দক্ষিণী ভাল্লুক

মফস্বলে বাস করি বলে একসময় ঢাকার খবর আমাদের খুব টানতো। কিন্তু দিনের পর দিন, মাসের পর মাস একই ঘটনা ঢাকা শহরে বারবার ঘটায় আমরা ঢাকা শহরের বিষয়ে আজকাল উত্সাহ হারিয়ে ফেলেছি। আমাদের নজর এখন বহির্বিশ্বের দিকে। হত্যা-গুম, সন্ত্রাস আর নিত্য-নতুন উদ্ঘাটিত ষড়যন্ত্রের চেয়ে নরেন্দ্র মোদির নির্বাচনে বিজয়ের দশটি কারণ বা বারাক ওবামার স্বাস্থ্যনীতি জানা আমাদের কাছে আজকাল অধিক আকাঙ্ক্ষিত। প্রতিদিনকার মতো সেদিনও আমরা যখন কম্বোডিয়া ও চীনের মধ্যে তৈল-ক্ষেত্রের সীমানা নিয়ে চলমান বিরোধ বিষয়ক সংবাদ পাঠে ব্যস্ত ছিলাম—তখনই কি করে যেন ‘মফস্বল পাতা’য় আমাদের চোখ চলে যায়! একটা ছোট্ট শিরোনাম আমাদের দৃষ্টি কাড়ে। ‘যৌবন ফুরিয়ে যাচ্ছে; তবু সঙ্গীর দেখা নাই’।
খবরের শিরোনামে যৌবন এবং নিঃসঙ্গতার যুগপৎ উপস্থিতি আমাদের মানোজগতে ঢেউ তুলতে সক্ষম হয়। আমরা কেন যেন চীন-কম্বোডিয়ার খবর পাঠে উত্সাহ হারিয়ে ফেলি। কম্বোডিয়ায় বসবাসরত চীনের নাগরিকদের দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য প্রেরিত জাহাজটিকে মাঝ সমুদ্রে রেখে আমরা যৌবন এবং নিঃসঙ্গতার গল্প জানতে মফস্বল পাতায় ফিরে যেতে বাধ্য হই। এবং খবরের ভেতরে প্রবেশের আগে বিস্ময়ের সাথে লক্ষ করি, সংবাদের প্রতিবেদক আমাদের মফস্বল শহরেরই এক সাংবাদিক। যেকোনো বিষয়ে জানার আগে আমরা যোগ্যতা অনুযায়ী সে বিষয়ে একটি আগাম ধারণা নিয়ে থাকি। এক্ষেত্রে আমরা ধারণা করি যে, প্রতি পাড়া-মহল্লায়ই এমন এক-দুজন মধ্যবয়স্ক অবিবাহিত লোক থাকে যাদের যৌবন ফুরিয়ে যায়, কিন্তু তারা সঙ্গীর দেখা পান না। কখনো ছোট ভাই-বোন মানুষ করতে গিয়ে, কখনো বা প্রেমিকার কাছ থেকে দুঃখ পেয়ে আবার কখনো বা নিজের উপযুক্ত পাত্রী না পেয়ে তারা একাকী জীবন কাটিয়ে দেন। আমাদের মফস্বল শহরটিতেও এমন লোকের সংখ্যা নিতান্ত কম নয়। কিন্তু ব্যক্তি বিশেষের একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়াদি একটি বহুল প্রচারিত জাতীয় দৈনিকে আলোচনার যোগ্য হতে পারে না। ফলে আমাদের মধ্যে খানিকটা দ্বিধা কাজ করে। পাঠকের মনে দ্বিধা তৈরি করে সংবাদের ভেতর পাঠককে প্রবেশ করানো যদি সাংবাদিকতার উদ্দেশ্য হয়ে থাকে—তবে এক্ষেত্রে পত্রিকাটি সফল হয়েছে বলে আমরা মনে করি। অন্য সব মফস্বল শহরের মতো আমাদের মফস্বল শহরটিরও সংবাদ সৃষ্টির ক্ষমতা নগণ্য। ফেনী বা লক্ষ্মীপুরের চেয়ে বড় শহর হয়েও আমরা তেমনভাবে পত্রিকায় জায়গা করে নিতে পারি না। আমাদের এখানে নদী দখল হয় না, টেন্ডারের শিডিউল কেনা নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে গোলাগুলি হয় না, হাসপাতালে রোগী মরলে ডাক্তারকে দায়ী করে চেম্বার ভাঙচুর হয় না, উকিলরা আদালত বর্জন করে না, জেহাদি পুস্তক নিয়ে মাদ্রাসার ছাত্ররা ধরা পড়ে না।
সুতরাং বছরে এক-আধবারও জাতীয় পত্রিকার প্রথম পাতা দূরে থাক মফস্বল পাতায়ও আমাদের স্থান হয় না। তাই শিরোনাম এবং স্থানীয় সাংবাদিকের নাম দেখে আমরা কৌতূহল এবং বিস্ময় নিয়ে সংবাদের ভেতরে প্রবেশ করতে সচেষ্ট হই। এবং আবিষ্কার করি আমাদের মফস্বল শহরের কোনো বিয়ে করতে ব্যর্থ বড় ভাইয়ের যৌবন এবং নিঃসঙ্গতার গল্প নিয়ে ওই সংবাদ নয়। ওই সংবাদের বিষয় আমাদের মফস্বল শহরের মিনি চিড়িয়াখানার দুই ভাল্লুক—টিটু ও মিঠু। আমাদের মফস্বল শহরটির চৌহদ্দির মধ্যে কোনো বন নেই। তবে বন বিভাগ আছে। বন বিভাগের সীমানা প্রাচীরের মধ্যে থাকা দু-একটি বৃদ্ধ শাল, সেগুন আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে—আমাদের এই শহরটিও একদিন জঙ্গলাকীর্ণ ছিল। বছর বিশেক আগে আমাদের এলাকার এক সাংসদ পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি থাকাকালীন প্রভাব খাটিয়ে বন বিভাগের পতিত জমিতে একটি চিড়িয়াখানা স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু যে উত্সাহ উদ্দীপনা নিয়ে চিড়িয়াখানাটির জন্ম হয়েছিল সরকার পরিবর্তনের পর সে উত্সাহে ভাটা পড়ে। ফলে চিড়িয়াখানাটি আর বড় চিড়িয়াখানা হয়ে উঠতে পারেনি। আমাদের মফস্বল শহরটিতে বেড়ানোর জায়গার এত অভাব যে আমরা ছোটবেলা থেকে ওই মিনি চিড়িয়াখানার নিরীহ গোছের কিছু প্রাণী এবং পাখি দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছি। তারপরেও আমাদের শহুরে আত্মীয়-স্বজনরা বেড়াতে আসলে আমরা গর্ব ভরে ওই চিড়িয়াখানার কথা বলতাম। শহুরে আত্মীয়-স্বজনরা যখন বলত, ‘তোমাদের চিড়িয়াখানায় কী কী আছে?’ তখন আমরা অজগর, বানর, বেজি এবং হরিণসহ নানাবিধ পাখির নাম উল্লেখপূর্বক তাদের মুখের দিকে নরম চোখে তাকাতাম এবং দেখতাম, তাদের মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি। এই হাসিটি দেখার সাথে সাথে আমরা ট্রাম্প কার্ড ছাড়ার মতো করে বলতাম, ‘আর আছে ভাল্লুক’। অন্যান্য প্রাণীর নাম নামতা পড়ার মতো করে বললেও ভাল্লুকের নামটি বলার সময় আমারা চোখে-মুখে বাঘ দেখার আতঙ্ক ছড়িয়ে দিতাম। তাতে কখনো কাজ হতো, কখনো হতো না। কেউ সেই মিনি চিড়িয়াখানায় যেত; কেউ যেত না। যারা যেত তাদের মুখে হতাশার দীর্ঘ ছায়া ছাড়া আর কিছু দেখিনি। পত্রিকায় খবর পাঠ করে আমরা আক্ষেপ করতে থাকি। কারণ, চিড়িয়াখানার যে ভাল্লুকরা আমাদের গর্বের ট্রাম্প কার্ড—তাদের নাম যে টিটু ও মিঠু তা আমরা পত্রিকার প্রতিবেদনের আগে জানতাম না। আমরা ইতোপূর্বে তাদের খাঁচার গায়ে বড় বড় হরফে ‘ভাল্লুক’ লেখা প্ল্যাকার্ডের নিচে ইংরেজি বাঁকা হরফে ভাল্লুকের বৈজ্ঞানিক নামও লেখা থাকতে দেখেছি। কিন্তু কোনো প্রাণীর বৈজ্ঞানিক নাম আমাদের সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত না হওয়াতে কিংবা পরবর্তী জীবনে চাকরির জন্য যে সব গাইড বই পাঠ করেছি তাতে ‘নিচের পাঁচটি প্রাণির বৈজ্ঞানিক নাম লিখ’ শীর্ষক কোনো প্রশ্ন না থাকাতে আমরা আগ্রহী হয়ে উঠিনি। যেহেতু প্রাণীর বৈজ্ঞানিক নাম বিক্রয়যোগ্য জ্ঞান নয় সেহেতু আমাদের পিতা-মাতা বা অভিভাবক শ্রেণির কেউ কখনো আমাদের বৈজ্ঞানিক নাম জানতে উপদেশও দেয়নি। বরং প্রাণীর বৈজ্ঞানিক নামের মতো অপ্রয়োজনীয় বিষয় প্ল্যাকার্ডে অর্ন্তভুক্ত করার কারণে আমরা চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষের ওপর খানিকটা বিরক্ত ছিলাম। পত্রিকার খবর পাঠ করতে করতে আমরা আরো একবার চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষকে গালি দিই। কারণ বৈজ্ঞানিক নাম লিখে জায়গা নষ্ট না করে তারা ভাল্লুক দুটির ‘ডাক’ নাম লিখে রাখতে পারতো! বাড়ির পাশের চিড়িয়াখানার দুটি প্রাণীর ‘ডাক’ নাম জানতে জাতীয় পত্রিকার সাহায্য নেয়াটা আমাদের কাছে বিব্রতকর মনে হয়। তাছাড়া আমরা এতদিন মনে করতাম, যেহেতু অন্যান্য প্রাণীর মতো ভাল্লুকও জোড়বদ্ধভাবে অবস্থান করছে সেহেতু তাদের মধ্যে একটি মর্দ এবং একটি মাদি।
এবং নির্দিষ্ট সময় পর আমরা খাঁচায় নতুন ভাল্লুক শাবক দেখতে পাব! কিন্তু টিটু এবং মিঠু যে সহোদর এবং সমলিঙ্গের—এ খবর জাতীয় পত্রিকার মাধ্যমে জানার পর আমাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়—কেন এতদিনেও টিটু এবং মিঠু বাচ্চা উত্পাদন করতে পারেনি। যদি প্ল্যাকার্ডে ‘ভাল্লুক’-এর নিচে পণ্ডিতি করে বৈজ্ঞানিক নাম উল্লেখ না করে টিটু এবং মিঠু লেখা থাকত—তবে ভাল্লুকদ্বয় যে সমলিঙ্গের তা আমরা নাম দেখেই বুঝে নিতে পারতাম। তাছাড়া গত পনের বছরে আমাদের শহরে অজ্ঞতার কারণে অন্তত প্রায় চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ জন বালকের নাম রাখা হয়েছে টিটু এবং মিঠু। একই শহরে ভাল্লুক এবং মানুষর একই নাম থাকাটার জন্য চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ দায় এড়াতে পারে না বলে আমরা একমত হই। আমরা আরো একমত হই যে, দেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা না করে চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষের পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণ করার প্রবণতার কারণেই এ জটিল সমস্যার উদ্ভব হয়েছে। যদিও ভাল্লুকের আয়ু বিষয়ে আমাদের যথেষ্ট জ্ঞান নেই তথাপি পত্রিকা মারফত মিঠু-টিটুর বয়স পনের এবং এই এ বয়সটি ভাল্লুকের সঙ্গমের জন্য আদর্শ সময়—তা জানতে পেরে আমরা আরো বিচলিত হয়ে পড়ি। আমরা জানি, আমাদের কাছে খবর তখনই খবর যখন মহানগরের লোকেরা তাকে খবর বলে স্বীকৃতি দেয়। মূলত আমরা আজকাল যারা মফস্বলে শহরে পরে আছি—তারা নিজেদের চিন্তা-চেতনা, দায়িত্ব-কর্তব্য নির্ধারণের ক্ষমতাটি আশির দশকেই ঢাকাবাসীর কাছে বন্ধক দিয়েছি। আন্দোলন, হত্যা-রহস্য, ঐতিহাসিক ঘটনার সত্য-মিথ্যা—এমনি সবকিছু নির্ধারণের জন্য আমরা ঢাকার নাগরিকদের মতামতের দিকে চাতক পাখির মতো চেয়ে থাকি। সুতরাং আমাদের চিড়িয়াখানার ভাল্লুক নিয়ে ঢাকার একটি পত্রিকা যখন সংবাদ পরিবেশন করে তখন তা নিয়ে আমরা চিন্তামগ্ন না হয়ে পারি না। আমরা বিকেল নাগাদ দল বেঁধে স্যামসাঙ্গা, নকিয়ান, সিম্পানী ইত্যাদি ব্র্যান্ডের চাইনিজ স্মার্টফোন নিয়ে সেই মিনি চিড়িয়াখানায় হাজির হই এবং ভাল্লুকের খাঁচার সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলে ফেসবুকে আপলোড করার মতো একটা জুতসই অ্যাঙ্গেল খুঁজতে থাকি। আমদের সবারই ইচ্ছে এমন একটা ছবি তোলার—যার সামনে হাসি মুখে আমরা দাঁড়িয়ে থাকব আর পেছনে খাঁচার গ্রিল ধরে বিমর্ষ মুখে দাঁড়িয়ে থাকবে কমপক্ষে একটি যুবক ভাল্লুক। ছবির ওপরে স্ট্যাটাস দেওয়া থাকবে—‘আজ বিকেলে সেই দুঃখিনী ভাল্লুকদের সাথে আমি’। কিন্তু আমাদের এই ক্রিয়াকর্ম যাদেরকে ঘিরে সেই মিঠু আর টিটুর এ বিষয় নিয়ে কোনো চিন্তা আছে বলে মনে হয় না। তারা আপন মনে মাটিতে গড়াগড়ি খায়। কখনো কাত হয়; কখনো চিত হয়। আমরা যে এতগুলো মানুষ ফেসবুকে ছবি আপলোড করতে খাঁচার চারপাশে জমা হয়েছি—তা নিয়ে তাদের কোনোরূপ আগ্রহ দেখি না। এতে আমাদের মধ্যে দুপুর নাগাদ ভাল্লুকদের জন্য যে মায়া-মহব্বত তৈরি হয়েছিল তাতে খানিকটা ভাটা পড়ে। কারণ আমরা স্বীকার না করলেও জানি, আমাদের চাইনিজ মোবাইল ফোনে ১০ মেগাপিক্সেল ক্যামেরার কথা লেখা থাকলেও বাস্তবে তা দুই মেগাপিক্সেলও নয়। আর যদি বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে তবে দশ মেগাপিক্সেল দিয়েও কোনো কাজ হবে না। ছবির ক্যাপশনে ‘দুঃখিনী ভাল্লুক’ উল্লেখ থাকার পর ছবিতে ভাল্লুক না থেকে শুধু যদি আমাদের ছবি থাকে তবে বন্ধু মহলে মান-সম্মান বলতে আমাদের আর কিছু অবশিষ্ট থাকবে না বলে আমরা মনে করতে থাকি। আলো থাকতে থাকতে কী করে ভাল্লুক দুটিকে খাঁচার গ্রিলের কাছে আনা যায় তা নিয়ে আমরা আলোচনা শুরু করি। কয়েকজন লম্বা বাঁশ দিয়ে ভাল্লুক দুটিকে খুঁচিয়ে খাঁচার গ্রিলের কাছে আনার পরামর্শ দিলেও আমরা তাতে সায় দিতে পারি না। কারণ খাঁচার অদূরে পত্রিকার সাংবাদিক মিল্লাদ তখন হাত নেড়ে নেড়ে সঙ্গীহীনতার কারণে যুবক ভাল্লুকের কী কী সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে তা উপস্থিত জনতার কাছে বর্ণনা করছে। ‘দেখছেন দেখছেন—কেমন উদাস হইয়া মাটিত শুইয়া রইছে? আমরা যে এতগুলান মানুষ তার আশেপাশে দাঁড়ায়া রইছি টিটু-মিঠুর কোনো ফিলিংস-ই নাই।’
যদিও আমরা ইতোপূর্বে আরো কয়েকবার চিড়িয়াখানায় বেড়ানোর সময় ভাল্লুক দুটিকে এভাবে শুয়ে থাকতে দেখেছি, কিন্তু পত্রিকার সংবাদ প্রকাশের পর সেই শুয়ে থাকা এবং এই শুয়ে থাকার মধ্যে সুনির্দিষ্টভাবে পার্থক্য নিরূপণ করতে সক্ষম হই। উপস্থিত জনতা মিল্লাদের কথায় সায় দিয়ে মাথা নাড়তে থাকে। এবং বয়স্ক ধরনের এক লোক জানায়, সে অনেকদিন রাতে চিড়িয়াখানার পাশ দিয়ে বাড়ি যাওয়ার সময় ভাল্লুকদ্বয়ের ক্রন্দন শুনতে পেয়েছে। সে এতদিন বুঝে নাই ভাল্লুকের কিসের দুঃখ! কিন্তু আজ তার কাছে পরিষ্কার ভাল্লুকেরা কেন কাঁদে? তার কথায় উপস্থিত জনতা সায় দেয়। আরো দু-একজন উপস্থিত জনতা সঙ্গীনীর অভাবে ভাল্লুকদ্বয়ের কান্না শোনার বিষয়টি নিশ্চিত করলে আমরা নিজেদের করণীয় নির্ধারণের জন্য উত্সুক হয়ে উঠি। এক জোড়া ভাল্লুকের জীবন আমাদের সামনে এইভাবে শেষ হয়ে যাবে আমরা তা মেনে নিতে পারি না। আমাদের পাড়ার বড় ভাই ইব্রাহিম খলিল উত্তেজিত হয়ে বলে ওঠেন, ‘যদি সরকার এর একটা বিহিত না করে তবে আমরা চান্দা তুইলা মাদি ভাল্লুক কিইন্না আনব; তবু টিটু-মিঠুরে এইভাবে থাকতে দিব না।’ ইব্রাহিম খলিলের এই চিত্কার উপস্থিত জনতার মধ্যে একটা আলোড়ন তোলে। উপস্থিত জনতার সবাই ‘হ হ, নিজেরাই ভাল্লুক জোগাড় করমু’ বলে স্লোগান তুলতে চায়। এহেন উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে ভাল্লুকদের পাছায় বাঁশ দিয়ে গুঁতা মেরে ফেসবুকে ছবি তোলার চেষ্টা বিপদজনক হতে পারে বিবেচনা করে আমরা মিল্লাদ এবং আপাতত নেতা ইব্রাহিম খলিলকে টেনে খাঁচার একপাশে নিয়ে যাই। তাদেরকে বলি, ‘ঢাকা শহর তো বটে সৌদি আরব, বাহরাইন এমনকি আমেরিকাতে বইসা যারা অনলাইনে টিটু আর মিঠুর খবর পড়ছে তারা চক্ষের পানি আটকায়া রাখতে পারতেছে না। তারা খালি ফুন করে আর জিগায় টিটু-মিঠু কেমুন আছে? কিন্তু আমরা জবাব দিতে পারি না।’ আমাদের এই কথায় ইব্রহিম খলিল এবং মিল্লাদের কপালে চিন্তার রেখা ফুটে ওঠে। আমরা আরেকটু সাহসী হয়ে তাদের জানাই, আমরা মফস্বলে থাকতে পারি কিন্তু ফেসবুকে আমাদের প্রায় সবার একাধিক অ্যাকাউন্ট আছে। এইসব অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে আমরা সারা পৃথিবীর সাথে যুক্ত। ফেসবুকের দেশি-বিদেশি বন্ধুদের মাধ্যমে আমরা মিঠু আর টিটুর করুণ কাহিনি সারা পৃথিবীর কাছে ছড়িয়ে দিতে চাই। আমাদের এই প্রস্তাবে ইব্রাহিম খলিল এবং মিল্লাদ—যিনি সংবাদ প্রকাশের মাধ্যমে টিটু এবং মিঠুর স্থানীয় অভিভাবক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছে—তাদের চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। এই সময়ে আমাদের আরো এক বন্ধু জানায়, এই শহরে সিএনএন আর আল-জাজিরা’র আসা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। আর তারা যদি আসেই তবে সাক্ষাত্কার দেয়ার মতো উপযুক্ত লোক মিল্লাদ কিংবা ইব্রাহিম খলিল ছাড়া আর কেউ নাই। এ কথা শোনার পর ইব্রাহিম খলিল এবং মিল্লাদের মধ্যে আমরা সুস্পষ্ট পরিবর্তন লক্ষ করি। তারা ব্যস্ত হয়ে ওঠে এবং অল্প সময়ের মধ্যে কোথা থকে যেন এক জোড়া মুলিবাঁশ সংগ্রহ করে ফেলে। এবং খাঁচার কাছাকাছি যেয়ে বাঁশ দিয়ে ভাল্লুকদ্বয়ের পাছায় গুঁতা মারতে থাকে। এসময়ে এক বৃদ্ধ লোককে ছুটে আসতে দেখা যায়। ‘হায় হায়, কী করেন? কী করেন?’ বলতে বলতে সে সাংবাদিক মিল্লাদের বাঁশটি টেনে ধরলে উপস্থিত জনতা একটু কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যায়। আমাদের আপাত নেতা ইব্রাহিম খলিল তার হাতের বাঁশ ফেলে সেই বৃদ্ধের দিকে তেড়ে গিয়ে জানতে চায়, ‘আপনে কেডা?’। বৃদ্ধ তখন তারুণ্যের সামনে নতজানু। সে দুই হাত করজোড়ে জানায়, ‘আমি টিটু-মিঠুর দেখভাল করি।’ সাথে সাথে আশেপাশের জনতার মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। এতক্ষণ বনবিভাগের কোনো কর্মচারী-কর্মকর্তাকে না পেয়ে তারা ভেতরে বিরাজমান আগ্নেয়গিরির লাভা উদ্গীরণ করতে পারেনি। অভিজ্ঞতা থেকে তারা জানে যে, সরকারি লোকেরা যখন সমস্যার সমাধান করতে পারে না তখন দ্রুত লুকিয়ে পড়ে। লুকিয়ে পড়ায় যে যত দক্ষ সে নাকি তত ওপরের পদে আসীন হয়। এহেন পরিস্থিতিতে একজন সরকারি লোক হাতের নাগালে পাওয়ার পর তারা আর নিজেদের ক্রোধ সংবরণ করতে পারে না। সাংবাদিক মিল্লাদ কিছু একটা বলতে গিয়েও জনতার ক্রোধের সামনে কথা বলার সুযোগ হারায়। ইব্রাহিম খলিল তখন কর্মচারীরর শার্টের কলার ধরে জানতে চায়, ‘ওই মিয়া, তুমি কী দেখভাল করো? আইজকা পনের বচ্ছর বয়স হইলো টিটু-মিঠু একলা আছে সেইটা কি তোমার দেখভালের মধ্যে পড়ে না।’ সাথে সাথে উত্তেজিত জনতা বলে, ‘বাল দেহে, ভাল্লুকের খাওন মাইরা খাওন ছাড়া এগো আর কোনো কাম আছে?’ তবে জনতা আবিষ্কার করে যে, কেয়ারটেকার লোকটি প্রায় বৃদ্ধ এবং তার শরীরে যদি ভাল্লুকের খাবার যেয়েও থাকে তবে তাতে তার তেমন কোনো উপকার হয়নি। তাছাড়া সে একেবারে নিম্নপদের কর্মচারী। এ ধরনের লোক মেরে জনগণ আজকাল আর তেমন আনন্দও পায় না। জনগণ ভালোবাসে উঁচু পদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের গায়ে হাত তুলতে। যে যত উঁচুপদের কর্মকর্তা-কর্মচারীর গায়ে হাত তুলতে পারে, আঞ্চলিক রাজনীতিতে তার উত্থানও ততই বাড়ে। যেহেতু শার্টের কলার ধরা হয়েছে এবং একটি বোতাম ইতোমধ্যে হাতে চলে এসেছে এরপর আরো বেশি কিছু করার মতো যুক্তি খুঁজে পায় না ইব্রাহিম খলিল। কর্মচারীটিকে ছেড়ে দেবে, না-কি দু-এক ঘা দিবে—এমন আলোচনার সময় আমরা হঠাৎ আবিষ্কার করি, ভাল্লুক দুটি খাঁচার গ্রিলের কাছে চলে এসেছে এবং কোনো এক অজানা কারণে খাঁচার গ্রিল ভাঙার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এ দৃশ্য দেখে আমরা হঠাৎ তত্পর হয়ে উঠি। যেমন ছবি চাচ্ছিলাম তেমন একটি দৃশ্য সূর্য ডোবার আগে আগে উপস্থিত হবে তা কল্পনাও করিনি। সাথে সাথে আমরা মোবাইল তাক্ করে ভাল্লুকের খাঁচার একপাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে থাকি। কিন্তু ভাল্লুক তো আর ফেসবুক বুঝে না। দু-চারটা ছবি তোলার কাজ সম্পন্ন হবার আগেই তারা পূর্বের জায়গায় ফেরত চলে যায়। এতে উপস্থিত জনতার মধ্যে যারা এখনো ছবি তুলতে পারেনি তারা আবার উত্তেজিত হয়ে ওঠে। উপস্থিত জনতার মধ্যে দুজন আবার বাঁশ নিয়ে ভাল্লুকের পাছায় গুঁতা দিতে থাকে। এবার ভাল্লুকদ্বয় বিরক্ত হয় কিন্তু কোনো রকমের অভিব্যক্তি প্রকাশ না করে খাঁচার অন্যপাশে চলে যায়। সূর্য তখন অনেকটাই পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে। সুতরাং পাছে আবার পরিষ্কার ছবি না পাওয়া যায়—এ চিন্তায় দুই তরুণ দুটি বাঁশ নিয়ে খাঁচার দুই প্রান্তে চলে যায়। এবং এমনভাবে ভাল্লুকের শরীর খোঁচাতে থাকে যেন তারা খাঁচার অন্ধকার অংশ ছেড়ে আলোকময় অংশে চলে আসে। কিন্তু ভাল্লুকেরা এবার কেন যেন হিংস্র হয়ে ওঠে। তারাও বাঁশগুলোকে আক্রমণ করতে উদ্যত হয়। মুখ ফাঁক করে ভয়ঙ্কর সব শব্দ করতে থাকে। তাদের এই প্রতিবাদে বাঁশ দিয়ে গুঁতাগুঁতি করতে থাকা লোকজন একটু সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে। সার্বিক পরিস্থিতিতে আমরা বিষাদগ্রস্ত হয়ে পড়ি। আমরা বুঝি, আজ আর নিজের ছবিসহ দুঃখিনী ভাল্লুকের ছবি ফেসবুকে আপলোড করা হবে না। মনে বিপুল কষ্ট নিয়ে আমাদের মধ্যে যারা ইতোমধ্যে ছবি তুলে ফেলেছে তাদেরকে ছবি ট্যাগ করতে বলি। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের বন্ধু আফজালের মোবাইলে তোলা ঝাপসা একটা ছবি আমাদের অনেকের মোবাইলে চলে আসে। আমরা আবার এই ছবি আমাদের দেশে-বিদেশে থাকা বন্ধুদের ট্যাগ করতে থাকি। ছবি ট্যাগ করে বাড়ি ফিরতে ফিরতে আমাদের আরেক বন্ধু জিহাদ আবিষ্কার করে যে, তড়িঘড়ি করতে যেয়ে আমরা ইতোমধ্যে দুটি ছোট্ট ভুল করে ফেলেছি। প্রথমটি হচ্ছে যেহেতু ভাল্লুকদ্বয় পুরুষ সেহেতু তাদের সাথে দুঃখিনী যায় না। হবে দুঃখী ভাল্লুক। দ্বিতীয় ভুলটি হলো—ইংরেজিতে ‘দুঃখিনী ভাল্লুক’ লিখতে গিয়ে ইংরেজি ‘ডি’-এর পর ‘ইউ’ না দিয়ে ‘ও’ লিখে ফেলেছি। সুতরাং আমাদের ভাল্লুকের নাম হয়ে গেছে ‘দক্ষিণী ভাল্লুক’। আমাদের চাইনিজ মোবাইলে ফেসবুক স্ট্যাটাসের এডিট অপশন যথাযথভাবে কাজ না করায় এবং ভুলগুলোকে ‘মেজর’ ভুল মনে না হওয়াতে আমরা এডিট করার ঝামেলায় না গিয়ে লাইক গুনায় ব্যস্ত হয়ে পড়ি। রাতের বেলা আমরা ফেসবুকে বিভিন্ন ফেক আইডি’র অ্যাকাউন্টে ঘোরাফেরার সময় আবিষ্কার করি, আমাদের সৌদি আরব প্রবাসী এক বন্ধু সেই ট্যাগ করা ছবি ডাউনলোড করে আবার তা আপলোড করেছে এবং স্ট্যাটাসে পরিষ্কার বাংলায় লিখেছে—‘দুষ্প্রাপ্য দক্ষিণী ভাল্লুক এখন আমাদের পাড়ার চিড়িয়াখানায়’। তার সেই স্ট্যাটাস আবার আরো সত্তুর জন লোক শেয়ার করে ফেলেছে। ফলে চব্বিশ ঘণ্টা পার না হতেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সূত্রে আমরা অবগত হই যে, আমাদের চিড়িয়াখানার টিটু ও মিঠু আসলে বিরল প্রজাতির ‘দক্ষিণী ভাল্লুক’। এ বিষয়টি এতই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে, আমরা যারা দুঃখিনী ভাল্লুককে দক্ষিণী ভাল্লুক বানিয়েছিলাম তারাও বিশ্বাস করতে শুরু করি যে এটি একটি বিরল প্রজাতির দক্ষিণী ভাল্লুক। ফেসবুকের সুবাদে আমরা আরো জানতে পারি যে, এ ধরনের ভাল্লুক এশিয়ান ভাল্লুকদের চেয়ে আলাদা। এ প্রজাতির পুরুষ ভাল্লুকদের উপযুক্ত নারী ভাল্লুক বাংলাদেশ তো দূরে থাক—সমগ্র পৃথিবীতেই বিরল। পৃথিবী থেকেই এরা আরো এক হাজার বছর আগে হারিয়ে গেছে বলে ধারণা করা হয়ে থাকে। আমাদের মফস্বলের সাংবাদিকরা এখন আর সাধারণ রিপোর্টিং করে না। শহরের সাংবাদিকদের মতো তারাও অনুসন্ধানী রিপোর্টিং করে থাকে। যেহেতু আমাদের শহরে বিশ্ববিদ্যালয় নেই সেহেতু আমাদের স্থানীয় সাংবাদিকরা বিষয়টি নিশ্চিত করতে প্রথমে সরকারি কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিষয়ের শিক্ষকদের বাসায় যায়। কিন্তু সরকারি কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের তিনটি পদের দুটি পদ শূন্য থাকায় এবং একজন কর্মরত শিক্ষককে মাসের প্রথম সপ্তাহে বেতন উত্তোলনের সময় ছাড়া অন্য সময় পাওয়ার সম্ভাবনা না থাকায় তারা মর্মাহত হয়ে ফিরে আসে। এমতাস্থায় নকল করে পাশ করার এবং ম্যানেজিং কমিটিকে ঘুষ দিয়ে চাকরিতে ঢোকার অভিযোগ থাকার পরও বেসরকারি হোসেন আলী ডিগ্রী কলেজের প্রাণিবিদ্যার শিক্ষক আহসান কবির-এর মতামত নেয়া ছাড়া তাদের আর কোনো উপায় থাকে না। আহসান কবির প্রচারবিমুখ মানুষ। এতই প্রচারবিমুখ যে তিনি পারলে কলেজেও ক্লাস নেন না। সাংবাদিকদের ফোনের পর ফোন পেয়ে বিরক্ত হয়ে শেষ পর্যন্ত গুগলে ‘সাউথ বিয়ার’ সার্চ দিয়ে যেসব সাজেশন পান তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—হট সাউথ ইন্ডিয়ান আন্টি, রজনীকান্ত—দ্যা সাউথ ইন্ডিয়ান হিরো, আইডেল ব্রেন ডট কম ইত্যাদি নানা পেইজ। ওইসব পেজে ঢোকার পর তার মাথা নষ্ট হয়ে যায়। সাংবাদিকরা টিভি ক্যামেরা নিয়ে বাসায় আসতে পারে জেনেও তিনি ওইসব পেইজ থেকে বের হয়ে এসে ‘দক্ষিণী ভাল্লুক’ খোঁজার সময় করে উঠতে পারেন না। দেশের এত কাছে এতবড় যৌন বিনোদনের খনি থাকার বিষয়টি কী করে তার দৃষ্টি এড়িয়ে গেল—তা ভাবতে ভাবতে তিনি দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন, কিন্তু কম্পিউটার ছাড়েন না। তবে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা নাগাদ মফস্বলের সাংবাদিকদের রিপোর্ট পাঠানোর বিষয়ে বাধ্যবাধকতা থাকায় সাংবাদিকরা দক্ষিণী ভাল্লুকের বিষয়ে জানতে তাকে বারবার ফোন করতেই থাকে। উপর্যুপরি চাপের মুখে ইন্টারনেটে চোখ বুলাতে বুলাতে তিনি মোবাইলে মতামত দেন যে, ‘হ্যাঁ, এটি একটি বিরল প্রজাতির ভাল্লুকই বটে এবং খ্রিস্টের জন্মের এক হাজার বছর আগে এই ভাল্লুক হারিয়ে গিয়েছিল বলে ধারণা করা হয়ে থাকে।’
তখন একজন সাংবাদিক জানতে চান, ‘এদের দক্ষিণী ভাল্লুক বলা হচ্ছে কেন?’ এবার আহসান কবির একটু বিব্রত হন। কী বলবেন বুঝে উঠতে পারেন না। একবার ভাবেন বলবেন, এরা সাউথ ইন্ডিয়া থেকে এসেছিল তাই দক্ষিণী ভাল্লুক। সাউথ ইন্ডিয়ান কিছু কিছু নায়কদের সাথে তিনি ভাল্লুকের চেহারার বেশ মিলও আবিষ্কার করতে সমর্থ হয়েছেন। কিন্তু বানরকে মানুষের পূর্বপুরুষ বলে চালিয়ে দেওয়া যায়; ভাল্লুককে নয়। হয়তো বিজ্ঞান একদিন এমন জায়গায় পৌঁছাবে যে, মানুষ প্রমাণ করে দেবে, ভাল্লুকই মানুষের পূর্বপুরুষ; বানর নয়। কিন্তু সেই দিনটি এখনো বহুদূর। আবার পরক্ষণেই তার মনে পড়ে, তিনি কিঞ্চিৎ আগেই বলেছেন, এরা খ্রিস্টের জন্মের এক হাজার বছর আগে হারিয়ে গেছে। খ্রিস্টের জন্মের এক হাজার বছর আগে ইন্ডিয়ারই জন্ম হয়নি সাউথ ইন্ডিয়া তো আরো পরের কথা। সুতরাং তিনি জুতসই উত্তর খুঁজতে গিয়ে একটু দিশেহারা হন। এ সময় তার কিশোর পুত্র কম্পিউটারের সামনে চলে আসলে তিনি স্ক্রিন মিনিমাইজ করতে যেয়ে স্থূলদেহী এক নায়িকার বুকের ওপরে ক্লিক করে ফেলেন এবং নারী-পুরুষ সঙ্গমে লিপ্ত এমন এক সাইট আচমকা কস্পিউটারের স্ক্রিনে হাজির হলে তিনি কম্পিউটারের পাওয়ার অফ করে দিয়ে পুত্রের ওপর চড়াও হন। মোবাইলের লাইন না কাটায় ওইপাশের মফস্বল সাংবাদিক শুধু শোনে, ‘পড়াশোনা করবি না? সারাদিন খালি ফেউ ফেউ কইরা ঘুরবি?’ মফস্বল সাংবাদিক এ কথায় খুব ক্রোধান্বিত হয়ে ওঠে। সে এসএসসি পরীক্ষায় নকলের দায়ে বহিষ্কৃত হয়েছিল বটে। সংবাদ সংগ্রহের জন্য তাকে সারাদিন বাইরে বাইরে ঘুরতে হয়—একথাও সত্য। উত্তর না জানলে; না করে দেওয়া ভালো। কিন্তু নিজের অজ্ঞতা ঢাকতে সাংবাদিককে তুই তোকারি করে পড়াশোনার দুর্বলতার দিকে ইঙ্গিত করা এবং সারা দিন সংবাদ সংগ্রহের জন্য ঘোরাঘুরিকে কটাক্ষ করে ‘ফেউ ফেউ করে ঘোরা’ বলে অপমান করার কোনো মানে খুঁজে পায় না। সাংবাদিক সিদ্ধান্ত নেয়, সরকারি খাস জমি দখল করে সদ্য নির্মিত প্রেসক্লাবের পরবর্তী সভায় আহসান স্যারের এহেন আচরণের প্রতিবাদে হোসেন আলী ডিগ্রী কলেজের সকল খবর বয়কট করার জন্য সে একটি প্রস্তাব পেশ করবে। এদিকে আমাদের তরুণসমাজও বসে থাকে না। মিঠু আর টিটুর জন্য ফেসবুকে ফ্যান পেইজ খুলে এবং দেশ-বিদেশে থাকা প্রায় হাজারখানেক ফেসবুক ফ্রেন্ডদের কাছ থেকে ‘লাইক’ সংগ্রহ করে ফেলে। মিঠু আর টিটু বিরল প্রজাতির ‘দক্ষিণী ভাল্লুক’ জানার পর তাদের কাছে ভাল্লুকদ্বয়ের মূল্য আরো বেড়ে যায়। তারা ইব্রাহিম খলিলের নেতৃত্বে শহীদ মিনারে মিঠু ও টিটুর জন্য উপযুক্ত সঙ্গিনী সরবরাহের দাবি জানিয়ে ‘আমরণ অনশন’ শুরু করে। তাদের এই আন্দোলনের কারণে অথবা কর্তব্যবোধ থেকে জেলা প্রশাসক এবং পুলিশ সুপার এক বিকালে টিটু আর মিঠুর খাঁচার সামনে এসে হাজির হতে বাধ্য হন। জেলা প্রশাসকের আর্দালি মিঠু আর টিটুর জন্য প্রশাসনের ত্রাণ তহবিল থেকে বরাদ্দ দশ কেজি মধু এবং বিশ কেজি গরুর মাংস সরবরাহ করলে আমরণ অনশনে থাকা দলটি আনন্দে তালি দেয় এবং এই মধু এবং মাংস তাদের আন্দোলনের ফসল বিবেচনা করে অনশন চালিয়ে যাবার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করতে থাকে। জেলা প্রশাসকের ধারণা ছিল মধু এবং মাংস সরবরাহ করার পর আন্দোলন স্তিমিত হয়ে যাবে, কিন্তু বাস্তবে ঘটে উল্টো ঘটনা। উপায় না দেখে তিনি পরদিন শহীদ মিনারে উপস্থিত হয়ে তাদের আন্দোলনের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেন এবং অতি শীঘ্রই দক্ষিণী ভাল্লুকদের জন্য সঙ্গী খুঁজে বের করা হবে বলে আশ্বস্ত করেন। তার এই আশ্বাসে গরম পানিতে গুলানো ট্যাংয়ের শরবত খেতে খেতে আন্দোলনকারীরা শহীদ মিনার ত্যাগ করে বাড়ির দিকে রওয়ানা দেয় বটে, কিন্তু এ পর্যায়ে আন্দোলনকারীদের মধ্যে সুস্পষ্ট একটি বিভাজন দেখা যায়। মিঠু এবং টিটুর ফ্যান পেইজের অ্যাডমিন শরবত খাওয়া দলের সদস্য হওয়ায় বিরোধী দলটি ফেসবুকে নতুন একটি পেইজ খুলতে বাধ্য হয়। সে পেইজের নাম হয়, ‘সেইভ সাউথ বিয়ার’। এই পেইজেও লাইক দেওয়ার ক্ষেত্রে জনগণের মধ্যে বিপুল আগ্রহ লক্ষ করা যায়। আমরা আবিষ্কার করি, জনগণ লাইক দিতে বেশ লাইক করে। যেহেতু লাইক দিতে পয়সা লাগে না সেহেতু বেশিরভাগ লোক উভয় পেইজে লাইক দিয়ে আন্দোলনকারীদের বিভ্রান্ত করে ফেলে। কে যে কোন দলে তা পরিষ্কার বোঝা যায় না। আমরা জানতে পারি, এই বিভ্রান্তি এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে, ‘মিঠু অ্যান্ড টিটু ফ্যান পেইজ’ এবং ‘সেইভ সাউথ বিয়ার’ উভয় পেইজের দল ভেঙে আরো সাতটি বিভিন্ন নামের পেইজ খোলা হয়েছে। এবং এই সকল পেইজের ভক্তদের মতবাদের মধ্যে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ ভিন্নতা থাকলেও পাবলিক তা নিরূপণে সময় ব্যয় না করে সমানে সকল পেইজে লাইক দিয়ে চলমান দ্বন্দ্বে বাতাস দিতে থাকে। পরিস্থিতি এমন জটিল আকার ধারণ করে যে, আমরা একসময় মিঠু আর টিটুর কথাই ভুলে যেতে বসি। এবং ফেসবুক কেন্দ্রিক দলাদলিটি মামলা-হামলার পর্যায়ে উপনীত হবার সম্ভাবনা দেখা দেয়। কিন্তু তখনই আচমকা একদিন খবর আসে মিঠু এবং টিটুর জন্য লাউয়াছড়া রিজার্ভ ফরেস্ট থেকে একটি মাদি ভাল্লুক সংগ্রহ করা হয়েছে। লোকজন যদিও অবগত হয় যে, নতুন আনা মাদি ভাল্লুকটি ‘দক্ষিণী ভাল্লুক’ নয় তারপরেও ‘কাজ চলবে’ বলে স্থানীয় সাংবাদিকরা আমাদের আশ্বস্ত করলে পাবলিক ফেসবুক থেকে আবার চিড়িয়াখানা অভিমুখী হয়। আমাদের এই গমনে পরিবারের শিশু-কিশোর এবং স্ত্রীরাও সঙ্গী হতে চাইলে আমরা উত্তেজিত হয়ে পড়ি। আমাদের উত্তেজিত হতে দেখে স্ত্রীরা একটু হতোদ্যম হলেও তারা বাচ্চাদের নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয় এবং ক্রন্দনরত শিশুদের উঁচু করে প্রদর্শন করে আমাদের বলে, ‘বাচ্চাডা এত শখ করতাছে তারে নিয়া গেলে কী হয়?’ তখন আমরা রাগত স্বরে পনের বছর পর—দুইটি মরদ ভাল্লুক একটি মাদি ভাল্লুক পেলে কী করতে পারে তা হাতের ইশারায় তাদের জানাতে বাধ্য হই এবং তারা আঁচল দিয়ে মুখ ঢাকতে ঢাকতে বাচ্চা নিয়ে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করলে আমরা চিড়িয়াখানার দিকে রওয়ানা দিই। আমরা আবারো ফেসবুকে আপলোডের উদ্দেশ্যে চাইনিজ স্মার্ট ফোন— স্যামসাঙ্গা, নকিয়ান এবং সিম্পানী নিয়ে খাঁচার সামনে হাজির হই এবং খাঁচার ভেতরে মাদি ভাল্লুক ঢুকানোর মাহেন্দ্রক্ষণের জন্য অপেক্ষা করি। এসময়ে আমাদের পাড়ার জামে মসজিদের ইমাম সকলকে মনে করিয়ে দেন যে, খাঁচার ভেতরে একটু পরে অনেক কিছুই হবে, কিন্তু আমরা যেন সেইসব দৃশ্য মোবাইলে রেকর্ড না করি। সবচেয়ে উত্তম হয় আমরা যদি ওই বিশেষ সময়টি অন্য খাঁচায় রক্ষিত প্রাণীদের একবার দেখে আসি। এতে আমরা যেমন পাপ থেকে দূরে থাকব তেমনি ভাল্লুকরাও চরম আনন্দ লাভ করতে সক্ষম হবে। তার এ প্রস্তাবে উপস্থিত জনতা মাথা নেড়ে এবং শব্দ করে সায় দেয়। এ সময় এক মধ্যবয়সী আমাদের জানায় যে, দক্ষিণ দিকের এক খাঁচায় অজগর আটটি ডিম দিয়েছে। আমরা চাইলে ওই বিশেষ সময়টিতে ওই অজগরের ডিমগুলোও দেখে আসতে পারি।
এ সময় দুটি সামন্তরাল লম্বা বাঁশে একটি লোহার খাঁচা ঝুলিয়ে মিঠু-টিটুর খাঁচার কাছে আনলে আমরা উত্তেজনায় হাততালি দিতে থাকি। আমাদের করতালির মধ্যেই মিঠু-টিটুর খাঁচার দরজা খুলে সেখানে মাদি ভাল্লুকের খাঁচাটির দরজা খুলে দেওয়া হয়। মাদি ভাল্লুকটি ভেতরে প্রবেশের সাথে সাথে সাংবাদিকরা ক্যামেরা নিয়ে ও আমরা মোবাইল খাড়া করে কৌমার্যের অবসান ঘটার মুহূর্তটিকে ধারণ করতে তত্পর হই। কিন্তু মাদি ভাল্লুকটি নতুন খাঁচার ভেতরে প্রবেশের পর আমরা যেমন আশা করেছিলাম তেমন কিছু ঘটে না। মিঠু আর টিটু মাদি ভাল্লুকের ওপর মিলনের আশায় ঝাঁপিয়ে পড়ে না। নতুন অতিথিও শরীর দুলিয়ে অন্য দুই ভাল্লুকের দিকে অগ্রসর হয় না। বরং মাদি ভাল্লুকটি কিছুক্ষণ পুরুষ ভাল্লুকদ্বয়কে নিরীক্ষণ করে খাঁচার ভেতরে পড়ে থাকা মাংসের টুকরো ভক্ষণে ব্যস্ত হয়ে ওঠে। মাদি ভাল্লুকের অনুপ্রবেশে মিঠু আর টিটু আপত্তি না জানালেও তাদের মাংসে নতুন ভাল্লুকের ভাগ বসানোর চেষ্টা তারা মেনে নিতে পারে না। দুই সহোদর একসাথে নতুন ভাল্লুকটিকে আচমকা আক্রমণ করে বসে। আক্রমণটি এমনই ভয়ঙ্কর হয় যে, অল্প সময়ের মধ্যে মাদি ভাল্লুকটির শরীরের জায়গায় জায়গায় রক্ত দেখা যায়। অবস্থার আরো অবনতির আশংকায় চিড়িয়াখানার কিউরেটর একটি মর্দ ভাল্লুককে দ্রুত সরিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত প্রদান করেন। তার নির্দেশনা বাস্তবায়নের জন্য তত্ক্ষণাৎ তিন-চার জন লোক অস্ত্রসহ ভাল্লুকের খাঁচায় ঢুকে এবং একটি ভাল্লুকের গলায় দড়ির ফাঁস এঁটে তাকে টেনে-হিঁচড়ে বের করে এনে মাদি ভাল্লুকটিকে বহন করা খাঁচায় প্রবেশ করায়। আমাদের মধ্যে কেউ বলে, খাঁচার বাইরে বের করা ভাল্লুকটি টিটু। আবার কেউ বলে মিঠু। আমরা দীর্ঘদিন আন্দোলন করলেও সুনির্দিষ্টভাবে কখনো বুঝতে পারিনি কে মিঠু আর কে টিটু। বস্তুত কে মিঠ;ু আর কে টিটু তা আমাদের জানার প্রয়োজনও মনে হয়নি। আজ যখন দরকার পড়ল তখন আমরা মিঠু-টিটুর দেখভালে নিয়োজিত সেই বৃদ্ধ লোকটিকে খুঁজি। কিন্তু ভিড়ের মধ্যে তাকে খুঁজে বের করা সম্ভব হয় না। মিঠু অথবা টিটু বের হয়ে যাবার পর মাদি ভাল্লুকটি রক্তাক্ত শরীর নিয়ে আবার মাংস খেতে শুরু করে। তার হাবভাব দেখে মনে হলো, তাকে মাংস খাওয়ার জন্যই শ্রীমঙ্গল থেকে এখানে আনা হয়েছে। আর খাঁচার ভেতরে থাকা মিঠু অথবা টিটু মারামারি করে ক্লান্ত হয়ে খাঁচার তুলনামূলক ছায়া-শীতল জায়গায় চলে যায়। বিপরীত লিঙ্গের প্রতি বিন্দু পরিমাণ আকর্ষণ না দেখিয়ে সে একসময় ডান দিকে কাত হয়ে শুয়ে পড়ে। যখন আমরা দেখি মিঠু অথবা টিটুর মুখের ওপরে মাছি উড়ছে কিন্তু সে তাদের তাড়ানোর চেষ্টা করছে না, তখন আমরা বুঝে নিই সে আমাদের অতৃপ্ত রেখেই ঘুমিয়ে পড়েছে। আমরাও একসময় ক্লান্ত হয়ে ভগ্ন মনে বাড়ির দিকে রওয়ানা দিতে বাধ্য হই। ফেরার পথে আমরা পরস্পর আলাপ করে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হই যে, আমাদের বোকা বানানো হয়েছে। দক্ষিণী ভাল্লুক আসলে একদমই ‘ডিফারেন্ট টাইপ’ ভাল্লুক। এরা সাধারণ ভাল্লুকের সাথে সঙ্গম করে না। —-মাসউদুল হক

নূরুল এবং তার নোট বই

অপেক্ষা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *