‘মিস্ত্রীগিরি বানরের কাজ না’

অনেক অনেক দিন আগের কথা। যে কালের কথা বলছি সঠিক দিন তারিখ জানা না গেলেও এটুকু জেনে রাখলেই হবে যে সে সময়টায় গল্প এভাবেই শুরু হতো। গল্পটা অবশ্য জঙ্গলের, মানুষ আর বানরের। বানর কিন্তু অসম্ভব অনুকরণপ্রিয় একটা প্রাণী। অন্যদেরকে যা কিছু করতে দেখবে নিমেষেই তারা তা অনুকরণের চেষ্টা করবে। এটা খুব ভালো অভ্যাস নয়। কেননা অনুকরণ করতে গেলে নিজের ভেতরে যে সৃষ্টিশীল প্রতিভা থাকে তা নষ্ট হয়ে যায়। আমাদের সমাজেও এরকম বহু মানুষ পাওয়া যাবে যারা অপরকে অনুকরণ করতে করতে নিজস্বতা হারিয়ে ফেলে। অনুকরণপ্রিয় যারা তারা কিন্তু অনেক কিছু না জেনেও জানার ভান করে। এতে অবশ্য সে নিজেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বানরের গল্পটাতে আমরা তার প্রমাণ দেখবো।

যাই হোক, বনের ভেতরকার গল্পের কথা বলছিলাম। কিছু শ্রমিক বনের ভেতরে একটা মসজিদ বানাচ্ছিল। বন জঙ্গলের ভেতর ঘুরে ঘুরে বেছে বেছে গাছ কেটে এনে তারা বানাচ্ছিল ঐ ইবাদাতের ঘরটি। একজন গাছ কাটতো। আরেকজন ডালপালা কেটে গুঁড়িটাকে মসৃণ করতো। আবার কয়েকজন মিলে গুঁড়িগুলোকে কাঁধে করে বয়ে নিয়ে যেত মসজিদ বানাবার জায়গায়। আরো কয়েকজন মিলে ঐ গুঁড়িগুলোকে প্রয়োজনমতো কেটে ছেঁটে টুকরো টুকরো করে প্রস্তুত করে রাখতো। মিস্ত্রী ছিল অনেকজন। তবে তাদের একজন নেতা ছিল। নেতার নির্দেশনা অনুযায়ী অন্যান্য মিস্ত্রীরা কাজ করতো। গাছের গুঁড়ির টুকরোগুলো ঐ নেতাই ঠিকঠাক মতো গুছিয়ে রাখছিল। যে টুকরোটা যেখানে রাখা দরকার সেখানেই রাখছিল এবং জোড়া দিয়ে দিয়ে মসজিদ বানাচ্ছিল।

ঐ জঙ্গল ছিল বানরে ভরা। বানরেরা সেই শুরু থেকেই মিস্ত্রীদের কাজকর্মগুলো গভীর মনোযোগের সাথে দেখছিল। গাছে গাছে, ডালে ডালে লাফিয়ে লাফিয়ে চিঁ মি করে চেঁচিয়ে মেচিয়ে দেখছিল মিস্ত্রীদের গাছ কাটা, ডালপালা ছাঁটা, টুকরো টুকরো করা, ঘাড়ে করে বয়ে নিয়ে যাওয়া, তাদের আসা-যাওয়া, পারস্পরিক সহযোগিতা এবং টুকরোগুলোতে হাতুড়ি দিয়ে পেরেক মেরে মেরে জোড়া দিয়ে দিয়ে ঘর বানানো ইত্যাদি। তারা আরো লক্ষ্য করলো মিস্ত্রীরা কিন্তু কাজের ফাঁকে ফাঁকে বিরতি দিতো বিশ্রাম নেওয়া এবং নাশতা পানি করার জন্যে।

এভাবে একদিন দুপুরবেলা যথারীতি মিস্ত্রীরা বিশ্রাম নেওয়ার জন্যে কাজে বিরতি দিলো। বিরতির ফাঁকে তারা দুপুরের খাবারও সেরে নিলো। দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্যে তারা গিয়েছিলো গাছ গাছালিময় জঙ্গলের ভেতর। সেখানে ছায়ায় বসে বিশ্রামও নিলো খাওয়া দাওয়াটাও সারলো। যেখানে মসজিদ বানাচ্ছিল সেখানে গাছ গাছালি ছিল না। ফাঁকা জায়গা হবার কারণে সেখানে রোদ ছিল, গরম ছিল। এ কারণেই মিস্ত্রীরা গিয়েছিল বনের ভেতরের ছায়াময় স্থানে।

কিন্তু মিস্ত্রীদের বিশ্রামের ফাঁকে ঘটে গেল এক কাণ্ড। এই কাণ্ডের নাম দেওয়া যায় বানরকাণ্ড। বানরগুলো এ কয়টা দিনে মিস্ত্রীদের কাজকর্মগুলো দেখে ভেবেছিলো এ কাজ তো সোজাই, তেমন কোনো ব্যাপারই না। তারা ভেবেছিলো সব শিখে ফেলেছে। তাই তারা মিস্ত্রীদের বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগটাকে কাজে লাগালো। সবাই দল বেঁধে চলে গেল মসজিদ নির্মাণের জায়গায়। সেখানে জড়ো হয়ে তারা তাদের ভাষায় চেঁচামেচি করতে লাগলো।

এরপর তারা মিস্ত্রীদের অনুকরণে কেউ গেল গাছের গুঁড়ি টানতে। বাগানের ভেতর থেকে গাছের গুঁড়ি টেনে এনে মসজিদ নির্মাণের জায়গায় নিতে লাগলো। মসজিদের কাজ তো মাত্র শুরু করেছিলো মিস্ত্রীরা। এখনো অসমাপ্ত রয়ে গেছে বহু কাজ।

সেই অসমাপ্ত কাজ করার জন্যে বানরদের কেউ কেউ মসজিদ ঘরের পালা বেয়ে উপরে উঠে গেল এবং মিস্ত্রীদের মতোই হাতুড়ি পেরেক চালাতে শুরু করলো। আরেকটি হতভাগা বানর গিয়েছিল মিস্ত্রীদের মতো কাঠ চিরাতে। গিয়ে দেখলো একটি গাছ অর্ধেকটা চিরানো হয়েছে অর্থাৎ করাত দিয়ে গাছের অর্ধেকটা পর্যন্ত ফালি করে তক্তা বানানো হয়েছে। বাকি কাজটা সে সমাপ্ত করার জন্যে উৎসুক হয়ে উঠলো। মিস্ত্রী তার কাজের সুবিধার্থে দুটি তক্তার মাঝখানে করাত চালানোর লাইনে খুঁটির মতো কাঠের একটি টুকরো গুঁজে রেখেছিল। তাতে করাত চালাতে সুবিধা হয় কারণ করাতের ওপর তক্তার দু পাশের চাপটা কম পড়ে। বানর কিন্তু ব্যাপারটা খেয়াল করে নি। সে গাছের গুঁড়িটার ওপরে উঠেই করাত টেনে তক্তা বানানোর বাকি কাজটা করতে শুরু করে দিলো। এ কাজটা কিন্তু একজনের পক্ষে বেশ কঠিন। সাধারণত একজন উপর থেকে করাত টানে আর কমপক্ষে একজন নীচে থাকে, সে করাত চালাতে নীচে টানতে এবং উপরে তুলতে সহযোগিতা করে। বানর তো আর সেসব জানে না। সে একাই শুরু করে দিয়েছিল।

প্রথম প্রথম করাত টেনে ভালোই লাগছিল তার। করাত টানার কের.র. কের.র. শব্দ শুনতে ভালোই লাগছিল। মনের সুখে তাই বানরটা করাত চালিয়ে যেতে লাগলো। কিন্তু হঠাৎ করে দেখা দিল মারাত্মক এক সমস্যা। করাত আটকে গেল। কোনোভাবেই করাত চালানো যাচ্ছিলো না। উপরের দিকেও না, নীচের দিকেও না। কী মুসিবৎ রে বাবা! বানর গেল ভড়কে। এ আবার কী ! আসল মিস্ত্রী হলে বুঝে ফেলতো এ অবস্থায় করণীয় কী। কাঠের যে খুঁটিটাকে তক্তার মাঝখানে গেড়ে দিয়েছিল করাত চালানোর সুবিধার জন্যে ঐ খুঁটিটাকে করাতের আরেকটু কাছে এনে গেড়ে দিলেই করাত মুক্ত হয়ে যেত এবং বানর আবার মনের সুখে করাত চালাতে পারতো। কিন্তু এই বুদ্ধি বা কৌশলটা তো বানরের জানা ছিল না। সেজন্যে বানরটা তার শক্তি দিয়েই করাত চালাতে চেষ্টা করলো। তাতে কোনো কাজ হলো না। গুঁড়ির উপরে গেল, নীচে গিয়ে ঝুললো চ্যাঁ ম্যাঁ করলো, এদিক ওদিক তাকালো, আবারো করাত চালাতে চাইলো। কিছুতেই কোনো কাজ হলো না। তবে একটি কাজ হলো। বানরটার চেঁচামেচি শুনে অসংখ্য বানর এসে জড়ো হলো। তারা সবাই মিলে চেষ্টা করলো করাতি বানরটাকে সাহায্য করতে। কিন্তু কীভাবে তারা সাহায্য করবে! তারা তো নিজেরাই জানে না কী করতে হবে, সাহায্য করবে কীভাবে।

করাতি বানরটা হঠাৎ কাঠের খুঁটিটা দেখতে পেল। সে ভেবেছিলো ঐ খুঁটিটাই সকল সমস্যার কারণ। তাই সমস্ত শক্তি দিয়ে ঐ খুঁটিটা সরানোর চেষ্টা করলো সে। তার চেষ্টা অবশ্য সফলও হয়েছিল কিন্তু তাতে নতুন সমস্যা দেখা দিলো। কাঠের খুঁটিটা হাত দিয়ে সরানোর ফলে বানরের হাতটাই এবার খুঁটির মতো আটকে গেল। এবার বাননের চীৎকার দেখে তার সাহায্যে এগিয়ে আসা অন্যান্য বানরেরা ভয় পেয়ে গেল এবং তারা আস্তে আস্তে যে তার মতো ডালপালার আড়ালে পালিয়ে গেল। করাতি বানর করাতের মতোই আটকা পড়ে রইলো দুই তক্তার মাঝখানে। ফান্দে পড়ে বকের মতো কাঁদতে কাঁদতে বানরটা ভাবলো-এটা তার জীবনের সবচেয়ে কালো দিবস। দিবস যে কালো তা দুই তক্তার চাপে তার জীবন যায় যায় অবস্থার মাঝে ফুটে উঠলো। নড়াচড়া করলেই বরং ব্যথা আরো কয়েকগুণ বেড়ে যায়। তারচেয়ে চুপচাপ অনড় থেকে কম কষ্টে জীবন দেওয়াই ভালো। বানর তাই আর নড়াচড়া করলো না। এভাবে ঘণ্টাখানেক কেটে গেল। হায় রে মিস্ত্রীগিরি! হায় রে করাত! হায় রে দুই তক্তার মাঝের জীবন ….।

ইতোমধ্যে মসজিদ নির্মাণকারী শ্রমিকেরা দুপুরের খাবার আর বিশ্রাম শেষে কাজে ফিরে এলো। কাজে ফিরেই তারা বানরের আটকে পড়ার মতো হৃদয় বিদারক দৃশ্য দেখে তাড়াতাড়ি তাকে বাঁচানোর জন্যে উঠেপড়ে লেগে গেল। দ্রুত কয়েকজন এগিয়ে গেল গাছের গুঁড়ির দিকে। গুঁড়িটা তো অর্ধেকের মতো চিরানো ছিল। অর্ধ ফালি করা সেই তক্তা দুটোকে তারা দুই দিকে টেনে ফাঁক করার চেষ্টা করলো। মিস্ত্রীদের কয়েকজন ধরলো একপাশে, আরো কয়েকজন অপরপাশে। এভাবে তারা অপূর্ব ছড়ায় ছন্দে শক্তি সঞ্চয় করে হেঁইয়্য হেঁইয়্য করে টান মেরে বানরটাকে আটকে পড়া গুঁড়ির মাঝখান থেকে মুক্ত করে দিলো। একজন বললোঃ মারো টান, আরো জোরে ইত্যাদি। আর অন্যেরা সবাই হেঁইয়্য হেঁইয়্য করে জোরে টান মারলো। এটা করাতিদের কাজে শক্তি সঞ্চয়ের একটা প্রাচীন কৌশল। যাই হোক, বানরটাকে বিপদ থেকে বাঁচানোর পর একজন মিস্ত্রী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলে উঠলোঃ বেচারা বানর! ছুতার হতে চেয়েছিল! কার্পেন্টার হতে চেয়েছিল! কাঠ মিস্ত্রীগিরি করতে চেয়েছিলো। আরেকজন বললোঃ কিন্তু অনুকরণ করতে করতে বেচারা বানরেরা তো তাদের সৃজনশীলতাই নষ্ট করে ফেলেছে। নিজেরা বুদ্ধি খাটিয়ে যে কিছু একটা করবে সেই শক্তিটাই হারিয়ে ফেলেছে তারা। তাই “মিস্ত্রীগিরি বানরের কাজ না।”

এই ঘটনার পর থেকে যখনই কেউ কোনো বিষয়ে না জেনেও সেই কাজে হস্তক্ষেপ করতে যেত এবং এমন ভাব দেখাতো যেন সে এ কাজের পণ্ডিত, জনগণ তখনই বলে উঠতোঃ “মিস্ত্রীগিরি বানরের কাজ না।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরো পড়তে পারেন...

চিন্টু ওস্তাদ

চিন্টুটার সব সময়ে সব কিছুতে ওস্তাদি। অসহ্য লাগে একেক সময়ে। কিছু একটা বলতে যাও অমনি…

অপু ও ফলচুরি রহস্য

মহানগরের কোলাহলের মাঝে, ব্যস্ত জনপথের কিছুটা দূরে একফালি সবুজ ল্যান্ডস্কেপ । সদ্য গড়ে ওঠা আবাসন…

ভালুক ও কাঠবিড়ালী

কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘খুকি ও কাঠবিড়ালী’ কবিতাটি কম-বেশি সবাই পড়েছে। এ কবিতাটির কারণেই ছোট্ট…