ভজনের কপাল

ভজন বেলপাহাড়ির মানুষ নয়।ওর বাড়ি ঝাড়্গ্রামের ওদিকে।জমিজমা কিছু নেই।জঙ্গলের পাতা কুড়িয়ে নয়তো বাবুইঘাসের দড়ি পাকিয়ে দিন চলে।ওকে প্রতি বছর বেল্পাহারিতে আস্তে হয় অন্য অক কাজে।কলকাতার এক ট্যুরিস্ট কোম্পানির বেলপাহাড়িতে ছোটখাট এক হলিডে হোম আছে।বাজার থেকে মাইল কয়েক ভিতরে।চারপাশে মহুয়া,পিয়াল,সোনাঝুরি আর ঝাউয়ের মেলা।আর রয়েছে শালবন।নির্জন অরণ্য পরিবেশ।দিন কয়েক ছুটি কাটাবার জন্য চমৎকার।আসলে এটা ছোট এক বাংলোবাড়ি ছিল।হাতবদল হইয়ে এখন হলিডে হোম।

 

বাড়িটা সারা বছর প্রায় বন্ধই থাকে।মানুষের আনাগোনা শুরু হয় পুজোর সময় থেকে কয়েকটা মাস।ভজন এই সমায় এখানে মালির কাজ করে কোম্পানি থেকে একজন কেয়ারটেকারও আসে। পুজার দিন কয়েক আগেই তাই ভজন চলে আসে এখানে।ঘরদোর সাফ করে গুছিয়ে রাখে। ট্যুরিস্ট কোম্পানির মালিক চৌধুরী সাহেব প্রতিবছর সপরিবারে পুজোর ছুটির কয়েকটা দিন এখানে নিরিবিলিতে কাটিয়ে যান।উনি অবশ্য দিন সাতকের বেশি থাকেন না।তিনি চলে যাওয়ার পর একে-একে অনেকেই আসতে থাকে এরপর।সারা বছরের মধ্যে এই কয়েকটা মাসই ভজনের খুশির সময়।কিছু না হোক,দুবেলা পেট ভরে খেতে পায়।এছাড়া মাইনে বাবদ পাঁচশো টাকা আর চৌধুরী সাহেবের দেওয়া একটা কাপড়।গরম পড়তে শুরু করলে ট্যুরিস্ট কমে আসতে থাকে।সাধারণত মার্চের মাঝামাঝি তালা পড়ে যায় হলিডে হোমে।সুতরাং ভজনের কাজ শেষ।গোছগাছ করে সেও যাত্রা করে বাড়ির দিকে। সেবার তেমন ট্যুরিস্ট না থাকায় ফেব্রুয়ারি পড়তে না পড়তেই হলিডে হোম বন্ধ হয়ে গেল।কেয়ারটেকার আগের দিনেই চলে গেছে।কিন্তু ভজনের উপায় নেই।এরপর মাস কয়েক বন্ধ থাকবে বাড়ি।তাই তখনও অনেক কাজ বাকি।সব গুছিয়ে পরদিন ভোরের প্রথম বাস ধরবে।সব কাজ শেষ করে সেই রাত্তিরেই নিজের জিনিসপএগুলোও গুছিয়ে ফেলল ও।জিনিসপএ বলতে চৌধুরী সাহেবের দেওয়া সেই নতুন ধুতি আর কিছু পুরোনো জামাকাপড়। পুরোনো জামাকাপড়গুলা বেড়াতে আসা মেমসাহেবরা ফেরার সময় দিয়ে গেছেন।কিছু বকশিশও পাওয়া যায় ওঁদের কাছ থেকে।

গত কয়েক মাস ধরে ভজন সযন্তে জমিয়েছে এগুলা।এছাড়া ভাঁড়ার ঘরে শেয় সময়ে পরে থাকা কিছু ঝড়তিপড়তি খাবার।বাসি রুটিআর কেকের টুকরো।এছাড়া ভাঙা কিছু বিস্কুট।বাড়ির বউ ছেলেমেয়েরা এই সামান্য জিনিসগুলো জন্য পথ চেয়ে থাকে। ভজন কাছে তাই এসবের মূল্যও অনেক। ভাড়ার জন্য কিছু খুচরা আলাদা করে বাকি টাকাগুলো নতুন ধুতির ভাঁজের ভিতরে রেখে সেটা সাবধানে মুড়ে একটা পুঁটলি করে ফেলল ভজন।খাবারগুলো আগেই ছোট এক পুঁটলিতে বেঁধে নিয়েছিল।এরপর দুটো পুঁটলি একসাথে করে বাদবাদি পুরোনো জামাকাপড়গুলা তাঁর উপর পেঁচিয়ে দড়ি দিয়ে শক্ত করে বেঁধে ফেলল।সঙ্গে ব্যাগ নেই।জিনিসটা বগলদাবা করে নেবার পক্ষে চমৎকার।পরদিন ভোরেই বেরিয়ে পড়লো ও।পুব আকাশে সূর্য তখন ভাল করে দেখা দেয়নি।হলিডে হোমের পাশ দিয়ে সোজা পথ চলে গেছে বাজারের দিকে।দুধারে মহুয়া পিয়াল আর শালের বন।এই ভোরে পথে জনমানুষের চিহ্ন নেই।নির্জন পথে শুধু ভোরের পাখির কূজন। কাপড়ের পুঁটলিটা সাবধানে বগলে চেপে বাড়ির কথা ভাবতে- ভাবতে দ্রুত পথ চলছিল ভজন।হঠাৎ কাছেই ঘোঁৎ করে একটা শব্দ শুনে চমকে পাশ ফিরে তাকাল।পথের পাশে বাঁ দিকে মস্ত এক সোনাঝুরি গাছ।আওয়াজটা সেই দিকে।কিন্তু তাকিয়ে জমাট অন্ধকার ছাড়া কিছুই নজরে পড়ে না ওর।তবু খটকা যায় না।ভালুক নয়তো?কিন্তু এদিকে ভালুক আছে বলে শোনা যায় না।তবে এই ফাল্গুন মাস পড়লে কাছে বাঁশপাহাড়ি নয়তো কাঁকড়াঝোরের জঙ্গল থেকে মহুয়ার লোভে দুএকটা ভালুক চলে আসে কখনও।

কিন্তু ফাল্গুন মাস পড়ে গেলেও মহুয়া ফুলের মরসুম এখনও শুরু হয়নি।সাত-পাঁচ ভাবতে-ভাবতে আরও কয়েক পা এগিয়ে গিয়েছিল ভজন।হঠাৎ থপ্-থপ্ করে এগিয়ে আসছে তার দিকে। ভালুকটার ছুরির ফলার মতো মতো দুসার হিংস্র দাঁত আর বাড়িয়ে দেওয়া সামনের দুই পায়ের বড় বড় নখগুলো আধো অন্ধকারেও ঝকঝক করছে।জঙ্গল শালপাতা,কাঠ নয়তো বাবুইঘাসের খোঁজে যেতেই হয় ওদের।কিন্তু ভালুকের সামনে কখনও পড়তে হয়নি।তাই নির্জন পথে হঠাৎ ওই দৃশ্য দেখে ভজন এমন ভীষন ঘাবড়ে গেল যে,ছুটে পালাবার ক্ষমতাটুকুও হারিয়ে ফেলল।নিথর হয়ে তাকিয়ে রইল প্রাণীটার দিকে। এদিকে ঘোঁৎ_ঘোৎ শব্দে ভালুকটা ততক্ষণে দুপায়ে তার কাছে এসে পড়েছে।লম্বা নখওইয়ালা নুলো দুটো যে ভাবে সামনে বাড়িয়ে দিয়েছে তাতে আর একটু এগিয়ে এলেই ভজনের সঙ্গে শেষ কোলাকুলিটা সেরে ফেলতে পারবে।দেখে ভজনের সারা শরীর হঠাৎ ঠকঠক করে কাঁপতে শুরু করল।দুঁহাতে তুলে আতঙ্কে অন্তিম আর্তনাদ বেরিয়ে এল গলা দিয়ে। সেই আর্তনাদ নির্জন বনপথে কিছুমাএ আলোড়ন না তুললেও একটা ব্যাপার ঘটল।হাত উপরে তুলতেই ভজনের বগলের সেই কাপড়ের পুঁটলিটা ধুপ করে পড়ে রাস্তার ঢাল বেয়ে নীচে গড়িয়ে গেল।আর মুহূর্তে ভালুকটা ভজনের সঙ্গে কোলাকুলিটা মুলতুবি রেখে উবু হয়ে মাটিতে পড়ে চার পায়ে বোঁ করে ছুটে হুমড়ি খেয়ে পড়ল সেই পুঁটলির উপর। চার পা আর মুখ দিয়ে শক্ত করে বাঁধা পুঁটলিটা খুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ওই কান্ড দেখে হঠাৎ যেন ভজনের সংবিং ফিরে এল। মুহূর্তে পিছন ফিরে পড়ি কী মরি করে দৌড় লাগাল বাজারের দিকে। ভালুকটা অবশ্য ফিরেও তাকাল না।সে তখন নিবিষ্ট মনে পুঁটলি খুলতে ব্যস্ত।আর ভজন সেই দুমাইল পথ এক দমে দৌড়ে হাউমাউ করে এসে পড়ল বেল্পাহাড়ির বাজারের কাছে। সেই সকালে বাজারে দুচারজন যারা ছিল ছুটে এল।কাঁদতে-কাঁদতে ভজন যা ব্যক্ত করল তা শুনে সকলেই বলল,কপাল জোরে আজ বেঁচে গেছে ও।ভাগ্যিস,পুঁটলির মধ্যে খাবারগুলো ছিল।গন্ধ পেয়ে ভালুকটা তাই পুঁটলি খুলতে ব্যস্ত পড়েছিল।নইলে আর দেখতে হত না।গাঁয়ের মোড়ল শাল্কু মাঝি সেই সময় পথ দিয়ে যাচ্ছিল।অভিঙ্গ মানুষ।শুনে মাথা নেড়ে বলল,তা নয় রে বাপু।

আসলে ভালুকের ওই এক অদ্ভুত অভ্যাস ।সামনে কোনও কাপড়ের পুঁটলি দেখলে যতক্ষণ না সেটা ছিঁড়েখুঁড়ে খুলতে পাড়ছে ততক্ষণ স্বস্তি নেই ওদের। ভজনের বগল থেকে পুঁটলিটা পড়ে যেতে তাই সেটা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল।নইলে ভালুকটা যে ওকে আক্রমণ করতেই আসছিল,তাতে কিছুমাএ সন্দেহ নেই।সঙ্গে পুঁটলিটা ছিল বলেই ভজন আজ কপাল জোরে প্রানে বেঁচে গেছে। কিন্তু ভজনকে সেকথা বোঝাবে কে?বেচারা পুঁটলির শোকে তখন পাগলের মতো সমানে কপাল চাপড়াচ্ছে।

এক আলুতে বাতি জ্বলবে ৪০ দিন

গাধা ও গরু

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *