সুর্যটা ডুবতে বসেছে। সেই সাথে রাসেল ও। ত্রিশ বছরের জীবন এতো দ্রুত শেষ হয়ে যাবে… ডিমের কুসুমের আকার নিয়ে রক্তিম ভানু অস্তাচলে যাই যাই করছে। সামনে পিছনে আঁধারের ব্যাকগ্রাউন্ড নিয়ে এক অপুর্ব বিষাদময়তা লেজের মত অদৃশ্য রশ্মিতে বাঁধা! সামনে কেউ নেই। পেছনে অনেকে থেকেও নেই। একা একজন মানুষ। স্মৃতির মিনারে আজনম ক্লান্ত এক পথিক পথের শেষে এসে বিষন্ন প্রহর গুনছে!
কি করছে এখন রেবেকা? নিজের মনের গভীরে তাঁকে নিয়ে একজন এই বেলা শেষে নদীর পাড়ে বসে ভাবছে- একটুও অনুভব করছে সে? হয়তো… হয়তো না। নিজের স্বপ্নবৃত্তের মায়াজালে এক সুপুরুষ তার ঠোঁটে সহস্র বার ভালবাসার চুম্বনলিপি এঁকে যাচ্ছে! সে কি টের পাচ্ছে? শিহরিত হচ্ছে? রাসেলের একান্ত ভূবনের দরোজার বাইরে দিয়ে কি রেবেকা সন্তর্পনে হেঁটে চলেছে? না হলে কিভাবে রাসেল ওর ঘ্রাণ পায়! ওর হাসির ঝংকার শোনে-অনুভবে কল্পনাতে শিহরিত হয়! দু’হাত বাড়িয়ে নিজের চাওয়া-পাওয়ার গণ্ডিকে অতিক্রম করে এক অপার্থিব বাসনায় ক্রমেই সিক্ত হয়ে চলে রাসেল।
এত কষ্ট কেন ভালোবাসায়? সেই প্রথম প্রহর মনে পড়ে গেল। ওদের দু’জনের ফেলে আসা সোনালী অতীত। কত কথা… নিরন্তর ভালোলাগায় আপ্লুত মুহুর্তগুলোতে কাছে আসা… একজন অপরকে ছুঁয়ে দেয়া… শরীরে… মনে… শরীর এবং মনের বাইরে যদি আরো কিছু থেকে থাকে সেই বিমুর্ত অবয়বে! অভিমানী সময়! সব কিছু ওলটপালট করে দেয়া অতীতের খন্ড খন্ড চিত্রগুলো স্লো-মোশন ছবির মত রাসেলের মনে পড়ে যায়। সেদিন ছিল মেঘে ঢাকা এক বিষন্ন বিকেল। ক্যাম্পাসের জারুলতলার ওদের নিবিড় মুহুর্তগুলোর সাক্ষী কৃষ্ণচূড়া গাছটির নীচে শেষ দেখা হবার সময়টিকে মনে হল ‘এই তো কিছুক্ষণ আগের’। অথচ গিয়েছে চলি শত সহস্র ক্ষণ… সময়ের তমসাঘন আঁধার ফুঁড়ে স্মৃতির রূপালী ঝলক রাসেলের বিমর্ষ বদনে নিস্প্রাণ জোয়ার এনে ওকে ভাবালুলতায় ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চায়।
‘আমার কিছু করার নেই রাসেল। আমি চলে যাচ্ছি তোমাকে ছেড়ে।’ কেন এভাবে চলে যাওয়া? এভাবেই কি চলে যেতে হয়? তবে আসাই বা কেন? ভালবাসার সুখস্বপ্নে বিভোর হবার আশা জাগানিয়া দুঃস্বপ্ন দেখতে হবে কেন? নিজের পরিবারের কথা যদি ভাবতেই হবে, ওর হৃদয়কে কেটে ফালা ফালা করে দিয়ে তারপর কেন? সময়ের মাঝের অসময়কে একা রাসেলই কেন তীব্রভাবে অনুভব করবে? কেন? কেন? এরকম হাজারো বার প্রশ্নের সুচাগ্র অংকুশে বিদ্ধ হয়েছে শুধু। উত্তর মেলেনি। গত দু’টো মাস একই তাড়নায় কেটেছে সকাল-দুপুর-বিকেল-রাত… ফের সকাল।
আজ রেবেকা অন্য কারো হাত ধরে চলে যাচ্ছে। দেশ ছেড়ে… রাসেলের জীবন ছেড়ে…। স্মৃতিময় কৃষ্ণচুড়ার শিকড়ের আশপাশের লাল ঝরাপাতার দীর্ঘশ্বাসকে কি রেবেকা ওর বুকে বয়ে নিয়ে যাবে? রেবেকারা কি ওসব বয়ে বেড়ায়? একজন মানুষ আর একজনের সাথে দীর্ঘ অভ্যাসময় অভ্যস্ততার নিগড় থেকে কি এতো সহজেই মুক্তি পেতে পারে? অনেকগুলো তীব্র অনুভূতি কিছু নিরন্তর জিজ্ঞাসায় রূপ নিয়ে একসময় এক জিঘাংসায় পরিণত হতে চাইলো। ভালোবাসা সেই অশুভ শক্তিকে প্রকট হতে দিলো না। সেই প্রচণ্ড খরতাকে টিপটিপ বর্ষণের দ্বারা নিস্তেজ করে দিলো।
এখন সুর্য ডোবার ক্ষণে এখানে বসে রাসেল এইসব ভাবছিল। রেবেকা নামের এক যুবতী ওকে ভালোলাগার প্রহ্লাদে মাতিয়ে আজ অন্য কারো হতে চলেছে। সে যে হাত ধরে নতুন জীবনের পথ পাড়ি দেবে, ঐ হাত রাসেলের হবার কথা ছিল। সুর্য রশ্মি নদীর জ্বলে চিকচিক করছে। তার প্রবাহমান জল যেন রেবেকার চুল! সেখানে আলোক রশ্মির প্রতিফলন রেবেকাকে যেন উদ্ভাসিত করছে। রাসেলের দৃষ্টিতে এমনই মনে হল। ওর মনে হল সে ঐ আগ্রাসী জলের ভিতরে ঝাঁপিয়ে পড়ে এ জীবন শেষ করে দেয়। এক দন্ড শান্তি পায়।
ওর হৃদয় উপচে ভালোবাসাগুলো সব চলে যাচ্ছে… নদীর তীব্র স্রোতের সাথে মিশে বুদবুদ সৃষ্টি করে। একা হবার অনুভূতি কত যে তীব্র কেউ কি জানে? ওর প্রেয়সীকে অন্য কোনো বাহু দৃঢ় আলিঙ্গনে ভালোলাগার পরশ বইয়ে দেবে! অন্য কেউ ওকে ভালোবাসবে! ওর চিবুকের নীচের তিলটিকে ছুঁয়ে দিয়ে এক অনুপম কাব্য রচনা করবে! কপালের উপর থেকে নেমে আসা কয়েকটি এলোমেলো চুল সরিয়ে অচেনা একজন ওকে গভীর দৃষ্টিতে শিখাবে ভালবাসার প্রথম পাঠ! ওহ! অসহ্য! কিন্তু মেনে নিতেই হবে এমন বাস্তবের অবাস্তব প্রহসন!
নদীর উপর দিয়ে বেলা শেষে বাড়ি ফেরা এক শঙ্খ চিলের তীব্র চীৎকারে সম্বিৎ ফিরে রাসেলের। আসলেই কি ফিরে? জীবনের এই পর্যায়ে এসেও এভাবে কি ফিরে আসা যায়? জীবন কতটুকু? অনুভূতিগুলোও বা কতটা দূর বয়ে যায়? রাসেল কি পারবে এই প্রহরকে থামিয়ে দিতে? একটি অস্তগামী সুর্যকে নতুন একটি দিনের সূত্রপাত করতে বাঁধা দিতে? বিবর্ণ…বিষন্ন…বিরক্ত বিরহী কিছু অনুভবে বিদীর্ণ একজন রাসেল বেলা শেষের এক অবেলায় নিঃশব্দ চীৎকারে জানতে চায় ভালোবাসায় এতো কষ্ট কেন! না পাওয়ার বেদনা এতো তীব্র কেন? কেউ কি ওকে জানাবে?