মৃগয়া

বন্ধুরা, একরাশ প্রীতি আর শুভেচ্ছা নাও। তোমরা নিশ্চয়ই শিকার এবং শিকারী এ দু’টি শব্দের সঙ্গে পরিচিত। এক সময় রাজা-বাদশা আর জমিদাররাও আনুষ্ঠানিকভাবে ঘটা করে বন জঙ্গলে যেত শিকার করতে। এভাবে পশু-পাখি শিকার করা একটা শখের বিষয় হয়ে দাঁড়াল।

পশু শিকার করার জন্য আগেকার শিকারীরা বিচিত্র ফাঁদ পাতত। ‘ফাঁদ’ মানে হলো এমন কোনো জিনিস পেতে রাখা যা পশু-পাখিদের নজরে পড়ে না। আগেকার বেশিরভাগ শিকারী বিশেষ কায়দায় ফাঁদ করতো। কেউ গর্ত করে তার উপরে ঘাস লতাপাতা দিয়ে এমনভাবে রাখতো যে মনেই হতো না ওখানে কোনো গর্ত আছে। তাই পশুরা আনমনে চলতে গিয়ে গর্তের ফাঁদে পড়ে আটকে যেত। এভাবে জালও পেতে রাখতো শিকারীরা। আবার দড়ির বৃত্তও পেতে রাখত অনেকে। ঐ বৃত্তের ভেতর কেউ ঢুকলেই আটকা পড়ে যেত আর শিকারী পরে এসে আটকে পড়া শিকার নিয়ে যেত। জাল ব্যবহার করার কারণে ফাঁদ বলতে জালকেও বোঝায়। যে শিকারী জাল বা ফাঁদ পাতার ব্যাপারে কৌশলী হতো সে-ই তত বড় শিকারী হিসেবে খ্যাতি লাভ করত।

আমরা এক শিকারির কাহিনী প্রচার করেছি। একদিন এক শিকারী বনে গিয়ে গর্ত কেটে ফাঁদ পেতে রাখল। কিছুক্ষণ পর ওই ফাঁদে আটকা পড়ল তিনটি শিকার। একটি বাঘ, একটি সাপ এবং একটি বানর। ঘটনাক্রমে একজন আস্ত মানুষও আটকা পড়ে গেল ফাঁদে। লোকটি ছিল একজন স্বর্ণকার। স্বর্ণকার মনে মনে হাসল, সে তেমন একটা দুশ্চিন্তা করল না। কেবল অপেক্ষা করতে লাগল শিকারী কখন আসবে। শিকারী এলেই সে মুক্ত হয়ে যাবে- এরকম ভাবছিল সে। কিন্তু যতো দুশ্চিন্তা সাপসহ অন্য পশুদের। তারা এই ফাঁদ থেকে মুক্তি পাবার কোনো পথই খুঁজে পাচ্ছিল না। কিন্তু শিকারী সেদিন এল না, পরদিনও না। আটকেপড়া পশুগুলো খেতে না পেয়ে একেবারে ক্লান্ত হয়ে গেল।

তৃতীয় দিন তারা চলন্ত ঘোড়ার পায়ের শব্দ শুনতে পেল। স্বর্ণকার বেচারার তো শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যায় যায় অবস্থা। ঘোড়ার পায়ের শব্দ শুনে সে চিতকার করে বলে উঠলো: ‘এই যে শিকারী ভাই! আমাকে মুক্ত করে দাও। তোমার পাতা ফাঁদে বড় একটা বাঘ, একটা সাপ এবং চঞ্চল একটা বানর ধরা পড়েছে। তুমি সেগুলোকে বিক্রি করে অনেক টাকা আয় করতে পারবে’।

স্বর্ণকারের চিতকার শুনে ঘোড়ার পায়ের শব্দ আর হ্রেষা ধ্বনি থেমে গেল তবে পায়ের একটা শব্দ ক্রমশ কানে বাজতে লাগল তাদের। শব্দটা আস্তে আস্তে বাড়তে লাগল। কিছুক্ষণ পর একটা লোক গর্তের পাশে এসে দাঁড়ালো। এ সময় বাঘ গর্জন করে উঠল। সে বোঝাতে চাইল যে এখনো দুর্বল হয়ে যায়নি, পুরোপুরি শক্তিশালী আছে। অশ্বারোহী স্বর্ণকারকে বলল: ‘আমি শিকারী নই। আমি একজন পথিক, ঘোড়সওয়ার, এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম। ঠিক আছে তোকে আমি মুক্ত করে দিচ্ছি, তুই তোর কাজেকর্মে ফিরে যা’।

এই বলে ঘোড়সওয়ার শক্ত এবং মোটা একটা রশি গর্তে ফেলল। কিন্তু রশি ধরে স্বর্ণকার ওপরে যাবার আগেই বানর তাড়াতাড়ি উপরে চলে এল এবং তারপর একে একে বাঘ আর সাপও এল। তারা ঘোড়সওয়ারকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলল: ‘তুমি আমাদের জান বাঁচিয়েছ। তোমার এই দয়ার কথা আমরা কোনোদিন ভুলব না। আমরা তোমার কাছে চিরঋণী। যদি তুমি কখনো বিপদাপদে পড় আমরা অবশ্যই তোমার সাহায্যে এগিয়ে আসব। কিন্তু তুমি এই স্বর্ণকারকে এখানেই রেখে যাও! ও ভীষণ খারাপ লোক। এ কয়দিনে তাকে আমরা ভালোভাবেই চিনতে পেরেছি। যেমন স্বার্থপর তেমনি অকৃতজ্ঞ’।

পশুদের কথা শুনে ঘোড়সওয়ার বলল: ‘না, তা হয় না, শিকারী হয়তো আগামী কয়েকদিনে নাও আসতে পারে। একাকী ক্ষুধার্ত অবস্থায় তাকে ফেলে যাওয়াটা অনুচিত হবে’। এই বলে রশিটা নীচে ফেলল আর স্বর্ণকার গর্ত থেকে মুক্তি পেয়ে ঘোড়সওয়ারকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলল: ‘একদিন নিশ্চয়ই তোমার এই দয়ার প্রতিদান দেব, এই নাও আমার ঠিকানা, কোনোদিন এই শহরে এলে অবশ্যই বেড়িয়ে যাবে’।

এ ঘটনার পর ঘোড়সওয়ার স্বর্ণকারকে সামান্য খাবার দিয়ে বিদায় নিল। এরপর কেটে গেল বহুদিন, বহু মাস। ক্ষুধায় ক্লান্ত শ্রান্ত এক পথিক একদিন শহরের দিকে যাচ্ছিল। হঠাৎ একটি বানর জোরে ডেকে উঠল। পথিক সেদিকে তাকিয়ে বানরটাকে চিনতে পারল। বানর বলল: ‘আমাদের তো কোনো ঘরটর নেই যে তোমাকে দাওয়াত করব। তবে আমি যেটা পারব তা হলো’….এই বলেই বানর গাছে লাফাতে লাফাতে বলল: ‘যেও না, আমি আসছি’।

পথিক ঘোড়ার পিঠ থেকে নীচে নেমে মাটিতে আরাম করে বসল। একটু পরেই বানর এক ঝুড়ি তাজা ফল এনে দিলো পথিককে। পথিক পেট ভরে ফল খেল, কিছু ঘোড়াকে দিল আর কিছু ঝুলিতে পুরে বিদায় নিল। যেতে যেতে হঠাৎ বাঘের গর্জন তার কানে এল। পথিক ভয় পেয়ে গেল। বাঘ একটা তার পথ রোধ করে দাঁড়িয়ে বলল: ‘ভয় পেও না বন্ধু! আমাকে চিনতে পাচ্ছো না’!

পথিক বলল: ‘চিনতে পেরেছি ঠিকই’। তারপরও ভয় কাটেনি তার। বাঘ কাছে এসে বলল: ‘তোমাকে দেখে খুব ভালো লাগছে। তোমার দয়ার কথা আজও ভুলিনি। কীভাবে তোমার ঋণ শোধ করব জানি না’। এই বলে বাঘ তাকে বলল: ‘তুমি একটু দাঁড়াও, আমি এক্ষুণি আসছি’।

বাদশার প্রাসাদ কাছেই ছিল। বাঘ প্রাসাদে গেল। একটু পরেই ফিরে এসে পথিককে ছোট্ট একটা উপহার দিলো। হীরার একটা ব্রেসলেট। ব্রেসলেটটা ছিল রাজকন্যার হাতে বংশীয় প্রতীক স্বরূপ। পথিক উপহার দেখে খুব খুশি হয়ে গেল এবং বাঘকে ধন্যবাদ জানিয়ে আবারো রওনা দিল। শহরে পৌঁছতেই মনে পড়ে গেল স্বর্ণকারের কথা। ভাবল, স্বর্ণকারের খোঁজখবর নেয়া দরকার। দেখাও হবে আর এই ব্রেসলেটটার দামও জেনে নেয়া যাবে।

এই ভেবে ঠিকানা ধরে ধরে স্বর্ণকারের বাড়িতে গেল পথিক। স্বর্ণকার তো পথিককে দেখে ভীষণ খুশি। কুশল বিনিময়ের পর পথিক স্বর্ণকারকে হীরার উপহারের ঘটনাটা বলে এর দাম জিজ্ঞেস করল। স্বর্ণকার ব্রেসলেটটা দেখেই চিনে ফেলল আর মনে মনে ভাবল দেরি করা ঠিক হবে না, রাজকন্যার হাতের ব্রেসলেট কিংবা ব্রেসলেট চোরের সন্ধানদাতাকে বাদশা মূল্যবান পুরস্কার দেবে বলে ঘোষণা করেছে। পুরস্কারের লোভে স্বর্ণকার পথিক অতিথিকে বলল: ‘তুমি বিশ্রাম নাও, আমি দ্রুত এর দামটা জেনে আসছি। দোকানে যাব, ওজন করব আর দামটা জেনে নেব’..। এ কথা বলেই সে দ্রুত চলে গেল প্রাসাদে। প্রহরিকে সে বলল: ‘তুমি প্রাসাদে গিয়ে বাদশাকে শুধু এই সুখবরটা দাও যে ব্রেসলেট এবং চোরের সন্ধান পাওয়া গেছে’। বাদশা কথাটা শুনে স্বণর্কারকে ভেতরে নিয়ে গেল। স্বর্ণকার বাদশাকে ব্রেসলেটটা দিয়ে বলল: ‘চোর এখন আমার ঘরেই আছে। কাউকে এক্ষুণি পাঠিয়ে তাকে গ্রেফতার করে আন’।

গ্রেফতার করে আনার পর পথিককে দেখেই বাদশা ক্ষেপে গেল। চিতকার করে বলল: ‘এই ব্রেসলেট কীভাবে, কোত্থেকে চুরি করেছ’? পথিক পুরো ঘটনা খুলে বলল। কিন্তু কেউই বিশ্বাস করল না, স্বর্ণকারও তাকে না চেনার ভান করল। বাদশা আদেশ দিল: ‘এই চোরটাকে হাত পা বেঁধে পুরো শহর ঘুরিয়ে আন, তারপর ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মার’।

বাদশার আদেশের পর সৈন্যরা পথিককে পুরো শহর ঘুরিয়ে এনে জেলখানায় রাখল। ঘটনাক্রমে ফাঁদ থেকে মুক্তি পাওয়া সাপটি বিপদগ্রস্ত পথিককে চিনতে পারল। কিন্তু কী ঘটেছিল বুঝতে পারল না। অবশেষে সাপ কারাগারে গিয়ে নিজের পরিচয় দিয়ে সব জানতে চাইল। পথিক তখন সবকিছু খুলে বলল। সাপ তখন বলল: ‘মনে পড়ে, বলেছিলাম..স্বর্ণকারকে মুক্ত কর না..ও বড়োই নিমকহারাম… নির্দয়.. স্বার্থপর..? যাক, কোনো চিন্তা কর না। এই লতাগুলো রাখ। এগুলো সাপের বিষনাশক। সাপে কাটলে এগুলো পানিতে সিদ্ধ করে খাওয়ালে রোগী ভালো হয়ে যাবে।’ এই বলে সাপ চলে গেল। কিছুক্ষণ পর প্রাসাদে শোরগোল উঠল: ‘রাজপুত্রকে সাপে কেটেছে… রাজপুত্রকে সাপে কেটেছে…’।

এরপর অনেক কবিরাজ ওঝা এল। কিছুতেই কিছু হলো না। শেষপর্যন্ত বাদশা ঘোষণা দিল: ‘যে রাজপুত্রকে সুস্থ করে তুলতে পারবে তার সব চাওয়া পূরণ করা হবে’। পেয়াদারা সাথে সাথেই ঢোল পিটিয়ে ওই ঘোষণা রাজ্য করে দিল। বন্দী পথিক তখন বলল: ‘আমি পারব। এই লতাগুলো সিদ্ধ করে রাজপুত্রকে দাও। তাহলেই সে ভাল হয়ে যাবে।’ তাড়াতাড়ি লতাগুলো সিদ্ধ করে রাজপুত্রকে রস খাওয়ানো হলো। মুহূর্তেই সুস্থ হয়ে গেল সে। বাদশা এবার বন্দী পথিককে বলল: ‘তুমি কী চাও বল’!

বন্দী বলল: ‘একজন বন্দী, মুক্তি ছাড়া আর কী চায় বলুন’! এরপর বলল: ‘আমি চাই আমার কথাগুলো বিশ্বাস করুন’। বাদশা বলল: ‘বলো, কী বলতে চাও’। বন্দী সব ঘটনা খুলে বলল। বাদশা সব শুনে আদেশ দিল: ‘স্বর্ণকার যেই ফাঁদে আটকে ছিল সেই ফাঁদে মৃত্যু পর্যন্ত তাকে রেখে আসো’। পাইক পেয়াদারা তাই করল। তার কিছুদিন পর শিকারী তার ফাঁদ দেখতে গিয়ে মরা গন্ধ পেয়ে বাড়িতে ফিরে গেল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরো পড়তে পারেন...

শেয়াল ও মুরগি

এক বাগানের একটি খাঁচায় একপাল মুরগিছানা থাকত ওদের মায়ের সঙ্গে। ওরা ছিল বেশ শান্ত-সুবোধ। কেউ…

ছাগল ও সিংহ

ক্লাসে কিছু ছাত্র থাকে যারা- যেমন বুদ্ধিমান তেমনি জ্ঞানী। আবার কিছু ছাত্র আছে যাদের স্মৃতি…

হাতেম তাঈ’র মহানুভবতা

হাতেম তাঈ ছিলেন তৎকালীন আরবের ইয়েমেন প্রদেশের একজন অত্যন্ত জ্ঞানী ও নিরহংকারী ব্যক্তি। সাধারণ জীবন-যাপনকারী…