ফাঁদ

রাতুলদের মুরগীটা নতুন বাচ্ছা ফুটিয়েছে। ভীষণ আনন্দ হচ্ছে রাতুলের। কি সুন্দর ফুটফুটে দশ দশটা মুরগীর বাচ্ছা। হলুদ রং। ছোট ছোট বাচ্ছাগুলো সারাক্ষন মা’র সাথে খেলছে। আর চিঁ চিঁ শব্দ করছে। কিছুতেই মার কাছ ছাড়া হচ্ছে না। ছোট্ট রাতুল কতবার চেষ্টা করেছে, বাচ্ছাগুলোকে একটু হাতে নিয়ে আদর করতে। ধরতে গেলেই মা মুরগীটা তেড়ে আসে। পাখা ঝাপটিয়ে এই বুঝি কামড় দেবে। আর একটা ব্যাপার লক্ষ্য করছে রাতুল। যখনি উপর দিয়ে কোন কাক কিংবা শালিক উড়ে যায় মা’টা বাচ্ছাগুলোকে পাখার ভিতর লুকিয়ে ফেলে। বাইরে থেকে বোঝার সাধ্য নেই মা মুরগীটার পাখার ভিতরে দশ দশটা বাচ্ছা। রাতুল স্কুল থেকে ফিরে মুরগীগুলোর সাথে সাথে থাকে। গতিবিধি লক্ষ্য করে। রাতুল ব্যপারটা স্কুলের বন্ধু মুহিতের সাথেও আলাপ করেছে। মুহিতের বাড়ীতে অনেকগুলো মুরগী। মুহিতের বাবা নেই। মা হাঁস, মুরগী ও গরু ছাগল পালিয়ে সংসার চালায়। রাতুলের সাথে সেও ক্লাস ফাইভে পড়ে। মুহিত ও তার বড় বোন ফাতেমা মা’কে সাহায্য করে। সময়মত হাঁস মুরগীগুলোকে খাবার দেয়।

মুহিত গরু চাগলগুলোকে মাঠে চড়াতে নিয়ে যায়। সন্ধ্যা হলে কাঁচা ঘাস খাইয়ে পেট ভর্তি করে তারপর গোয়াল ঘরে বেঁধে রাখে। মুহিত গরু ছাগলগুলোকে খুব ভালোবাসে। গরুটার রং কালো বলে নাম রেখেছে কালু। ছাগলটা সাদা। তাই নাম রেখেছে ধলি। ছাগলের তিনটা বাচ্ছা। বাচ্ছাগুলোর নামও রেখেছে। মুহিতের অভিজ্ঞতা কম নয়। তাই রাতুলকে সাবধান করে বলেছে, মুরগীর বাচ্ছাগুলোকে এই সময় দেখেশুনে রাখতে হবে। কাক অথবা চিল দেখলে চোঁ মেরে নিয়ে যাবে। তাই একটা বাঁশের খাঁচার ভিতর রেখে উপরে একটা ভারী পাথর অথবা কাঠ চাপা দিয়ে রাখতে হবে। রাতুলের বাবা বাজার থেকে বাঁশের খাঁচা কিনে এনেছে। রাতুলও মুরগীটাকে খুব ভালোবাসে। কিন্তু বাচ্ছাগুলোকে কোনভাবে ধরতে পারছে না। এমনকি সকালে খাঁচা থেকে বের করার সময়ও অনেক চেষ্টা করেছে। কোনভাবেই হাতে নিয়ে একটু আদর করতে পারছে না। মা মুরগীটা যেভাবে তেড়ে আসে তাতে রাতুলের ভয় হয়। মা বার বার বলছে, এই সময় ধরিস না। মা’টা রেগে যাবে। রাতুল ওসব বুঝে না। সে বলেছে, আমি তো শুধু একটু আদর করব। মা বলেছে, তুই আদর করবি, তা তো আর মা মুরগীটা বুঝবে না। সে ভাববে তার বাচ্ছাগুলোর কোন ক্ষতি হবে।

তাই সে সবসময় সতর্ক থাকে। শুধু মুরগী কেন, মানুষদের মধ্যেও সব মা বাবারা চায় তার ছেলে মেয়েরা নিরাপদে বড় হয়ে উঠুক। শত কষ্ট করে হলেও তারা ছেলেমেয়েদের সকল বিপদ আপদ থেকে আগলে রাখে। রাতুল মা’র সাথে মুরগীগুলোর যতœ নেয়। একটা বেতের টুকরির মধ্যে শুকনো খড় বিছিয়ে মুরগীগুলোর থাকার ব্যবস্থা করেছে। তারপর রাতে ইঁদুর বেড়ালের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য টুকরির উপরে বাঁশের খাঁচা দিয়ে ঢেকে একটা ভারী কাঠ দিয়ে চাপা দেয়। এতে মা মুরগীটা ভীষণ খুশী। রাতে গিয়ে কয়েকবার দেখেও আসে রাতুল। বাচ্ছাগুলোকে আর দেখা যায় না। পরম মমতায় মা মুরগীটা বাচ্ছাগুলোকে পাখা দিয়ে আগলে রাখে। রাতুল ভাবে, হয়তো ঠান্ডা লাগবে। তাই মা বাচ্ছাগুলোকে ওম দিচ্ছে। রাতুল একটা ছালার চট দিয়ে খাঁচাটা ঢেকে দেয়। আজ রাতুলের খুব মন খারাপ। সকালে বাচ্ছাগুলোকে খাঁচা বের করার সময় আনন্দে লাফাচ্ছিল। যে যার মত ছুটছে।

মা’টা ছুটছে পিছন পিছন। ওদিকে উঠোনে লিচু গাছের ডালে যে একটা দুষ্টু কাক বসেছিল কেউ খেয়াল করেনি। অমনি ছোঁ মেরে একটা বাচ্ছাকে তুলে নিয়ে উড়াল দিল। রাতুলের মা বাচ্ছা নিয়ে গেলো বলে চিৎকার করছে। রাতুলের ইচ্ছা হলো একটা ঢিল মেরে কাকটাকে মাটিতে ফেলে দিতে। কাক ততক্ষন অনেক দুরে। ছোট্ট বাচ্ছাটা চিঁউ চিঁউ করে কান্না করছে। স্কুলের শিক্ষক জিজ্ঞাসা করল-রাতুলের মন খারাপ কেন। রাতুল ঘটনাটা খুলে বলল। শিক্ষক বলল, এজন্য মন খারাপ করতে নেই। বাকী যেগুলো আছে ওগুলোর ভালোমত যত্ন নাও আর দেখে শুনে রাখো। তাহলে দেখবে বিপদ কম হবে। তবুও রাতুলের লেখাপড়ায় কিছুতেই মন বসছে না। স্কুল ছুটির পর মুহিত রাতুলের কাঁধে হাত রেখে বলল, আমি ফাঁদ পাততে জানি। কোনভাবে একটা কাক ধরা পড়লে হবে। আর কোন কাক জীবনেও আসবে না। বিকালে মুহিত আর রাতুল মিলে লম্বা একটা সুতলির এক মাথায় গিট দিয়ে ফাঁদ তৈরী করল। গোল বৃত্ত করে ফাঁদটা মুরগীর খাঁচার কাছাকাছি পেতে দিল। বৃত্তের ভিতর ক’টা ভাত ছিটিয়ে দিল রাতুল।

তারপর রাতুল ও মুহিত দূরে খড়ের গাদার আড়ালে গিয়ে সুতলির অন্য মাথাটা ধরে চুপ করে বসে আছে। এদিকে মুরগীগুলো কিচির মিচির করছে। আর খাবার দেখে কয়েকটা কাক গাছের মগডালে বসে কা কা করছে। কিছুক্ষনের মধ্যে খাবারের লোভে একটা কাক সুতার কুন্ডলী-তে এসে ভাত খেতে শুরু করল। অমনি মুহিত সুতোর মাথা ধরে জোরসে দিল এক টান। ব্যাস ফাঁদে গিট্টু লেগে কাকের একটা পা আটকে গেল। কাক আর কিছুতেই সুতা ছিড়ে পালাতে পারছে না। কা কা করে সারা বাড়ি মাথায় তুলে পালাতে চেষ্টা করছে। পারছে না। রাতুলের হাতে সুতো দিয়ে খুব সাবধানে কাকটাকে ঝাপটে ধরল মুহিত। তারপর শক্ত করে গাছের সাথে বেঁধে রাখল। মুহুর্তের মধ্যে চারপাশ থেকে কালো কাকের দল এসে হাজির। তারা বন্ধুকে ছাড়িয়ে নিতে আসছে। কা কা শব্দে সারা বাড়ি মাথায় তুলছে। কিন্তু বন্দি কাক আর কোনভাবেই পালাতে পারছে না। অন্য কাকগুলোও আর নীচে নামতে সাহস পাচ্ছে না। রাতুলের খুব রাগ হচ্ছে। ইচ্ছে করছে একটা বেত নিয়ে কাকের গায়ে কয়েক ঘা মারতে। কিন্তু কাছে যেতে সাহস পাচ্ছে না। কাকটা ছোঁ মেরে পাল্টা আঘাত করতে আসছে। তাছাড়া ঠিক কোন কাকটা মুরগীর বাচ্ছা নিয়ে পালিয়েছে, সেটা রাতুল বুঝতে পারছে না। মুহিত যাবার সময় বলে গেল এই কাকটা যতক্ষণ বাঁধা থাকবে ততক্ষন আর কোন কাক আসতে সাহস করবে না। সন্ধ্যায় রাতুলের বাবা দোকান থেকে ফিরে পুরো ব্যাপারটা শুনে বলল-দ্যাখো, একটা কাক না হয় তোমার মুরগী খেয়েছে। এই কাক যে সেই কাক তা তুমি চিনবে কি করে।

তাছাড়া এই একটা কাকের জন্য দেখ কতগুলো কাক তাদের বন্ধুর জন্য কষ্ট পাচ্ছে। মানুষের যেমন একতা আছে তেমনি পাখিদেরও আছে। এখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। তারপরও দেখো কতগুলো কাক একসাথে গাছের ডালে বসে কা কা করছে। তারা তোমাকে অনুরোধ করে বলছে, আমাদের বন্ধুকে ছেড়ে দাও। একজন অপরাধীর জন্য তো সবাই কষ্ট পেতে পারে না। রাতুল বুঝল ঠিকই তো। এখন রাত হয়েছে। তবুও অনেকগুলো কাক গাছে বসে আছে। রাতুল কাকগুলোকে খেতে দিল। কিন্তু ওরা কিছুই খেল না। শুধু কা কা করে কাঁদছে। বাবা বলল-তোমার মুরগী যখন খেয়েছে তখন আজ না হয় শাস্তি দাও। কাল সকালে ছেড়ে দিও। ঠিক আছে। রাতুল আচ্ছা বলে সায় দিল। রাতুল ঘুমাতে গেল। কিন্তু ঘুম আসছে না। সারা রাতভর কাকগুলো কা কা করে চিৎকার করে যেন বলছে-রাতুল প্লিজ, আমাদের বন্ধুকে ছেড়ে দাও। আমরা আর কখনও তোমার মুরগীর ক্ষতি করবো না। রাতুলের খুব মায়া হলো। সকালে ঘুম থেকে উঠেই ফাঁদের দড়িটা খুলে দিল। আর অমনি সব কাকগুলো একসাথে হাসতে হাসতে আকাশে উড়ে গেল। রাতুল আকাশের দিকে তাকিয়ে ওদের চলে যাওয়া দেখছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরো পড়তে পারেন...

ডিলিউশান

পাহাড়ি রাস্তা ধরে চলার সময় বাসটা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলল। জানালা দিয়ে পাহাড়, বড় বড় গাছ…

টিউবলাইট —- ঋতম সেন

বারান্দার সামনে দিয়ে তিনটে সাদা তার চলে গ্যাছে। রাস্তার ওপারের গাছটা ঝাঁকড়া হয়ে ল্যাম্পপোস্টটাকে প্রায়…

টাইটানিক বৃষ্টি– ইন্দিরা মুখার্জি

সেদিন তিন্নি পার্কে বসেছিল দাদুর সাথে। উঠল ভীষণ ঝড়, পড়ল বাজ, চমকাল বিদ্যুতমালা আকাশের গায়…