ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ছিলেন প্রাচ্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মনীষী, শিক্ষাবিদ, ভাষাবিদ, লেখক, গবেষক ও সমাজ সংস্কারক। পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষা ও ভাষাতত্ত্ব নিয়ে তাঁর গবেষণা আজো অতুলনীয়। তিনি ২৪টি ভাষা আয়ত্ত করেছিলেন, এগুলোর মধ্যে ১৮টি ভাষার ওপর তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্য ছিলো। বিশেষ করে হিন্দুদের ধর্মীয় ভাষা সংস্কৃতের ওপর তাঁর পান্ডিত্য ছিল অসাধারণ। ভারতীয় উপমহাদেশে তিনিই প্রথম বাংলা ভাষায় ইরানের বিশিষ্ট কবি হাফিজ ও ওমর খৈয়ামের বই অনুবাদ করেন। একনিষ্ঠ ধার্মিক হিসেবে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ কুরআন হাদিসের অনুবাদ যেমন করেছিলেন, তেমনি ধর্মপ্রচারেও সক্রিয় ছিলেন। জ্ঞান-সাধনার উচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন বলেই শিক্ষিত সমাজে তাঁকে “চলমান বিশ্বকোষ” হিসেবে সম্মান করা হতো।
১৩ জুলাই ছিল ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর ৪১তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৬৯ সালের এই দিনে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ৮৪ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হল প্রাঙ্গণে তাঁকে কবর দেয়া হয়। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগণা জেলার বশিরহাট মহকুমার পেয়ারা গ্রামে ১৮৮৫ সালের ১০ জুলাই জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলায় তিনি বেশ আমুদে ছিলেন বলে সবাই তাকে ‘সদানন্দ’ নামে ডাকতেন। ৪ বছর বয়সে গ্রামের মক্তবে তাঁর হাতেখড়ি হয়। তাঁদের পরিবার ছিল আরবী, ফার্সি ও উর্দুতে শিক্ষিত পরিবার। শহীদুল্লাহর বাবা ৫টি ভাষা জানতেন।
১০ বছর বয়সে শহীদুল্লাহকে হাওড়া জেলার সালদিয়া মাইনর স্কুলে ভর্তি করা হয়। স্কুলে তিনি আরবী-ফার্সির বদলে সংস্কৃতিকেই বেছে নিয়েছিলেন এবং সংস্কৃতিতে বরাবরই প্রথম হতেন। একজন মুসলমান ছাত্রের এই কৃতিত্ব দেখে স্কুলের হিন্দু শিক্ষক অবাক হয়ে যেতেন! সংস্কৃতের প্রতি বিশেষ আকর্ষণের কারণেই পরবর্তীতে তিনি এমএ পড়ার জন্য কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে দরখাস্ত করেন। কিন্তু সংস্কৃতের হিন্দু শিক্ষক সত্যবৃত সামশ্রমী একজন মুসলমান ছেলেকে সংস্কৃতের শাস্ত্র ‘বেদ’ পড়াতে কিছুতেই রাজী হলেন না।
ভর্তি পরীক্ষায় পাশ করা সত্ত্বেও সংস্কৃত পড়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন দেখে শহীদুল্লাহ ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেন। মামলাটি দিল্লী হাইকোর্ট পর্যন্ত গড়ায়। হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়, শহীদুল্লাহকে সংস্কৃতি পড়তে দেওয়া হোক, অন্যথায় বিশ্ববিদ্যালয়ে তার জন্য একটি সাবজেক্ট চালু করে তাকে পড়ানোর ব্যবস্থা করা হোক। কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আদালতের দ্বিতীয় নির্দেশ অনুযায়ী ‘ভাষাতত্ত্ব বিভাগ’ নামে নতুন একটি ফ্যাকাল্টি চালু করেন। শহীদুল্লাহ সেখানেই ভর্তি হন এবং ১৯১২ সালে সংস্কৃতে এমএ পাস করেন।
কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই তিনি নবগঠিত “বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি”র সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৮১৮ সালে তিনি ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পত্রিকা’র যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯১৯ সালে তিনি কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে শরৎকুমার লাহিড়ী গবেষণা সরকারী পদে যোগ দেন। ১৯২০ সালে তিনি শিশু-কিশোরদের জন্য “আঙুর” নামে একটি মাসিক পত্রিকা বের করেন। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি সংস্কৃত ও বাংলা বিভাগের একমাত্র শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। এরপর একটানা ২৩ বছর তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। সেখানে তিনি দু’বছর আইনের অধ্যাপনাও করেছেন।
১৯২৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রীষ্মকালীন ছুটির অবসরে শহীদুল্লাহ ভারতের ‘মালাকান’ রাজপুতদের মাঝে ইসলাম প্রচারের জন্য যান। ওই বছরের শেষে তিনি ঢাকা প্রতিষ্ঠা করেন ‘আঞ্জুমানে ইশায়াত-ই-ইসলাম’ নামে একটি ইসলাম প্রচার সমিতি। ১৯২৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দু’বছরের ছুটি নিয়ে উচ্চ শিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে তিনি প্যারিসে যান। ফরাসী ভাষার মাধ্যমে বাংলা ভাষার সবচেয়ে পুরনো কাব্যগ্রন্থ ‘চর্যাগীতি’ সম্পর্কে দু’বছর গবেষণা করে তিনি ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন।
১৯২৮ সালে দেশে ফিরে শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি পত্র-পত্রিকার বাংলা ও ইংরেজিতে উঁচু মানের প্রবন্ধ লিখতে শুরু করেন। তার প্রথম প্রবন্ধের বই ‘ভাষা ও সাহিত্য’ প্রকাশিত হয় ১৯৩১ সালে। এরপর তিনি একের পর এক বই লিখতে থাকেন। তাঁর লেখা বইয়ের সংখ্যা একশ’র কাছাকাছি আর দেশি-বিদেশি ভাষায় লেখা তার প্রবন্ধের সংখ্যা কয়েকশ’।
ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ যখন বাংলা ভাষার প্রথম সহজবোধ্য ‘বাংলা ব্যাকরণ’ লিখলেন তখন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর খুশী হয়ে তাঁকে একটি চিঠি লিখেন। ওই চিঠিতে তিনি বলেন, ‘আপনার বাংলা ব্যাকরণখানি পড়ে বিশেষ সন্তুষ্ট হয়েছি। ব্যাকরণখানি সকল দিকেই সম্পূর্ণ হয়েছে। এতে ছাত্রদের উপকার হবে। বইখানি আমার শান্তি নিকেতনের বাংলা বিভাগের অধ্যাপকদের দেব। তাঁরা তা শ্রদ্ধাপূর্বক ব্যবহার করবেন।’
ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ শিশু-কিশোরদের জন্য ‘আঙুর’ পত্রিকা বের করার পর একে স্বাগত জানিয়ে পশ্চিম বাংলার বিখ্যাত লোকসাহিত্যিক ড. দীনেশ চন্দ্র সেন বলেন, ‘আপনার মত এত বড় পণ্ডিত, যাহার বিদ্যার পরিধি আয়ত্ত করিবার সাধ্য আমাদের নাই, যিনি বেদ-বেদান্তের অধ্যাপক, ফার্সি ও আরবী যার নখদর্পণে, যিনি জার্মান ব্যাকরণের জটিল ব্যুহ ভেদ করিয়ে অবসর রঞ্জন করে- তিনি একটি ‘আঙুর’ হাতে নিয়া উপস্থিত!’
বাংলাদেশের বিশিষ্ট লেখক ও শিক্ষাবিদ প্রিন্সিপাল ইবরাহিম খাঁ বলেন, ‘ড. শহীদুল্লাহর মন ছিল চির সবুজ, চির নমনীয়। সনাতন আচার তার মনে কখনো বন্ধন হয়ে দাঁড়ায় নাই। বাংলা ভাষা-সাহিত্যের বিজয় অভিযানে তিনি নির্ভীক পতাকাবাহী সৈনিকরূপে অনাগত ভবিষ্যতে বেঁচে থাকবেন।’
অন্যদিকে বিশিষ্ট কবি, শিক্ষাবিদ, গবেষক ও লেখক অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান বলেছেন, “ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে প্রধানতঃ বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে, এই উপমহাদেশে এমন এক অনন্য প্রতিভা যাঁর পরিচয় শুধু প্রশংসার শব্দ উচ্চারণ করে দেয়া চলে না। তিনি জ্ঞানকে শুধু গ্রহণই করেননি, সর্বত্র সেই জ্ঞানের তাপকে ছড়িয়েছিলেন। ভাষা সাধনার ক্ষেত্রে তাঁর কৌতুহল এবং অন্বেষণের কৃতিত্ব অসাধারণ। ধর্ম ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও তিনি উল্লেখযোগ্য কর্মকাণ্ডের অধিকারী হয়েছিলেন।”
ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সম্পর্কে কয়েকজন বিখ্যাত মনীষীর মূল্যায়ন জানলাম। তাঁর প্রতিভা ও সাধনা এত বেশী ছিল যে, কোন মূল্যায়নই তাঁর জন্য যথেষ্ট নয়।