ আতংকিত হবে দূরের থাক বরং খালি হাতেই কেচোর মত সাপ নিয়ে খেলা করে। বিমল তখনো ধীরে ধীরে খাচ্ছিল, আর পপির প্রসংশা করতেছিল। এমন সময় পপি হঠাত করে বাহিরের দিকে আঙ্গুল তুলে বলল, বিমল ঐ দেখ রাস্তার উপরে একটা হাসের ডিম পরে আছে। হাসের ডিম? বলেই বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখল পপি মিথ্যা বলে নি । তাই খাবার ফেলেই সোজা দৌড় দিল, দৌড় দিল রাস্তার পাশে কোন এক হাসে্র ফেলে যাওয়া তার সাধের ডিমটা আনার জন্যে। যাবার সময় বলে গেল, পপি ডিমটা দিয়ে বড়া করে দিবি?দিবিতো আরো ভাত খাব। পপি একটু বড় গলায়ই বলল আগে আনত? পপির চোখ তখনও বিমলের হাতের দিকেই ছিল।কবে কীভাবে সে ডিম টাকে নিয়ে আসে? নাকি বিমল নিয়ে আসার আগেই অন্য কোন ছেলে নিয়ে যায়। কিন্তু একি ? বিমল ডিমটির পাশে যাবার সংগে সংগেই ডিমটি বোমার মত ফেটে গেল। চারদিক ধোয়ায় অন্ধকার । কিছু বুঝার আগেই পপি , ও বিমল বলে চিতকার করে দৌড়ে চলল রাস্তার দিকে। মুখে তার একটি আওয়াজ , ও বিমল ওবিমল, ও বিমল,ডিম লাগবে নারে বিমল তুই ফিরে আয়। ঘর থেকে বাহির হলেই পাড়া প্রতিবেশি যারা বিকট আওয়াজ শুনে ঘরের বাহির হয়েছিল তারা পপিকে ঝাপটে ধরে বলল , এই মেয়ে কোথায় যাচ্ছিস, মরতে চাস নাকি? না পপি তাদের কথা শুনলেই না। শুধু বলল, বিমল তুই ফিরে আয় যাস না, ডিম লাগবে না। ও বিমল তুই ফিরে আয়। আমাকে ছাড় ,তোমরা আমাকে ছাড় , বিমল ওইখানে ডিম আনতে গেছে। ও কোথায়।? রাস্তার উপরে বিকট আকারে ফেটে যাওয়া বোমটির আওয়াজ তুফানের ডাকের মত গুর গুর করে শেষ হয়ে গেলেও ধুলা বালির কুন্ডলির ধোয়ার মত তখন ধোয়ায় চারদিক অন্ধকার ছিল ।
পপি সেদিকে তাকিয়ে বিমল বিমল বিমল বলতেই লাগল। কিন্তু হায় আশেপাশের একটি মানুষও জানতে চাইল না কেন মেয়েটি বিমল বিমল বলে প্রায় অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে। পরে পপি যখন কোন না কোন ভাবে কারো হাতে কামড় দিয়ে দৌড়ে সোজা গিয়ে রাস্তার উপরে উঠল তখন সবাই দেখল একটি ছেলে বোমার আঘাতে হাত পা লন্ডভন্ড করে রাস্তার উপরে পরে আছে। বাম দিকের চোখটা কোথায় গিয়ে পরেছে তা খুজে পাওয়া গেল না। সম্পূর্ন দেহটি এমন ভাবে রক্তে লাল হয়ে আছে যে দেখলে মনে হবে কেউ যেন রক্ত দিয়ে ছেলেটিকে স্নান করিয়ে দিয়েছে। বিমলের এই অবস্থা দেখে পপি শুধু আর কয়েকটি কথা বলল, বিমল তুই ডিম ভরা আর খাবি না? খাবি নারে বিমল?
আমি ভাল ডিম ভরা বানাতে পারি।খাবি ঊঠ, এ বিমল উঠ্্ বলেই মেয়েটি অজ্ঞান। চারদিকে তখন আওয়াজ উঠল , হ্যা ভগবান এ কি হলো। কেউ বলল হাসপাতালে নিয়ে চলল।কেউ বলল নিয়ে আর লাভ কি?বাচবে বলে মনে হয় না। তবু তারা বিমল কে নিয়ে হাসপাতাল চলল। বিমলকে নিয়ে যখন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্চিল, তখন তার মুখ দিয়ে বের হোয়া রক্তের ফেনা ভেদ করে যা কানে আসছিল , তা হল পপি এ ডিম না, ডিম নারে পপি হরতাল তুফান, তুফান।