ভয়ঙ্কর !!!

তখন আমার বয়স প্রায় আঠারো। আমি ছোটবেলা থেকেই বেশ ফুর্তিবাজ ছিলাম। বাড়ির ছোট ছেলে হওয়ায় আমার কোনো কাজেই কোনোদিন কেউ বাধা দিত না। আমার একটি ঘোড়া ছিল, তার নাম মানিক। আমি মানিককে নিয়ে দূর-দূরান্তে ঘুরে বেড়াতাম। গান-বাজনা এবং যাত্রার প্রতি ছিল আমার দুর্নিবার আকর্ষণ।

একদিন খবর পেলাম দেওয়ানগঞ্জে যাত্রাদল এসেছে। আমি সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লাম। বিকেলের পর আমি পৌঁছাই। সন্ধ্যার পর যাত্রার আসর বসে, শেষ হয় অনেক রাতে। যাত্রা শেষে মানিককে নিয়ে আবার বকশিগঞ্জ পূর্ব পাড়ার উদ্দেশে রওনা দিলাম। আমি যখন পল্লাকান্দি, তখন রাত আনুমানিক ১০টা বা তার আশেপাশে। চারদিক নিঝুম রাত, পুরো এলাকা নিস্তব্ধ, নীরব। মাঝে মাঝে ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ আর রাতের আকাশের অচেনা পাখির আর্তনাদ। কখনো শোনা যায় হুতোম পেঁচার ডাক। পরিবেশটা মোটেও সুখকর নয়, তবে আমি ছিলাম শিক্ষিত এক সাহসী যুবক। গ্রাম্য কুসংস্কার কখনোই মনে দানা বাঁধতে দিতাম না। তাই নদীর পাড় ধরে এগিয়ে গেলাম নৌকার সন্ধানে।

ঘাটের একদম শেষ মাথায় একটি নৌকা পেলাম। নৌকায় মানিককে নিয়ে উঠলাম। আমার সাথে যাত্রী ছিল মাত্র একজন এবং নৌকার মাঝি। আমরা ছাড়া আশেপাশে আর কোনো জীবিত প্রাণীর অস্তিত্ব মনে হলো না। হঠাৎ মাঝি বলে উঠলো, “ভাইজান, আপনাকে দেখে তো মনে হয় বড় ঘরের ছেলে। এত রাতে এখানে কী করছেন? কোথায় যাবেন?”

আমি তাকে সব খুলে বললাম। সে বললো, “এত রাতে যাইয়েন না ভাই, বিপদ হইব।” আমি হেসে বললাম, “কোন ডাকাতের সাহসে কুলাবে আমার নাম শোনার পর?” তখন আমার সঙ্গের যাত্রী বলল, “ভাই, ডাকাত তো মানুষ। আমরা যে বিপদের কথা বলতেছি, সেটা ঠিক মানুষ না।”

আমি হেসে বললাম, “এসব আমি বিশ্বাস করি না।” তখন তারা বলল, “ভাই, তাও যাইয়েন না। আমাদের বাড়ি কাছেই, রাতটা কাটান, সকালে যান। পথে জন্তু-জানোয়ার তো থাকতেই পারে।” আমি বললাম, “আমার যেতেই হবে।”

তবুও তারা সাবধান করে দিলো এবং বলে দিলো সারমারা বাজার থেকে বাঁ পাশের রাস্তায় উঠতে, ডানে যেন না যাই—কারণ ওদিকটা জঙ্গল এলাকার ভিতর। কথাটা আমারও মনে ধরলো।

আমি নৌকা থেকে নেমে আবার রওনা দিলাম। রাত আনুমানিক ১টা। তখন আমি সারমারা বাজারে। চারপাশটা একেবারে শুনশান, যেন কোনো জীবনের অস্তিত্ব নেই। এমনকি পোকামাকড়েরও শব্দ নেই। পুরো এলাকা মৃত শহরের মতো। আমার তখন খুব খারাপ লাগছিল, মানিকেরও পানি দরকার ছিল। হঠাৎ দেখি ডান পাশে অনেক দূরে একটা বাড়ি দেখা যাচ্ছে, যার আঙিনায় আগুন জ্বলছে। আমি আশায় ওদিকে গেলাম। কিন্তু মানিক এগোতে চায় না।

এমন তো হওয়ার কথা না! মানিক তো কখনো অবাধ্য হয় না। ছোটবেলা থেকে আমি ওকে বড় করেছি। তবু ওকে রাস্তায় রেখেই বাড়িটার দিকে হাঁটা দিলাম।

বাড়ির আঙিনায় গিয়ে দেখি এক অগ্নিকুণ্ড জ্বলছে। কেউ যেন খড় দিয়ে আগুন ধরিয়েছে। আগুনের আলোয় দেখি, একজন নারী মাটিতে বসে হাড়ি-পাতিল মাজছেন। নীল শাড়ি পরা, মাথায় ঘোমটা—দেখেই বোঝা যায় নতুন বউ। একটু অবাক লাগলো—এত রাতে কেউ উঠানে বসে পাতিল মাজে?

আমি কাছে গিয়ে বললাম, “খালাগো, আমাকে একটু পানি দেবেন? আমার আর আমার ঘোড়ার জন্য।” তিনি পাতিল মাজা বন্ধ করলেন, কিন্তু কোনো কথা বললেন না।

আমি আবার বললাম, “ও খালা, শুনেন না?” এবার তিনি ধীরে ধীরে আমার দিকে মুখ তুললেন… যা দেখলাম, তা…

ঘোমটার ভেতর ঘুটঘুটে অন্ধকার। শুধু দুটি রক্তলাল চোখ, আর মুখের গহ্বরে থেকে একহাত লম্বা জিভ ঝুলছে। সেই জিভ নড়ে উঠলো আর বের হয়ে এলো এক আঙুল লম্বা দুইটা শ্বদন্ত। আমার দিন-দুনিয়া অন্ধকার হয়ে এলো। টলে পড়ার আগমুহূর্তে মনে হলো—বাঁচতে চাইলে পালাতে হবে!

আমি ঘুরে ছুট দিলাম রাস্তায়। পিছন থেকে এক জান্তব আর্তনাদ মিশ্রিত চিৎকার শুনতে পেলাম। মানিকের কাছে গিয়ে তাকে সামনের দিকে টেনে নিলাম। কিছুটা পথ যাওয়ার পর দেখি, চারজন মৌলানা টাইপের মানুষ আমার দিকে আসছেন। তারা এসে আমাকে বললেন, “ভাই, আপনি কি সরকার সাহেবের ছেলে?”

এত অন্ধকারে তারা আমাকে কীভাবে চিনলেন, বুঝলাম না। আমি বললাম, “হ্যাঁ।” তাদের সব খুলে বললাম। তারা আমাকে সঙ্গে করে একটা দেয়ালঘেরা বাগান টাইপ জায়গায় নিয়ে গেলো। বলল, “এই গেট দিয়ে ভিতরে যান, ওই গাছটার নিচে বসে থাকেন। ভয় পাবেন না, এখানে আপনি নিরাপদ। আমরা থাকার ব্যবস্থা করে আসছি। তবে আমাদের ছাড়া কেউ ডাকলে আপনি বের হবেন না।”

আমি ভেতরে গিয়ে গাছের নিচে বসে পড়লাম। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, বলতে পারি না।

ঘুম ভাঙলো ফজরের আজানের শব্দে। হালকা আলো ফুটেছে। দেখি, মসজিদের ছাদে মুয়াজ্জিন আজান দিচ্ছেন, আর সেখান থেকে হতবাক নয়নে আমাকে দেখছেন। মানিক দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে।

কিছুক্ষণ পর মুয়াজ্জিন আমার কাছে এলেন। জানতে চাইলেন আমি কে, এখানে কী করছি। সব খুলে বললাম।

তিনি গম্ভীর হয়ে বললেন, “প্রথমে যার পাল্লায় পড়েছিলেন, সে খুব খারাপ এক জিনিস। অন্ধকার জগতের বাসিন্দা। আপনি অল্পের জন্য বেঁচে গেছেন। ওই উজানতলী জঙ্গল তার এলাকা—উজানতলীর পিশাচ। সেখানে তো কোনো রাস্তা বা বাড়ি নেই, শুধু জঙ্গল। আপনি যা দেখেছেন, তা আপনাকে দেখানো হয়েছে।”

তিনি আরও বললেন, “যাদের আপনি পরে পেয়েছেন, তারা জিন। তবে ভালো জিন। তারা এই এলাকার পাহারাদার। আপনাকে এখানে এনে রেখেছে কারণ এই জায়গায় শয়তান ঢুকতে পারে না। চারদিকে তাকিয়ে দেখুন, এটা কোনো বাগান না—এটা একটা গোরস্থান। মুসলমানের গোরস্থান খুবই পবিত্র আর নিরাপদ জায়গা।”

আমি চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম, সত্যি, আমি একটা গোরস্থানের মাঝখানে। এই দিনের বেলাতেও আমার গায়ে কাঁটা দিল।

মুয়াজ্জিন বললেন, “এখনই রওনা হোন। কেউ পেছন থেকে ডাকলেও ফিরবেন না। এমনকি আমি ডাকলেও না।”

আমি সেখান থেকে রওনা দিলাম। কয়েকবার মনে হলো কেউ পেছন থেকে ডাকছে। কিন্তু মুয়াজ্জিনের কথামতো ফিরে তাকালাম না।

বাড়ি ফিরে নিমপাতা ফুটিয়ে গোসল করলাম। আর তওবা করলাম—রাত-বিরেতে আর বাড়ি থেকে বের হবো না।

সাদা লোমের লাল ছাগল

তাইফুন তালেক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *