তিন কিশোরের কাণ্ড —স্বপন বুড়ো

তিনটি কিশোর এক সাথে পরীক্ষা দিতে বসেছিল।কিন্তু পরীক্ষার আগে ওরা পাকাপোক্ত ব্যাবস্থা করে গিয়েছিল।সুতো ঝুলিয়ে পরীক্ষার প্রশ্ন বাইরে চালান দেবে।সেখানে ভাই ব্রাদাররা হাতাহাতি প্রশ্ন-পত্রের জবাব লিখে আবার ফেরত পাঠাবে।সুতোধরে তোলা হবে দোতালার হল ঘরে সেই লিখিত জবাবগুলি।কিন্তু এমন সুন্দর পরিকল্পনা একে বারে ভেঙে গেল।যে পরিদর্শক হল ঘুরে বেরিয়েছিলেন,তিনি হঠাৎ জানালা দিয়ে দেখলেন,কতগুল ভুতরে কাগজ দেয়াল বেয়ে উপরে উঠে আসছে।একটি ছলে আবার ঐকাস্তিক আগ্রহে সেইগুলি সংগ্রহ করতে গিয়েছিল।হাতে নাতে ধরা পড়ে পরিদর্শনের কাছে।সেই ছেলের কাছে আবার বাকি দুই জনের নাম জানাগেল।

কিছু কিছু বইয়ের ছাপা কাগজও সেই সঙ্গে খুজে পাওয়া গেল-তাদের পকেটে।সুতরাং হল ঘরে বসা সম্ভব হল না তাদের।মুক্ত রাজ পথে বেরিয়ে এল তিন বন্ধু।গোবর-গণেশ-গোসাই।এই হচ্ছে তিন কিশরের চলতি নাম।বাড়িতে আর স্কুলে সবাই এই নামে ওদের ডাকে।তখন গোবর-গণেশ- গোঁসাই এর ত্রিশষ্কুর মতো অবস্থা হল।না পারলে ওরা পরীক্ষার হলে ঠাই করে নিত,আর না পারলে নিজ বাড়িতে ফিরে যেতে পারত।গোবর বলল,এ প্রান আর রাখব না।গণেশ বললে চল,আমরা রেললাইনে শুয়ে পড়ি-গোশা প্রতীবাদ জানিয়ে বললে,ওর বাবা মরতে আমার ভারি ভয়।সুতরাং মরা ওদের হল না।তিন জনে ঘুরে বেড়াতে লাগল।হঠাৎ গোবর বললে,বাড়িতে ফেরার জখন আর পথ নেই তখন চল আমরা এক জায়গায় পালিয়ে যাই-গণেশ ফুড়ন কাটল।কোথায় জাবি শুনি?পকেট তো একেবারে গড়ের মাঠ।গোশাই বললে,আমার মাথায় একটা প্ল্যান এসেছে-আর দুজন কূতুহলী হয়ে উঠল।–কি প্ল্যান রে,কি প্ল্যান?বাকুড়ার এক অজ পাড়াগাঁয়ে আমার এক দিদিমা আছে।একা থাকে বুড়ি,কতবার আমার জেতে বলেছে।বুড়ির বাগ বাগিচা,পুকুর ধানি জমি অনেক আছে।কিন্তু তাঁর তিনকুলে তার কেউ নেই।চল সেখানে গিয়ে কয়েকদিন গা ঢাকা দিয়ে আসি।গোবর বলল,কথাটা মন্দ নয়।কিন্তু সেখানে জেতে গেলে তো ট্রেনের টিকিত কাটতে হবে।গোসাই জবাব দিল আমার পকেটে কয়েক টাকা আছে,ওতেই চলে জাওয়া জাবে দিদির কাছে।তিন জন মিলে টিকিত কেটে ট্রেনে চেপে বসল।দিদিমা ওদের তিন বন্ধুকে পেয়ে মহা খুশি।বললে,ভুলেও দিদিমাকে মনে পড়ে না।তবু ভাগ্যি এসেছিল।

ওই চেয়ে দেখ আমার গাছে ফল ফুলুরী ইঁদুরে-বাঁদরে খায়।পুকুরের মাছ সাত ভুতে ধরে নিয়ে যায়।নলেন গুর আছে।মুড়ির মোয়া আছে,ক্ষীর আছে কি খাবি বল?দিদিমার কথা শুনে তিন বন্ধু মহা খুশি।দিদিমা ওদের তিনজনকে ঘরে শীতলপাটি বিছিয়ে দিলেন।পুরোনো তোষক রোদ্দুরে দিয়ে বিছিয়ে দিলেন তার উপর।বললে,নে এর উপর আরাম কর।আমার হাড়িতে মুড়ি আছেও আছে।গাছে আছে ধানি লঙ্কা।দিব্যি তেল মুড়ি মেকে দিচ্ছি।শুধু চাটাই তোদের দিতে পারবো না।তিন বন্ধু মহা আমেজ করে বোগদারের খলিফার মতো নানা স্বাধের খানা খেতে লাগল।গোশাই কোথেকে এক প্যাকেট তাশ নিয়ে এলো।দিন রাত তাশ খেলে,পাড়া বেড়িয়ে,আর পুকুরের মাছ ধরে ওদের দিন এক রকম মন্দ কাটছিল না।গোসই একদিন দিদিমার কয়লার ঘরে ঢুকে দেখলে ঘরের এক কোনে একটা পাথরের মূর্তি পড়ে আছে।নাক কান ভাঙা,একটা আঙুলেও খসে পড়েছে।নিতান্ত অযত্নে পড়ে আছে-কয়লাগুলির মধ্যে।সেই দিন গভির রাত্রে তিন বন্ধুর গোপন পরামর্ষ সভা বসল।গোঁসাই বললে,আমার মাথায় একটা চমৎকার প্ল্যান এসেছে।গোবর আৎকে উঠে বললে,আবার প্ল্যান,এই তো বেশ আছি।গোঁসাই উত্তর দিল ওরে বোকাচন্দর,চিরটা কাল দিদিমা বেঁচে থাকবে না।তাঁর ভিতর আঁখের গুছিয়ে নিতে হবে।পেটে বিদ্য নেই,তাই চাকুরী জুটবে না।হাতে টাকা নেই,তাই কোন ব্যাবসা করতে পারব না।কিন্তু বিনা মূলধনে জদি আমরা ভবিষ্যতের ব্যাবস্থা করে নিতে পারি?গোবর বলে আহা প্ল্যান্ট টা কি আগে বল।গোঁসাই তখন জিলিপির প্যাঁচ খোলে।একটা ভাঙ্গা মূর্তি পেয়েছি-দিদিমার কয়লার ঘরে।গবেশ শুধোয় তাতে কি হবে।গোসাই মুখ টিপেটিপে হাসে।বলে বুদ্ধি খরচ করলে,ওই থেকেই লক্ষ টাকা লাভ।লক্ষ টাকা লাভ?বাকি দুই বন্ধু আৎকে ওঠে।লটারি টটারীর ব্যাপার নাকি?উঁহু তাঁর চাইতে মজাদার ব্যাপার।গোঁসাই তখন প্ল্যান্ট টা খোলসা করে।–শোণ তোমাদের সব বলি।আজ রাতেই আমরা ওই ভাঙা বিষ্ণূ মূর্তিটাকে পুকুরের ধারে পুতে রেখে আসব।তাতে তোকে কে টাকা দেবে শুনি?তোমাদের বড় অধৈসর্য।আগে প্ল্যানটা শোণ-বল,বল,বল,শুনি সবটা- গোঁসাই আবার শুরি করে-রাত্রি আমি স্বপ্ন দেখবো,ওই বিষ্ণূমর্তি আমার যেন স্বপ্নে দেখেছে,তাকে উদ্ধার করতে।ওখানে একটি মন্দির নির্মান করে পূজোর ব্যাবস্থা করতে।আগেই আমরা গিয়ে কিন্তু মূর্তি তুলব না। সকলের সামনে গর্তখুঁড়ে ওই বিষ্ণূমূর্তি উদ্ধর করা হবে।

তাঁর পর দেখ না কি হয়।যেমন কথা তেমন কাজ।সকাল বেলা উঠেই গোঁসাই চেঁচামেচি শুরু করে দিলে। স্বপ্নের বিষ্ণদেহ তাকে ডাক দিয়েছে।তাকে উদ্ধর করতে হবে।সেইখানে মন্দির নির্মান করে পূজোর ব্যাবস্থা করতে হবে।দিদিমা শুনে ছুটাছুটি শুরু করে দিলেন।ঠাকুর ঘর থকে শঙ্খ বের করলেন।ধান-দুর্বোর ব্যাবস্থা করলেন।প্রদীপ জ্বালালেন।পাড়া প্রতিবেশির ডেকে নিয়ে এলেন।শুভ ক্ষন দেখে বিষ্ণূমূর্তি উদ্ধার করা হবে।তিন বন্ধু তখন সবাই কে চলে পুকুর পাড়ে।গায়ের কয়েক টি তরুণ উৎসাহী ছেলে জুতে গেল।তারা কথা থেকে কোদাল খন্তা ইত্যাদি জোগাড় করে নিয়ে এল।সেই সঙ্গে আরও ভুত লোক জুতে গেল।কিষানেরা ক্ষেতে জাচ্চিল,আর তাড়া ছুতে এলো।ঘরণীর দল কাজে যাচ্ছিল,-তারা এগিয়ে এল।মেয়েরা কলসি ভরে জল নিতে এসেছিল,তাড়া এগিয়ে এল,জখন দেখাগেক বেশ ভিড় জমেছে,ঠিক সেই সময় গোঁসাই চিৎকার করে উঠে বলে,এই তো!এই জায়গাটায় আমি স্বপ্ন দখেছি।এই খানটাই খুড়তে হবে। উৎসাহী যুবকের দল ঘনঘন কোদাল চালাতে থাকে।বেশ কিছূ বাদে একটা শব্দ হল।গোঁসাই চোখ দুটো বড় করে বলে হুশিয়ার ভাই সব।মুর্তি এবার মিলবে।তখন সকলে মিলে আরো কিছুটা মাটিসরিয়ে সেই ভাঙা বিষ্ণূমূর্তি বের করে ফেলল।চারিদিকে জয়ের ধ্বনি উঠল।সঙ্খ বাজল। খৈ ছিটিয়ে দেওয়া হল।এক দল ছেলে মুদি দোকান থেকে বাতাসা কিনেনিয়ে এসে সবাইকার মধ্যে ছিটিয়ে দিল।দিদিমা এগিয়ে এসে প্রদীপ হাতে করে বরণ করে নিলেন।মাটি ভাঙা বিষ্ণূমূর্তি তিনিও চিনতে পারলেন না।এই বিষ্ণূমূর্তি পাওয়ার খবর গ্রামে ছড়িয়ে পড়ল।ওদিকে দিদিমার ঘরে পূজোর আয়োজন চলল।অন্যদিকে সেই পুকুরের কনে বিষ্ণূমন্দির নির্মানের কাজ শুরু হয়ে গেল।দলে দলে লোক এসে প্রনামি দিতে লাগল। গায়ের মানুষ দলবদ্ধ হয়ে কাজে লেগে পড়ল।এদিকে মন্দিরের কাজ শেষ হয়ে গেল।বিভিন্ন গ্রাম থেকে দলে দলে লোক আসতে থাকে।গোঁসাই এই সুযোগ পট্টবস্ত্র পরিধান করে বিষ্ণূর সেবায়েৎ হয়ে বসল।শ্রীবিষ্ণূ তাবিজ”ওরা তিন বন্ধু রাতারাতি বের করে ফেলল।

 

এই শ্রীবিষ্ণূ তাবিজ ধারন করে সব রোগের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।পাঁচসিকে দিলেই তাবিজ পাওয়া যাবে।সামনের পুকুরে গোছল করে এই শ্রীবিষ্ণূ তাবিজ ধারণ করতে হবে। দলে দলে মানুষ ছুটে আসতে লাগল,ওই শ্রীবিষ্ণূ তাবিজ ধারণ করার জন্য।কার হাপানি রয়েছে,কে আমাশায় ভুগছে,কে বাতে পঙ্গু হয়ে পড়ে আছে,কারো নাতি হচ্ছে না। সবাই দলে দলে এসে ভিড় জমাতে শুরু করল এই ডালিম ফুলী গাঁয়ে।কলকাতার কাগজে ছাপা হওয়ার দূর দূর থেকে মানুষেরা কেই গরুর গাড়িতে কেই ঠেলা গাড়িতে,আবার অনেকে বাস,ট্রাক ভাড়া করে আসতে লাগল।এই ছোট্ট ডালিম ফুলী গাঁয়ে এত লোকের জায়গা হল না।তারা মাঠের মাঝখানে তাবু খাটিয়ে থাকতে লাগল।পুকুরে গোছল করতে করতে কাদা হয়ে গেল।তিন বন্ধু লিন্তু শ্রীবিষ্ণূ তাবিজ বিক্রি করে বহু টাকা কামাই করতে লাগল।গোঁসাই মিটি মিটি হাসতে হাসতে বলে,লাখ টাকা হতে আর কত দেরি?যে ভাবে মানুষ ছুটে আসতে লাগলো,তাতে লাক্ষ টাকা জমাতে আর বেশি দেরি হবে না।আরো মানুষ-আরও গাড়ি-আরও শ্রীবিষ্ণূ কবচ”প্রত্যাশী ভক্ত ছুটে আসতে লাগল।এই দালিম ফুলি গাঁয়ে।এত লোক কিন্তু খাবার দাবারের ব্যাবস্থা নেই।কয়েক টি হোটেল খুলে দিয়েছেন গোঁসাই।
অখাদ্য কুখাদ্য খেয়ে কলেরা শুরু হয়ে গেল।পোকার মতো মানুষ মরতে লাগল।তবুও কারো ভ্রুক্ষেপ নেই।কাদা জলে গোছল।আর শ্রীবিষ্ণূ কবচ ধারণ করতে লাগল।এতদিনে পুলিশের টনক নড়ল।খবর পৌছল ওপরের কর্তাদের কাছে।গ্রামকে গ্রাম উজাড় হয়ে যাচ্ছে।তবুও শ্যামাপোকার মতো লোকেরা মন্দিরে আসতে লাগল।অবশেষে এক দিন পুলিশ জিপে করে এসে হাজির হল।তারা খুজে পেতেই তিন বন্ধুকে গ্রেপ্তার করে সদরে চালান দিলে।তখনো রোগাক্রান্ত কোকেরা কাদাজলে লুটোপুঁটি খেয়ে শুধু হায় হায় করতে লাগল।

আরো পড়তে পারেন...

‘কি মুসকিল, তোরা কি আমাকে পাগল করে দিবি’|

দেওয়ালে অথবা পোস্টারে, সাইনবোর্ডে কিংবা হোর্ডিংয়ে বিচিত্র বিপর্যয় আকছার চোখে পড়ে। তার কোনওটা, যে লিখেছে,…

জীবনের অঙ্ক ও কোকাকোলার গাড়ি

“মানুষের জীবন অঙ্কনির্ভর। জীবনের অঙ্ক ভুল হওয়া মানেই কর্মক্ষেত্রে বিপর্যটা ঘটা। যার জীবনের অঙ্ক যতো…

শিয়াল পণ্ডিত–উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী

কুমির দেখলে, সে শিয়ালের সঙ্গে কিছুতেই পেরে উঠছে না। তখন ভাবলে, ‘ ও ঢের লেখাপড়া…