পুরস্কারের বখরা

রসিক-গোপালের পুরস্কারের ভাগ দেওয়ার কেরামতির একটি মজার কাহিনী এবার শোনা যাক্। একবার মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র, সভাসদ ও আত্নীয় স্বজন পরিবার বর্গ নিয়ে তার বাগানবাড়িতে আনন্দ-আমোদ-প্রমোদ হবে। রাজা সকলকে নিয়ে খুব সকালেই যাত্রা করলেন। গোলকেও সঙ্গে আসতে বলেছিলেন, গোপাল বৌ-এর মুখের জন্য বাজার ক’রে না দিয়ে যেতে পারে না। যেদিন বাজার না করে দিয়ে যায়, সেদিন বাড়িতে খুব অশান্তি হয়। একথা সোজাসুজি না বলে মজা করার জন্যে মহারাজকে বলল, ‘আমার একটু ইয়ে…. কোন ব্যাপার নয়, আমি পরে আসছি মহারাজ।
আমার জন্য আপনাদেরকে চিন্তা-ভাবনা করতে হবে না।’ গোপাল সঙ্গে এলো না, এতে রাজা মনে খুব রেগে গেলেন। তাকে জব্দ করবার জন্যে বাগানবাড়িতে পৌছেই দারোয়ানকে হুকুম দিলেন- ‘গোপাল এলে তাকে একটু ভুগিয়ে নিয়ে তারপর ভেতরে ঢোকাবে। একথা যেন মনে থাকে- বার বার বললেন দারোয়ানকে, যেন তার ভুল না হয়। প্রথমে বলবে ‘যারা পরে আসবে, তাদের ভেতরে আজ ঢোকার হুকুম নেই।’ এই বলে মহারাজ হুকুম দিয়ে ভিতরে চলে গেলেন। গোপাল খানিকক্ষণ পরে এল। তখন দারোয়ান পথ ছাড়ে না কোনমতেই। দারোয়ন বলে ‘মহারাজের হুকুম, যে দেরীতে আসবে তার আজ ভেতরে যাবার কোন উপায় নেই, অতএব আপনি ফিরে যান তাছাড়া আমি কিছু করতে পারব না।’ গোপাল বুঝলো, তাকে জব্দ করার জন্যে রাজার এ একটা কৌশল মাত্র। সে দারোয়ানকে অনেক খোসামোদ করে শেষে বললেন, ‘তুমি বেশ ভালোভাবেই জানো আমি রোজই মহারাজের কাছ থেকে কিছু না কিছু পুরস্কার পেয়ে থাকি। তোমায় কথা দিচ্ছি আজ যা পুরস্কার পাবো অবশ্য তার অর্ধেক তোমার জন্য।’ দারোয়ান ভাবল, মহারাজ তো গোপালকে ভিতরে যেতে একেবারে বারণ করেন নাই। তবে এ-সুযোগটা হারাই কেন? অর্ধেক পুরস্কারও পাওয়া যাবে। এদিকে গোপালকে হাতে রাখাও যাবে। কারণ বিপদে আপদে গোপাল রক্ষা করে বুদ্ধি দিয়ে। গোপালের বুদ্ধি না নিলে চাকরী বজায় রাখাও ভিষণ দায়। তখন পুরস্কারের লোভে, দারোয়ান মনে মনে ভাবল মহারাজ গোপালকে ভিতরে ঢুকতে দিতে বারণ করেন নি। একটু শুধু ভোগাতেই বলেছিলেন মাত্র। তবে গোপালকে যেতে দিলেই বা দোষ কি! যেহেতু গোপাল রাজার প্রি-পাত্র। গোপাল ভিতরে ঢুকেই হৈ চৈ গোলমাল শুরু করে দিলো।
একে গালি দেয়, ওকে মারতে যায়, ওকে ঠেলে ফেলে দেয়, তুলকালাম কান্ড। মহারাজ বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘কি আরম্ভ করেছো গোপাল। এলে তো দেরি করে সকলের পরে, এসেই অত মেজাজ দেখাচ্ছো কেন, চুপ করে থাকো। গোপাল মতলব করেই এসেছে গোলযোগ বাধাবার। সে রাজাকেও খাতির না করে, সোজা জবাব দিলে ‘গোপাল সব সময় এরকম মেজাজা দেখিলে থাকে। মহারাজ আপনার যদি পছন্দ না হয় সোজাসুজি বলুনেোপাল এক্ষুণি চলে যাচ্ছে আপনার মুলুক ছেড়ে ভিন দেশে। যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা? রাজার ‍মুখের ওপর এত বড় অপমান? রাজা রেগে গেলেন ভয়ানক। হুকুম দিলেন- “এক্ষুণি একশোবার কান ধরে উঠতে বসতে হবে সবার সামনে এবং দশ টাকা জরিমানাও দিতে হবে।’ গোপাল অমনি, এক, দুই, তিন- খুব জোরে জোরে আওড়াতে আওড়াতে কান ধরে উঠতে বসতে লাগলো। সভা-সুদ্ধ লোক হাসাহাসি করে আর এ-ওর মুখপানে চাইতে লাগলো। হঠাৎ গোপাল কান ধরে উঠা-বসা বন্ধ করে বলে উঠলো, এই আমি পঞ্চাশবার উঠেছি বসেছি মহারাজ। এই নিন পাঁচ টাকা।
আমার আজকের পুরস্কারের একজন অংশীদার আছে। বাকী পঞ্চাশবার ও ৫ টাকা জরিমানা তার পাওনা মহারাজ।’ পুরস্কারের অংশীদার? রাজা অবাক হয়ে ব্যাপার জানতে চাইলেন। গোপাল তখন দারোয়ানের কথা প্রকাশ করে বললেন, অর্ধেক পুরস্কার কবুল না হওয়া পর্যন্ত দারোয়ান আমাকে কিচুতেই ভিতরে ঢুকতে দেয়নি। রাজা একথা শুনে রেগে উঠলেন। গোপালকে ভোগাবার কথাই তিনি দারোয়ানকে বলেছিলেন। তার কাছে ঘুষ নিতে তো তিনি বলে দেননি। সঙ্গে সঙ্গে দারোয়ানকে ডাকা হলো এবং গোপাল পঞ্চাশবার নিজে নিজেই কান ধরে উঠেছিল বসেছিল কিন্তু দারোয়ানের কান ধরে উঠাবার বসাবার জন্য বাগদী পাইকদের ডাক পড়লো গোপালের ফন্দীতে, তারা একে একে কান ধরে উঠাবার বসাবার জন্য কান প্রায় ছিড়ে গেল।
কান এমন জ্বালা করতে লাগল যে, যেন প্রাণ যায় এবং পাঁচ টাকা জরিমানাও দিতে হল। গোপালের কাণ্ড দেখে রাজা রাগ ভুলে গিয়ে হেসেই উত্তর দিলেন ধন্যি, গোপাল। গোপালও হেসে তার দেরীর কারণ সব খুলে বলল। তার বৌ এমন দজ্জাল যে, তার কথা শুনতেই হবে। মহারাজ তখন সন্তুষ্ট চিত্তে গোপালকে ১০০ টাকা পুরস্কার দিলেন। এদিকে দারোয়ান মনে মনে ভাবছে কার মুখ দেখেই যে উঠেছিলাম কানকে-কান গেল আবার আমার নগদ পাঁচটা টাকাই গেল। ধন্যি, গোপাল ধন্যি। আর কোনদিন এ ভুল করব না। সারা জীবন যতদিন বাঁচব আমার এ কথা মনে থাকবে।

গোপালের অতিথি-সৎকার

বড় হতে নেই কো বাধা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *