[এক নিমেষের চেনা] বৃষ্টির ঝম-ঝমানি শুনতে শুনতে সহসা আমার মনে হল, আমার বেদনা এই বর্ষার সুরে বাঁধা!… সামনে আমার গভীর বন। সেই বনে ময়ূরে পেখম ধরেছে, মাথার উপর বলাকা উড়ে যাচ্ছে, ফোটা কদম ফুলে কার শিহরণ কাঁটা দিয়ে উঠছে, আর কীসের ঘন-মাতাল-করা সুরভিতে নেশা হয়ে সারা বনের গা টলছে!… এটা শ্রাবণ মাস, না? – আহা, তাই অন্তরে আমার বরিষণের ব্যথাটুকু ঘনিয়ে আসছে! – সে হল আজ তিন বছরের কথা। আমার এই খাপছাড়া জীবন তার স্মৃতিগুলো ঝড়ের মুখে পদ্মবনের মতো ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে গেছে!
কখনও তার একটি কথা মনে পড়ে, কখনও তার আধখানি ছোঁয়া আমার দাগা-পাওয়া বুকে জাগে! মানস-বনের জুঁই-কুঁড়ি আমার ফুটতে গিয়ে ফুটতে পায় না, শিউলির বোঁটা শিথিল হয়ে যায়। ওরই সাথে এই শাওন-ঘন দেয়া-গরজনে আর এক দিনের অমনই মেঘের ডাক মনে পড়ে, আর আঁখি আমার আপনি জলে ভরে ওঠে! সেদিন ছিল আজকার মতোই শ্রাবণের শুক্লা পঞ্চমী। পথহারা আমি ঘুরতে ঘুরতে যেদিন প্রথম এই কালিঞ্জরে এসে পড়ি, সেদিন এখানে কাজরি উৎসবের মহা ধুম পড়ে গেছে – আকাশভরা হালকা জলো মেঘ আমারই মতো খাপছাড়া হয়ে যেন অকূল আকাশে কূল হারিয়ে ফিরছিল।
তারই ঈষৎ ফাঁকে সুনীল গগনের এক ফালি নীলিমা যেন কোন্ অনন্ত-কান্নারত প্রেয়সীর কাজল-মাখা কালো চোখের রেখার মতো করুণ হয়ে জাগছিল! পথ-চলার নিবিড় শ্রান্তি নিয়ে কালিঞ্জরের উপকণ্ঠের বাঁকে উপবনের পাশে তার সাথে আমার প্রথম দেখা। এই হঠাৎ দেখাতেই কেন আমার মনে হল, এ-মুখ যে আমার কত কালের চেনা – কোথায় যেন একে হারিয়েছিলাম! সেও আমার পানে চেয়ে আমার চাওয়ায় কী দেখতে পেলে সেই জানে, – তাই পথ চলতে চলতে তার হাতের কচি ধানের ছোট্ট গোছাটি মুখের উপর আধ-আড়াল করে আমায় জিজ্ঞেস করলে, – ‘পরদেশিয়া রে, তুহার দেশ কাহাঁ?’ সে স্বর আমার বাইরে ভিতরে এক ব্যাকুল রোমাঞ্চ দিয়ে গেল, বুকের সমস্ত রক্ত আকুল আবেগে কেঁপে কেঁপে নৃত্য করে উঠল! এ কোন্ চির-পরিচিত স্বর? এ কে ছলনা করে আমায়? পূবের হাওয়া আমার পাশ দিয়ে কেঁদে গেল – ‘হায় গৃহহীন, হায় পথহারা!’ ঝড়ে-ওড়া এক দল পলকা মেঘের মতো মল্লারের সুরে পথের আকাশ-বাতাস ভরিয়ে কাজরি গায়িকা রূপসিরা গেয়ে যাচ্ছিল, – ‘ঘুঙঘট-পট খোলো আরে সাঁবলিয়া!’ (ওগো শ্যামল, এখন তোমার ঘোমটা খুলে ফেল।) আমার কাছে তাকে এমন করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তরুণীরা আঁখির পলকে থমকে দাঁড়াল, তারপর চুল ছড়িয়ে বাহু দুলিয়ে আঁচল উড়িয়ে বলে উঠল, – ‘কাজরিয়া গে! ক্যা তোরি সাঁবলিয়া আ গয়ি?’ সে তাদের এক পাশে সরে গিয়ে কাঁপা-গলায় বললে, – ‘নহি রে সজনিয়া, নহি! য়্যে পরদেশি জোয়ান –’ তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে আর একজন বলে উঠল, – ‘ক্যা তেরি দিল্ ছিন্ লিয়া?’ সে লজ্জায় আর দাঁড়াতে পারল না, খামখা আমার দিকে অনুযোগ-তিরস্কার-ভরা বাঁকা চাউনি হেনে চলে গেল! পথের ওই বাঁক থেকেই অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছিল তাদের ধানি রং-এর শাড়ির ঢেউ আর আশমানী রং-এর ওড়নার আকুল প্রান্ত। রয়ে রয়ে তাদের এলানো কেশপাশ বেয়ে কেমন মধুর এক সোঁদা-গন্ধ ভেসে আসছিল। অতগুলি সুন্দর মুখের মাঝ থেকে আমার মনে জগজগ করছিল শুধু ওই কাজরিয়ার ছোট্ট কালো মুখ, – যা শিল্পীর হাতে কালো পাথর-কোঁদা দেবীমুখের মতো নিটোল! বিজলি-চমকের মতো তার ওই যে একটি দুরন্ত চপল গতি, তারই মধুরতাটুকু আমার মনের মেঘে বারে-বারে তড়িৎ হেনে যাচ্ছিল।
পথের পাশের দোলনা-বাঁধা দেবদারু-তলায় দাঁড়িয়ে আমার শুধু এই কথাটি মনে হতে লাগল, এই এক পলকের আধখানি চাওয়ায় কেমন করে মানুষ এত চিরপরিচিত হয়ে যেতে পারে। * * * [অভিমানের দেখা-শোনা] তার পরের দিন আমলকি বনে দাঁড়িয়ে সেই আগেকার দিনের কথাটাই ভাবছিলাম, – আচ্ছা, এই যে আমার মানসী বঁধু, – একে কবে কোন্ পুরবির কান্না-ভরা খেয়ার পারে হারিয়ে এসেছিলাম? সকল স্মৃতি উলট-পালট করেও তার দিন ক্ষণ মনে আসি-আসি করেও যেন আসে না, অথচ মনের মানুষ আমার একে দেখেই কেমন করে চিনে ফেললে। তাই সে আমার আঁখির দীপ্তিতে ফুটে উঠে বলে উঠল, – এই তো আমার চির-জনমের চাওয়া তুমি! ওগো, এই তো আমার চির-সাধনার ধন তুমি! … আর একবার আমার স্মৃতির অতল তলে ডুব দিলাম, এমন সময় ঝড়ের সুরে কাজরি গান গাইতে রূপসি নাগরীরা আমার পাশ দিয়ে উধাও হয়ে গেল, – চঢ়ে ঘটা ঘন ঘোর গরজ রহে বদরা রে হোরি। রিম ঝিম রিম ঝিম পানি বরষৈ রহি রহি জিয়া ঘাবরাবৈ রামা। বহৈ নয়নাসে নীর ময়েল ভয়ি কজরা রে হোরি! [ঘোর ঘটা করে গগনে মেঘ করেচে, বাদল গরজন করছে, রিম-ঝিম-রিম-ঝিম বৃষ্টি ঝরচে, থেকে থেকে জান আমার ঘাবড়িয়ে উঠছে, নয়ন বেয়ে আঁসু ঝরছে; – ওগো, চোখের কাজল আমার মলিন হয়ে গেল!] বর্ষার মেঘ চলে গেল। মর্মে আমার তারই গাঢ় গমক গুমরে ফিরতে লাগল, – ‘ময়েল ভয়ি কজরা রে হোরি!’ – ওগো প্রিয়, চোখের কাজল আমার মলিন হয়ে গেল! সে কোন্ অচেনার উদ্দেশ্যে এ অবুঝ-কান্না তোমার বিদেশিনি? সে-কথা সেও জানে না, তার মনও জানে না! … আবার সেই সন্তাপহারী আমার চিরবাঞ্ছিত মেঘ-গুরু-গরজনে ডেকে উঠল। বনের সিক্ত আকাশকে ব্যথিয়ে ময়ূরের কেকা-ধ্বনির সাথে চাতকের অতৃপ্তির কাঁদন রণিয়ে রণিয়ে উঠছিল, – ‘দে জল, দে জল!’ হায় রে চিরদিনের শাশ্বত পিয়াসী! তোর এ অনন্ত পিয়াসা কি সারা সাগরের জলেও মিটল না? আমার কেমন আবছা এক কণা স্মৃতি মনের কানে বলছিল, – ‘তুমি আগে এমনই চাতক ছিলে, তোমার পিপাসা মিটবার নয়!’ ভেজা মাটির আর খস-খস-এর গুমোট-ভরা ভারী গন্ধে যেন দম আটকে যাচ্ছিল; ও-ধারে ফোটা কেয়া ফুলের, আধফোটা যূথীর, বেলির কুঁড়ির, ঝরা শেফালি-বকুলের দিল্-মাতানো খোশবুর মাঝে মাঝে পদ্ম আর কদম্বের স্নিগ্ধ সুরভি মধুর আমেজ দিচ্ছিল! বর্ষার ব্যথা আমার দিকে গভীর মৌন চাওয়া চেয়ে শুধাচ্ছিল, – ‘এমন দিনে তারে বলা যায় এমন ঘন ঘোর বরিষায়!’ হায়, কী বলা যায়? কাকে বলা যায়? এ উতল-পাগল তার কিছুই জানে না, অথচ সে কী যেন বলতে চায় – কাকে যেন বুকের কাছে পেতে চায়! এই মেঘদূত তার কাছে তার পালিয়ে যাওয়া প্রিয়তমার সন্ধান করে গেছে, সেই চাওয়া-পাওয়াটুকুর বার্তা পৌঁছিয়ে দিয়ে গেছে, তাই সে মেঘদূতকে অভিনন্দন জানাচ্ছে – ‘এস হে সজল ঘন বাদল বরিষনে!’ আজ আর একবার মনে হল সে তার বিদায়ের দিনে বলেছিল, – ‘আবার দেখা হবে, তখন হয়তো তুমি চিনতে পারবে না!’ আজ সেই বিদায়-বাণী মনে পড়ে আমার বক্ষ কান্নায় ভরে উঠছে! আমার পাশ দিয়ে কালো কাজরিয়া যখন তার চাউনি হেনে চলে গেল, তখন ওই কথাটিই বারে বারে মনে পড়ছিল, – হয়তো তুমি চিনতে পারবে না!
তাই কাজরিয়াকে ডেকে বললাম, – ‘এই তো তোমায় চিনতে পেরেছি তোমার এই চোখের চাওয়ায়!’ কাজরিয়া চুল দিয়ে মুখ ঝেঁপে চলে গেল! তার ওই না-চাওয়াই বলে গেল, সেও আমায় চিনতে পেরেছে।… আবার তার অনুসন্ধানে বেরিয়ে পড়লাম। – ঝঞ্ঝার উতরোলের মতো দোল খেয়ে খেয়ে পাশের উপবন হতে তরুণী-কণ্ঠের মল্লার হিন্দোলা ভেসে আসছিল, – ‘মেঘবা ঘুম ঘুম বরষাবৈ ছাবৈ বদরিয়া শাওন মে!’ পথের মাঝে দাঁড়িয়ে দেখলাম, আকাশ বেয়ে হাজার পাগলা-ঝোরা ঝরছে – ঝম ঝম ঝম! যেন আকাশের আঙিনায় হাজার হাজার দুষ্টু মেয়ে কাঁকর-ভরা মল বাজিয়ে ছুটোছুটি করছে! তপোবনে গিয়ে দেখলাম, সেই বৃষ্টিধারায় ভিজে ভিজে মহা উৎসাহে বিদেশিনি তরুণীরা দেবদারু ও বকুল শাখায় ঝুলানো দোলনায় দোল খেয়ে খেয়ে কাজরি গাইছে। ঝড়-বৃষ্টির সাথে সে কী মাতামাতি তাদের! আজ তাদের কোথাও বন্ধন নেই, ওদের প্রত্যেকেই যেন এক একটা পাগলিনি প্রকৃতি! কী সুন্দর সেই প্রকৃতির উদ্দাম চঞ্চলতার সনে মানব-মনের আদিম চির-যৌবনের বন্ধ-হারা গতি-রাগের মিলন!–শাওন মেঘের জমাট সুরে আমার মনের বীণায় মূর্ছনা লাগল। আমার যৌবন-জোয়ারও অমনি ঢেউ খেলে উঠল। মনের পাগল অমনি করে দোদুল দোলায় দুলে সুন্দরীদের এলো চুলের মতোই হাওয়ার বেগে মেঘের দিকে ছুটল, – হায় কোথায়, কোন্ সুদূরে তার সীমা-রেখা! হিন্দোলার কিশোরীরা গাচ্ছিল কাজল-মেঘের আর নীল আকাশের গান। নীচে শ্যামল দুর্বায় দাঁড়িয়ে বিনুনি-বেণি-দোলানো সুন্দরীরা মৃদঙ্গে তাল দিয়ে গাচ্ছিল কচি ঘাসের আর সবুজ ধানের গান। তাদের প্রাণে মেঘের কথার ছোঁয়া লেগেছিল। … মেঘের এই মহোৎসব দেখে আপনি আমার চোখে জল ঘনিয়ে এল।
দেখলাম সেই কালো কাজ্রিয়া – দোলনা ছেড়ে আমার পানে সজল চোখের চেনা চাউনি নিয়ে চেয়ে আছে। আমার চোখে চোখ পড়তেই সে এক নিমেষে দোলনায় উঠে কয়ে উঠল, – সজনিয়া গে, ওহি সুন্দর পরদেশিয়া। তার সই মতিয়া দুলতে দুলতে বাদল-ধারায় এক রাশ হাসি ছড়িয়ে দিয়ে বলল, –‘হা রে কাজরিয়া, তুহার সাঁবলিয়া!’ কাজরিয়া মতিয়ার চুল ধরে টেনে ফেলে দিয়ে পাশের বকুল গাছটার আড়ালে গিয়ে দাঁড়াল। আমি ভাবছিলাম, এমনি করেই বুঝি মেঘে আর মানুষে কথা কওয়া যায় – এমনি করেই বুঝি ও-পারের বিরহী যক্ষ মেঘকে দূতী করে তার বিচ্ছেদ-বিধুরা প্রিয়তমাকে বুকের ব্যথা জানাত। আমার ভেজা-মন তাই কালো মেঘকে বন্ধু বলে নিবিড় আলিঙ্গন করলে! চমকে চেয়ে দেখলাম, সে কখন এসে আমার পাশে দাঁড়িয়েছে। তার গভীর অপলক দৃষ্টি মেঘ পেরিয়ে কোন্ অনন্তের দিগ্বলয়ে পৌঁছেছিল, সেই জানে। তার পাশে থেকে আমারও মনে হল ওই দূর মেঘের কোলে গিয়ে দাঁড়িয়েছি শুধু সে আর আমি। কেউ কোথাও নেই, উপরে নীচে আশে-পাশে শুধু মেঘ আর মেঘ, – সেই অনন্ত মেঘের মাঝে সে মেঘের-বরণ বাহু দিয়ে আমায় জড়িয়ে ধরে তার মেঘলা-দৃষ্টিখানি আমার মুখের উপর তুলে ধরেছে। ওইখানেই – ওই চেনা-শোনা জায়গাটিতেই যেন আমাদের প্রথম দেখা-শোনা, ওইখানেই আবার আমাদের অভিমানের ছাড়াছাড়ি, এই কথাটি আমাদের দুই জনেরই মনের অচিন কোণে ফুটে উঠতেই আমরা একান্ত আপনার হয়ে গেলাম। যে কথাটি হয়তো সারা জীবন চোখের জলে ভেসেও বলা হত না, এই ঝড়-বৃষ্টির মাঝখানে দাঁড়িয়ে এক নিমেষে চারটি চোখের অনিমিখ চাউনিতে তা কওয়া হয়ে গেল।
আমি বললাম – ‘কাজরি, আমি অনেক জীবনের খোঁজার পর তোমায় পেয়েছি!’ এই মেঘের ঝরায় যে প্রাণের কথা প্রাণ দিয়ে সে শুনছিল, সহসা তাতে বাধা পেয়ে সে সচেতন হয়ে উঠল। চখা হরিণীর মতো ভীত-ত্রস্ত চাউনি দিয়ে চারিদিকে চেয়ে আচমকা আর্ত আকুল স্বরে সে কেঁদে উঠল। সে আর দাঁড়াল না, হুঁকরে কাঁদতে কাঁদতে বিদায় নিলে। যেতে যেতে বলে গেল –‘নহি রে সুন্দর পরদেশি ম্যয় কারী কাজরিয়া হুঁ – ‘ওগো সুন্দর বিদেশি, আমি কালো।’ আরও কী বলতে বলতে অভিমানে ক্ষোভে তার মুখে আর কথা ফুটল না, কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে এল! একটি পুরো বছর আর তার দেখা পাইনি। আজ শাঙন রাতের মাতামাতিতে হৃদয় আমার কথায় আর ব্যথায় ভরে উঠেছে, আর তার সেই বিদায়-দিনের আরও অনেক কিছু মনে পড়ছে।
আজ আমার শিয়রের ক্ষীণ দীপশিখাটিতে বাদল-বায়ের রেশ লেগে তাকে কাঁপিয়ে তুলছে, আমার বিজন কক্ষটিতে সেই কাঁপুনি আমার মনে পড়িয়ে দিচ্ছে – হায়, আজ তেমন করে আঘাত দেবারও আমার কেউ নেই। প্রিয়তমের কাছ থেকে আঘাত পাওয়াতে যে কত নিবিড় মাধুরী, তা বেদনাতুর ছাড়া কে বুঝবে? যার নিজের বুকে বেদনা বাজেনি, সে পরের বেদন বুঝবে না, বুঝবে না… সে বলেছিল, – ‘দেখ বিদেশি পথিক। আমি নিবিড় কালো, লোকে তাই আমাকে কাজরিয়া বলে উপহাস করে; তাদের সে আঘাত আমি সইতে, উপেক্ষা করতে পারি, আমার সে সহ্যশক্তি আছে, কিন্তু ওগো নিষ্ঠুর! তুমি কেন আমায় ভালোবাসি বলে উপহাস করছ? ওগো সুন্দর শ্যামল। তুমি কেন এ হতভাগিনিকে আঘাত করছ? এ অপমানের দুর্বার লজ্জা রাখি কোথায়? জানি, আমি কালো কুৎসিত, তাই বলে ওগো পরদেশি, তোমার কী অধিকার আছে আমাকে এমন করে মিথ্যা দিয়ে প্রলুব্ধ করবার? ছি, ছি, আমায় ভালোবাসতে নেই – ভালোবাসা যায় না, ভালোবাসতে পারবে না। এমন করে আর আমায় দুর্বলতায় বেদনা-ঘা দিয়ো না শ্যামল, দিয়ো না! ও তো আমার অপমান নয়, ও যে আমার ভালোবাসার অপমান; তা কেউ সইতে পারে না।
– বিদায় শ্যামল, বিদায়!’ আমি মনে মনে বললাম, – ওগো অভিমানিনী। অভিমানের গাঢ় বিক্ষোভ তোমায় অন্ধ করেছে, তাই তুমি সকল কথা বুঝেও বুঝছ না। আমিও যে তোমারই মতো কালো। তুমি তো নিজ মুখেই আমায় শ্যামল বলেছ, অথচ সুন্দর বলছ কেন? তোমার চোখে তুমি আমায় যেমন সুন্দর দেখেছ, আমার চোখে আমিও তেমনই তোমার সৌন্দর্য দেখেছি। তোমার ওই কালো রূপেই আমার চির-আকাঙ্ক্ষিতাকে খুঁজে পেয়েছি, যেন সে কোন্ অনাদি যুগের অনন্ত অন্বেষণের পর! আর যদি অধিকারই না থাকে, তবে তুমি আর কারুর আঘাতে বেদনা পেলে না, অথচ আমার স্নেহ সইতে পারলে না কেন? আমারই উপরে বা তোমার কী দাবি পেয়েছ, যার জোরে সবারই আঘাত-বেদনাকে উপেক্ষা করতে পার, শুধু আমাকেই পার না? আমার বক্ষ দলিত করে কী করে আমায় এমন ছেড়ে যেতে পারছ? যার ভালবাসায় বিশ্বাস নেই, তার উপর তো অভিমান করা চলে না।
যাকে বুঝি, আর আমার দাবি আছে যে, আমার অভিমান এ সহ্য করবে, তার উপর অভিমান আসে, তারই উপর রাগ করা যায়। আমার যে তখন মস্ত বিশ্বাস থাকে যে, আমার এ অহেতুক অভিমানের আব্দার এ সহ্য করবেই – কেননা, সে যে আমায় ভালোবাসে। সে কোনো কথা বুঝল না, চলে গেল। এ তীব্র অভিমান যে তার কার উপর, নিজেই বলতে পারত না, তবে কতকটা যেন তার এই কালো রূপের স্রষ্টার উপর। তার বুক-ভরা অভিমান আহত পক্ষী-শাবকের মতো যেন সেই দুর্বোধ্য রূপস্রষ্টার পায়ে লুটিয়ে পড়ে বলেছিল, – ওগো, আমাকেই কি সারা দুনিয়ার মাঝে এমন করে কালো কুৎসিত করে সৃষ্টি করতে হয়? তোমার কুম্ভ-ভরা রূপের একটি রেণু এ-অভাগিকে দিলে কি তোমার ভরা-কুম্ভ খালি হয়ে যেত? যদি কালো করেই সৃষ্টি করলে তবে ওই অন্ধকারের মাঝে আলোর মতো ভালোবাসা দিলে কেন? আবার অন্যেরে দিয়ে ভালোবাসিয়ে লজ্জিত কর কেন? … হায়, সে যে কখনও বোঝেনি যে, সত্য-সৌন্দর্য বাইরে নয়, ভিতরে – দেহে নয়, অন্তরে।
আমি সেদিন এই একটা নতুন জিনিস দেখেছিলাম যে, যতদিন সে কারুর ভালোবাসা পায়নি, ততদিন তার সারা জনমের চাপা অভিমান এমন বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেনি; কিন্তু যেই সে বুঝলে, কেউ তাকে ভালোবেসেছে, অমনি তার কান্না-ভরা অভিমান ওই স্নেহের আহ্বানে দুর্জয় বেগে হাহাকার করে গর্জন করে উঠল। এই ফেনিয়ে-ওঠা অভিমানের জন্যেই সে যাকে ভালোবাসে, তাকে এড়িয়ে গেল। এমন ভালোবাসায় যে প্রিয়তমাকে এড়িয়ে চলাতেই আনন্দ। এ বেদনা-আনন্দের মাধুরী আমার মতো আর কেউ বোঝেনি। হায়, আমার মনের এত কথা বুঝি মনেই মরে গেল। এ জীবনে আর তা বলা হবে না। গল্পের দ্বিতীয় অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন