দুই পাদ্রী ও এক মুসলমান

হযরত ইয়াকুব বিন খোরাসানী (রহঃ) বলেন, একবার আমি আল্লাহর উপর ভরসা করে বাড়ি থেকে বের হয়ে ভ্রমণ শুরু করলাম। অতঃপর একাকী দীর্ঘ পথ ভ্রমণ করে বাইতুল মোকাদ্দাসে পৌঁছলাম। পরে আমি তথাকার এক বিরান গর্তে প্রবেশ করে আল্লাহর ইবাদতে মশগুল হলাম। দীর্ঘ দিন যাবত আমার আহার পানি কিছুই গ্রহণ করা হয়নি। ফলে ক্রমে আমি শক্তিহীন হয়ে মৃত্যুর দিকে এগুতে লাগলাম।

এমন সময় হঠাৎ একদিন দেখতে পেলাম, দুজন পাদ্রী কোথাও যাচ্ছে। আমি নিকটে এসে তাদেরকে সালাম করে জিজ্ঞেস করলাম, তোমরা কোথায় যাচ্ছ? তারা বলল, আমাদের গন্তব্যস্থল জানা নেই। আমি পুনরায় জিজ্ঞেস করলাম, তোমরা কি একথা বলতে পার কোথায় আছ এখন? উত্তরে তারা বলল, হ্যাঁ, আমরা আল্লাহর জমিনে এবং তারই সামনে বিচরণ করছি। এ সময় আমি স্বীয় নফসকে লক্ষ্য করে মনে মনে বললাম, এ পাদ্রীরা কাফের হওয়া সত্বেও তাদের তাওয়াক্কুলের উপর স্থির থাকতে কত মজবুত। অথচ আমি মুসলমান হওয়া সত্বেও নিজের তাওয়াক্কুলের উপর স্থির থাকতে পারছি না। অতঃপর আমি তাদেরকে জিজ্ঞেস করলাম। তোমরা কি আমাকে তোমাদের সাথে থাকতে দেবে? তারা বলল, ইনশাল্লাহ তুমি আমদের সাথে থাকলেই ভাল হবে। এবার আমরা তিনজনে এক সাথে চললাম।

সারাদিন পথ চলার পর সন্ধায় আমরা এক স্থানে যাত্রাবিরতি করলাম। এ সময় তারা তাদের মা’বুদ এর ইবাদত করতে লাগল এবং আমি তাইম্মুম করে মাগরীবের নামায আদায় করতে দাড়ালাম। তারা আমাকে মাটি দ্বারা তাইম্মুম করতে দেখে মিটি মিটি হাসছিল। আমার নামায শেষ হওয়ার পর তাদের একজন হাত দ্বারা সামান্য মাটি খনন করার পর সেখানে থেকে মুক্তার মত ঝকঝকে পরিস্কার পানি বের হতে লাগল। আমি আশ্চর্য হয়ে সেই পানি দেখছিলাম। আবার সে পাদ্রীর দিকে ফিরে দেখতে পেলাম, তার পাশে এক ডিস খাবার রাখা হয়েছে। এ দৃশ্য দেখে আমার বিস্ময় আরো বৃদ্ধি পেল। আমার অবস্থা দেখে তারা বলল, এমন অবাক হয়ে কি দেখছ? এখন আর দেরি না করে খেতে বস এবং আল্লাহর প্রদত্ত্ব হালাল খাবার ও সুমিষ্ট শীতল পানি পান করে করুণাময় আল্লাহর ইবাদত কর। পরে আমরা তিনজন একত্রে বসে তৃপ্তির সাথে খাবার খেলাম। খাওয়া শেষ হলে আমি পানি দ্বারা অযু করে কাজা নামায আদায় করলাম। এ সময়ে সেই পানি ও জমিনে শুকিয়ে গেল।

আমি সারারাত নামায পড়ায় ব্যস্ত রইলাম এবং সেই দুই পাদ্রীও সকাল পর্যন্ত নামায আদায় করল। সূর্যোদয়ের পর পুনরায় আমরা তিনজন এক সাথে ছফর শুরু করলাম। সারাদিন একটানা পথ চলার পর গতকালের মতই আমরা একস্থানে যাত্রাবিরতি করলাম। এখানে আমরা যার যার ধর্ম অনুয়ায়ী নামায আদায় করলাম। নামায শেষে আমি লক্ষ্য করলাম, আজ অপর পাদ্রী গতকালের মতোই মাটি খনন করে পানি বের করল এবং তার পাশে ডিস ভরা খাবার এসে হাজির হল। পরে আমরা সবাই এক সাথে বসে খাবার খেলাম। অতঃপর ঐ পানি দ্বারা অযু করলাম।

এমনিভাবে তৃতীয় দিনে সন্ধ্যায় পাদ্রীরা আমাকে বলল, হে মোহাম্মাদী আজ তোমার পালা। তাদের কথা শুনে আমি মনে মনে শঙ্কিত হলাম। কিন্তু আল্লাহর ওপর ভরসা করে প্রকাশ্যে বললাম, ইনশাল্লাহ যথাসময়ে সব আয়োজনই সম্পন্ন হবে। অতঃপর আমি তাদের হতে একটু পৃথক হয়ে এক নিরিবিলি স্থানে গিয়ে দু’রাকাত নামায পড়ে আল্লাহর দরবারে আরজ করলাম, হে পরওয়ারদিগার আমি তোমার এক গুনাহগার বান্দা, আমার অপরাধের কোন অন্ত নেই, গুনাহের কারণে তোমার দরবারে আমার কোন মর্যাদা নেই, কিন্তু তবুও আমি তোমার রহমত হতে নিরাশ হইনি। তোমার বন্ধু মুহাম্মাদ (সাঃ) এর উছিলা দিয়ে তোমার রহমতের ভাণ্ডার আরজ করছি, আমাকে ঐ পাদ্রীদের সামনে অপমান করো না।

বর্ণনাকারী বুজুর্গ বলেন, আমি মোনাজাত শেষ করার সাথে সাথেই দেখতে পেলাম, আমার সামনে দিয়ে একটি নহর প্রবাহিত হচ্ছে এবং আমার এক পাশে রকমারি খাবার স্তুপ করে রাখা হয়েছে। অতঃপর আমি তাদেরকে খাবার গ্রহণ করতে আহবান করলাম। আহার শেষে আমরা সবাই আল্লাহ পাকের শুকর আদায় করলাম, অতঃপর ধারাবাহিক দ্বিতীয় বার আমার পালা আসলে আমি আগেই মতই আল্লাহ পাকের দরবারে দোয়া করলাম এবং যথাযময়ে কুদরতী ব্যবস্থাপনায় পানি ও খাবারের এন্তেজাম হল। এমনিভাবে তৃতীয় বার আমার পালা এলে এবারও আমি আগের মতোই দোয়া করলাম। কিন্তু আজ আমার দোয়ার পর মাত্র দু’জনের পরিমাণ খাবার ও পানির ব্যবস্থা হল। এ দৃশ্য দেখে আমার মন ভেঙ্গে গেল। আমি যেন লজ্জায় তাদের চেহারার দিকে তাকাতে পারলাম না।

বর্ণনাকারী বুজুর্গ বলেন, আমার এ সংক্ষিপ্ত বক্তব্য শুনে তারা উভয়ে বলে উঠল, হে মুহাম্মাদী! তুমি সত্য বলেছ? নিশ্চয় তিনি আমাদের রব এবং ইসলাম তাঁর মনোনীত ধর্ম। তুমি হাত প্রসারিত কর, আমরা তোমার হাতে ইসলাম গ্রহণ করছি। আমি হাত বাড়িয়ে দিলে, তারা আমার হাত স্পর্শ করে বলে উঠল-

اشهد ان لا اله الا الله واشهد ان محمد رسول الله

কালেমা শাহাদাত পাঠ করে তারা আরো বলল, ইসলামই একমাত্র সত্য ধর্ম এবং এ ব্যতিত অপর সকল ধর্মই ভ্রান্ত। আমি তাদেরকে বললাম- চল আমরা কোন শহরে গিয়ে জুম্মার জামায়াতে শরীক হই। কেননা জুম্মা হল বিত্তহীনদের জন্য হজ্জ স্বরূপ। তারা আমার প্রস্তাবে সম্মত হলে আমরা রাতেই কোন লোকালয়ের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম।

রাত গভীর অন্ধকার! পথ ঘাট কিছুই দেখা যাচ্ছিলা না। কিন্তু সামান্য পথ অতিক্রমের পরই আমরা একটি বিরাট প্রাসাদ দেখতে পেলাম। ভাল করে লক্ষ্য করার পর বুঝতে পারলাম যে, আমরা বাইতুল মোকাদ্দাসে চলে এসেছি। আমরা মসজিদের ভেতর প্রবেশ করলাম এবং আল্লাহ তায়ালার শুকরিয়া আদায় করলাম।

বর্ণনাকারী বলেন, বাইতুল মোকাদ্দাসে পৌছার পর আমরা সেখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করলাম। সেখানে আমরা আল্লাহ পাকের পক্ষ হতেই নিয়মিত রিযিক প্রাপ্ত হতাম। এমন সব স্থান হতে আমাদের রিযিকের ব্যবস্থা হত যা আমরা কল্পনাও করতে পারতাম না। দীর্ঘদিন সেখানে বসবাসের পর আমার দু সাথী সেখানেই ইন্তেকাল করলেন।

You may also like...

দুঃখিত, কপি করবেন না।