মুসা (আঃ)-এর তূর পাহাড়ে গমন
যেহেতু এ পথে হযরত মূসা (আঃ)-এর নিজের বা তাঁর সঙ্গীদের কারোরই চলাফেরা কোন সময়ই ছিল না। তাই রাস্তা ঘাট সবারই অপরিচিত। পথ ভুলেই তারা মিসর অভিমুখী সাধারণ রাস্তা থেকে সরে তুর পর্বতগামী রাস্তায় চলতে থাকেন। এক সময় তিনি যখন স্ত্রী এবং সেবকদের তুর পর্বতের কাছে পৌঁছলেন, অন্য সঙ্গীরা তখন পথ হারিয়ে তাঁদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। তুর পর্বতের কাছে পৌঁছার সময়টি ছিল তাঁর। একে তো শীতের মৌসুম। তদুপরি আকাশে বজ্র বিজলী ও বরফপাত, অবিরাম ধারায় বৃষ্টি সব মিলিয়ে প্রাণান্তকর দশা। এ অবস্থায় স্ত্রী সফুরার প্রসব বেদনা শুরু হয়। ঠাণ্ডায় তিনি একেবারে কাতর হয়ে পড়েছেন। স্ত্রীকে কিছুটা আগুনের তাপ দিয়ে শীতের প্রচণ্ডতা থেকে রক্ষার জন্য মূসা (আঃ) চমমকি পাথর ঘষে আগুন জ্বলাবার প্রাণান্তকর চেষ্টা চালিয়েও ব্যর্থ হন। কথিত আছে এ সময় তিনি চকমকি পাথর ঘর্ষণ করে আগুন জ্বলাতে ব্যর্থ হয়ে ক্রোধবশত সেটি মৃত্তিকায় সজোরে নিক্ষেপ করেন। এ সময় চকমকি পাথর বলে উঠল হে মূসা! আপনাকে আগুন প্রদানের জন্য আল্লাহর নির্দেশ নেই। তাই আপনি আগুন জ্বালানোর পুনঃ পুনঃ চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন। এ ঘটনায় তিনি পাথর ঘষে আগুন জ্বালাবার চিন্তা পরিহার করে অতিশয় চিন্তাযুক্ত হয়ে পড়েন। অত্যন্ত অস্থির উদ্বিগ্ন হয়ে এদিক সেদিক দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন, আগুনের কোন সন্ধান পাওয়া যায় কি না? কিন্তু না, কোথাও আগুনের চিহ্নমাত্র পরিদৃষ্ট হচ্ছে না। এ অবস্থায় তিনি কি করবেন তা ঠিক করতে পারছিলেন না।
এমন কি এক নাজুক পরিস্থিতির মাঝে তুর পর্বতে এক জ্বলন্ত আগুনের শিখা তাঁর দৃষ্টিতে পড়ে। এ আগুনের শিখা দেখে তিনি হতাশার ঘন আধারে আশার আলো দেখতে পান। ভাবলেন হযরত পর্বতোপরি লোকজন বসবাস করছে। যে আগুন দেখা গেছে তা হয়ত তারাই জ্বালিয়েছে। সুতরাং সেখানে গেলে আগুন পাওয়া যাবে। এ আশায় তিনি সহধর্মিনীকে বলেন, অপেক্ষা কর। পর্বতোপরি আগুন দেখা যাচ্ছে। সেখান থেকে দেখি আনতে পারি না কিনা।
فَلَمَّا قَضَىٰ مُوسَى الْأَجَلَ وَسَارَ بِأَهْلِهِ آنَسَ مِن جَانِبِ الطُّورِ نَارًا قَالَ لِأَهْلِهِ امْكُثُوا إِنِّي آنَسْتُ نَارًا لَّعَلِّي آتِيكُم مِّنْهَا بِخَبَرٍ أَوْ جَذْوَةٍ مِّنَ النَّارِ لَعَلَّكُمْ تَصْطَلُونَ
অর্থঃ তিনি নির্ধারিত মেয়াদ পূর্ণ করার পর যখন স্ত্রীকে নিয়ে রওয়ানা হন তখন তিনি তুর পর্বতের দিক থেকে এক প্রকার আলো দেখতে পেলেন, তিনি স্বীয় পরিবারবর্গকে বলেন, তোমরা এখানে অপেক্ষা কর, আমি এক প্রকার আগুন দেখতে পাচ্ছি, আশা করা যায় আমি সেখান থেকে তোমাদের জন্য রাস্তার সংবাদ অথবা আগুন আনতে পারব, যাতে তোমরা আগুন পোহাতে পার। (সুরা কাসাসঃ আয়াত-২৯)
হযরত মূসা (আঃ) স্ত্রী ও সঙ্গীদের অবস্থান স্থল থেকে তুর পাহাড়ের উপর পরিদৃষ্ট আগুনের শিখা অনেক দূরে ছিল। তিনি আত্মিক ও দৈহিক শক্তি বলে বলিয়ান হওয়ার খুব অল্প সময়েই সেখানে
পৌঁছে যান। সেখানে পৌঁছে তিনি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে পড়েন। তিনি দেখতে পেলেন আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে আর এক গাছের ঢাল থেকে অপর গাছের ডালে স্থানান্তরিত হচ্ছে। এ দেখে তাঁর সকল ধ্যান-ধারণা উলট পালট হয়ে যায়। তিনি ভাবতে লাগলেন, এ তো সাধারণ কোন আগুন নয়। এর পিছনে নিশ্চয়ই কোন এক নিগুড় তত্ত্বও নিহিত রয়েছে। তদুপরি পাতায় আগুনের তাপজনিত কোন পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না। আগুনের তেজ যত বাড়ছে গাছের সবুজ বর্ণ তত বেশী ঔজ্জ্বল্য লাভ করছে। সুতরাং এ এক বিরাট রহস্যই বটে। এসব বিস্ময়কর অবস্থা দেখা সত্ত্বেও তিনি প্রয়োজনীয় আগুনের জন্য হাত প্রসারিত করেন। কিন্তু তিনি হাত বাড়াতেই দৃশ্যমান আগুন দূরে সরে যায়।
অন্য এক বর্ণনায় রয়েছে, তিনি আগুনের অবস্থানে পৌঁছে বিস্ময়কর অবস্থা দেখে একটু দূরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলেন, যদি বা কোন অগ্নিস্ফুলিঙ্গ অগ্নিকুণ্ড হতে নীচে ছিটকে পড়ে তবে তা কুড়িয়ে নেবেন। দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার পরও যখন কোন অগ্নিস্ফুলিঙ্গ নীচে পতিত হতে দেখলেন না তখন তিনি সামান্য শুষ্ক খড়কুটা হাতে নিয়ে হাতবাড়ান যাতে আগুন লেগে তাঁর উদ্দেশ্য সফল হবে। কিন্তু তিনি হাত বাড়ালে আগুন পিছনে সরে যায়। হাত সরিয়ে আনলে আবার যথাস্থানে ফিরে আসে। কয়েকবার এরূপ করার পর তাঁর মনে ভয়ের সৃষ্টি হলে তিনি ফিরে আসার চিন্তা করছিলেন। আর যখনই তিনি এ চিন্তা করলেন তখনই ধ্বনিত হল, হে মূসা! আমি আল্লাহ, সমগ্র বিশ্বের রব! পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে-
فَلَمَّا أَتَاهَا نُودِيَ مِن شَاطِئِ الْوَادِ الْأَيْمَنِ فِي الْبُقْعَةِ الْمُبَارَكَةِ مِنَ الشَّجَرَةِ أَن يَا مُوسَىٰ إِنِّي أَنَا اللَّهُ رَبُّ الْعَالَمِينَ
যখন তিনি আগুনের কাছে পৌঁছুলেন, তখন উপত্যকার ডান দিক থেকে সে বরকতময় স্থানে একটি বৃক্ষ হতে ধ্বনিত হল, হে মুসা! আমি আল্লাহ সমগ্র জাহানের রব! (সূরা – কাসাসঃ আয়াতঃ – ২০)
এরশাদ হচ্ছে- فَلَمَّا أَتَاهَا نُودِيَ يَا مُوسَىٰ
إِنِّي أَنَا رَبُّكَ فَاخْلَعْ نَعْلَيْكَ ۖ إِنَّكَ بِالْوَادِ الْمُقَدَّسِ طُوًى
অর্থঃ অতঃপর তিনি আগুনের নিকট পৌঁছুলে আওয়াজ হল- হে মূসা! আমি তোমার রব অতএব তোমার জুতা খুলে ফেল, তুমি একা পবিত্র ময়দানে তুয়ায় রয়েছে। (সূরা – তোয়াহাঃ আয়াত – ১১-১৩)
তাফসীর গ্রন্থে রয়েছে যে, তুর পাহাড়ের উপরে তুয়ার পবিত্র ময়দানে মূসা (আঃ) যে ধ্বনি শ্রবণ করেছিলেন তা কোন নিদির্ষ্ট দিকে থেকে নয়; বরং সর্বদিক থেকেই সমভাবে শুনতে পেয়েছিলেন। তাই কোন দিকে থেকে এ বিস্ময়কর ধ্বনি ভেসে আসছে তা ঠিক করা একটা দূরহ ব্যাপার ছিল
এ ধ্বনির মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা হযরত মূসা (আঃ) – কে বুঝিয়েছিলেন- হে মূসা ! তুমি যে আগুন ভাবছ তা আদৌ কোন আগুন নয়- বরং আগুনরূপী আলো; তোমার রব আল্লাহর নূর। মূসা (আঃ) ও বিভিন্নভাবে বুঝে নিলেন, দৃশ্যমান আলোরূপ আগুন আসলে আগুন নয়। আগুন হত হলে যে গাছের উপর তা অবস্থান করছে সে গাছ জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যেত এবং গাছের পাতা ডাল সজীবতা হারাত। আর যে ধ্বনি শুনা গেছে তা কোন সাধারণ ধ্বনি নয়। কেননা, তা সবদিক থেকে সমভাবে শোনা যাচ্ছে। সাধারণ নিয়মে শুধুমাত্র কর্ণ দিয়েই এ আওয়াজ শুনছে না, অন্যান্য অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ও সমভাবে শুনতে পাছে। অথচ কান ব্যতীত অন্যান্য অঙ্গ প্রত্যঙ্গ শোনার কাজে ব্যবহৃত হওয়ার জন্য সৃষ্টি হয়নি। সুতরাং সর্বাঙ্গে শুনতে পাওয়ায় দৃঢ়ভাবে প্রতিয়মান হচ্ছে এ কোন সাধারণ আওয়াজ নয়। (তাফসীর রুহুল মায়ানী ও তাফসীরে বাহরে মহী)
হজরত ওয়াহাব বিন মুনাব্বিহ (রাঃ) থেকে রেওয়ায়েত আছে। আল্লাহ তায়ালা মূসা (আঃ) -কে ডাক দিলে তিনি লাব্বাইক বলে জবাব দেন আর নিবেদন করেন, আমি আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি। কিন্তু যিনি আওয়াজ দিচ্ছেন তাঁর অবস্থান অবগত নই। আপনি কোথায় রয়েছেন? জবাব এল, আমি তোমার উপরে নীচে, সামনে পিছে, তোমার সাথে সর্বত্রই বিরাজমান রয়েছি। তিনি পুনঃ নিবেদন করলেন, আমি কি, সরাসরি আপনার না আপনার প্রেরিত ফেরেশতার কথা শুনছি। জবাব এল, আমি স্বয়ং তোমার সাথে কথা বলছি। (মুসনাদে আহমাদ)