জাদুর আয়না

সে অনেককাল পরের কথা। পৃথিবীটা তখন অনেক বদলে গেছে। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর অনেকটাই আগের যুগে ফিরে গিয়েছে পৃথিবী। রেডিয়েশনের কারণে পৃথিবীর অধিকাংশ জায়গা পরিত্যক্ত। রাজাদের যুগ আবারও ফিরে এসেছে। ফিরে এসেছে আদিম যুগের অনেক কিছুই। একবার এক বৃদ্ধ রাজা তার দুই ছেলেকে ডেকে বললেন, “একটা উপকথা আছে তোমরা জানো- জাদুর আয়না। যে এই আয়নার দিকে তাকাবে তার বয়স অতীতে ফিরে যাবে, অর্থাৎ সে যৌবন ফিরে পাবে। আমি অনেক বৃদ্ধ হয়ে গেছি। আমাকে তোমাদের মধ্যে যে এই আয়না এনে দিতে পারবে তাকে আমি রাজা বানিয়ে এই আয়না নিয়ে অ্যাডভেঞ্চারে চলে যাব। এই রাজ্য চালাবে তোমাদের মধ্যে যোগ্যতর ব্যক্তিটি।”
দুই ভাইয়ের মধ্যে বড় ভাইটি ছিল অনেক চতুর, সেই তুলনায় ছোট ভাই অনেকটাই সরল মনের মানুষ। অনেক লোকবল নিয়ে বিশেষ ধরনের যানবাহনে চড়ে রওনা দিল দুই ভাই। বড় ভাই উত্তরে, ছোট ভাই দক্ষিণে। কিন্তু ছোট ভাইটি টের পায়নি যে তার সঙ্গী বাহনগুলোর মধ্যে বোমা রেখে দিয়েছে তার বড় ভাই। রাজ্যের সীমানা পার হবার পর ছোট ভাইয়ের সঙ্গীসাথীরা সবাই ধ্বংস হল বিস্ফোরণে। কেবল ছোট ভাই একা বেঁচে থাকল তার  সেই বাহনে। বড় ভাই নিশ্চিত করল যে সে নিজে পারুক আর না পারুক, তার ছোটভাই সফল হবেনা। এদিকে ছোটভাই ম্যাপ দেখতে পারে না ঠিকমত। সে ভুলভাল চালিয়ে একটা রেডিয়েশন জোনের কাছাকাছি চলে আসল। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেওয়ার জন্য সে নামল তার বাহন থেকে।   অবাক হয়ে ছেলেটি চেয়ে দেখল, রেডিয়েশন জোনের খুব কাছাকাছি হলেও, জায়গাটা অনেক সুন্দর। ছোট্ট একটা ঝর্ণা আছে, তাকে কেন্দ্র করে ছোটখাট একটা বনের মত অঞ্চল। হরিণ চড়ে বেড়াচ্ছে। পাখি ডাকছে। দুই একটা কাঠবিড়ালীও দেখা গেল। ওকে দেখে গাছের গুড়ির ভেতর ঢুকে গেল। ফুলগাছগুলোর নিচে সদ্য পড়ে যাওয়া পাপড়িগুলোর উপরে আসা যাওয়া করছে লাল পিঁপড়ের দল। একটু সামনে এগিয়ে আরও অবাক হয়ে সে লক্ষ্য করল, কিছু কবুতর চড়ে বেড়াচ্ছে এদিক সেদিক। সে প্রচণ্ড ক্ষুধার্ত থাকায় আশেপাশে মানুষ থাকার সম্ভাবনা বিবেচনা না করেই একটি কবুতর মারতে উদ্যত হল। “এই ছেলে! তোমার সমস্যা কী?!” মেয়েকণ্ঠের তীক্ষ্ণ চিৎকারে চরকির মত পাক খেয়ে ঘুরল ছেলেটা। তার সমবয়সীই হবে। বড় বড় টানাটানা চোখ, ছড়ানো চুল, আর চেহারায় মায়াবী এক আভা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে লম্বা মেয়েটি। কপালের মাঝখানটা কুঁচকে আছে, তাতে সৌন্দর্য বোধহয় আরও কয়েকগুণ বেড়ে গিয়েছে। “সরো! দূরে যাও আমার কবুতর থেকে!” ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে সরে এল ছেলেটি। মেয়েটি কবুতরগুলোকে একটু দূরে রেখে আসল।
“তু-তুমি এখানে থাক?” বিস্ময় সামলে জিজ্ঞেস করে ছেলেটি। –   হ্যাঁ, থাকি। সমস্যা? –   না, মানে বলতেসি কার সাথে থাক? –   আমি একাই থাকি, আর আমার এই বন্ধুরা থাকে। তুমি আমার কবুতরের দিকে চোখ দিসিলা কেন, হ্যাঁ? –   দুঃখিত, আসলে ক্ষুধার্ত আমি অনেক… –   তো পোষা কবুতর দেখে বুঝো নাই যে আশেপাশে মানুষ আছে? একটা থাপ্পড় দিব! কত্ত বড় সাহস, আমার কবুতরের দিকে হাত দেয়! আসো আমার সাথে এখন! চুপচাপ অনুসরণ করে ছেলেটি, মেয়েটির ছোট্ট একটা ঘর আছে ঝর্ণার পেছনে। সেটার ভেতরে নিয়ে গেল সে ছেলেটিকে। ছিমছাম একটা ঘর, অনেক গোছানো। রাজপ্রাসাদের কোন ঘরও এত গোছানো নেই। “বাহ, তুমি তো অনেক গোছানো মেয়ে”, প্রশংসা করল ছেলেটি। “ঘর অগোছালো থাকলে আমার ভালো লাগে না, তাই সময় পেলেই ঘর গুছাই আমি। তোমার খাবার নাও।” মেয়েটির রান্নাও ভাল। এই খাবারটি সে দেখেছে কোথাও, কিন্তু সে ঠিক মনে করতে পারছে না কোথায়। কিন্তু এই প্রথম সে খাচ্ছে এটা- এ ব্যাপারে তার কোন সন্দেহ নেই। -আচ্ছা, এই খাবারটার নাম কী? -পাস্তা   ভিমড়ি খেল খাওয়ার মাঝে সে। তার মনে পড়ে গিয়েছে এ জিনিস কোথায় দেখেছে সে। ইতিহাস বইয়ে এর ছবি আছে। অনেককাল আগে মানুষ এ খাবার খেত। “কী হল? খাচ্ছো না কেন? মজা হয়নাই?” মেয়েটি ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। -না, না, সেটা না… -তাহলে কী? -না মানে, আমি জানতাম এই খাবারটা অনেক আগে মানুষ খেত… মিটিমিটি হাসল রহস্যময়ী। -হ্যাঁ, আমিও অনেক আগে থেকেই খাচ্ছি রাজার ছোট ছেলে এর কোন কূলকিনারা করতে না পেরে জলদি খাওয়া শেষ করল। এবার মেয়েটি জানতে চাইল ছেলেটির বৃত্তান্ত। সরল মনে রাজপুত্র সব খুলে বলল। জাদুর আয়নার কথা শোনার পর মেয়েটির মুখের অভিব্যাক্তি বদলে গেল। সে রাজপুত্রের জামার কলার আঁকড়ে ধরল। -তোমার সাথে আর কে আছে? -আর কেউ নেই, আর কেউ নেই। বড় ভাই তো উত্তরে গেছে, আর আমার সব লোকজন মারা গেছে। -তোমরা আমার জাদুর আয়নার কথা জানলে কীভাবে? আমি দেব না আমার আয়না। যাও, বের হয়ে যাও! এবার সবকিছু পরিষ্কার হয়ে গেল রাজপুত্রের কাছে। এই আদিযুগের খাবার রান্না সে করতে পেরেছে কারণ সে আদিযুগ থেকেই আছে পৃথিবীতে। সে চিরকুমারী। চোখ ছলছল করছে মেয়েটির। অনেক ভয় পেয়েছে সে। খারাপ লাগল রাজপুত্রের। সে শান্ত করল মেয়েটিকে।
তারপর জিজ্ঞেস করল, “একা একা এভাবে বছরের পর বছর বেঁচে থাকতে তোমার ভাল লাগে?” চোখ মুছল মেয়েটি, “আমি একা না, এসো তোমাকে কিছু জিনিস দেখাই।”     মেয়েটির পিছু পিছু যায় ছেলেটি। কিছুক্ষণ হাঁটার পর এক বিশাল বাগানের সামনে এসে দাঁড়ায় ওরা। মেয়েটি বলতে শুরু করে ওর কাহিনী। “এই গাছগুলো রেডিয়েশন দূর করে। এই জায়গাটা আগে রেডিয়েশন জোনের প্রায় ভেতর ছিল, একটা ছোট্ট চারাগাছ পেয়েছিলাম আমি যখন এখানে প্রথম আসি। সেটা বড় হচ্ছিল না। একদিন অনেক মন খারাপ ছিল। আমি ওর পাশে বসেই কেঁদে ফেলি। পরেরদিন দেখি গাছটা বড় হতে শুরু করেছে। কিছুদিন পর টের পেলাম যে আশেপাশের এলাকার রেডিয়েশন  কমা শুরু করেছে। আমি আরও গাছ লাগালাম। আর আমার কষ্টের কথা ভাবতাম ওদের পাশে বসে প্রতি বিকেলে। ওরা বড় হত। আমার চোখের পানি না থাকলে যেই পাখিগুলো, প্রাণিগুলো এখানে দেখছ- কেউ থাকত না। আর আয়না না থাকলে আমিও থাকবো না। এই গাছ, এই প্রকৃতি কিছুই থাকবে না। এই প্রাণীগুলোকে মেরে ফেলবে তোমরা, বল?” মেয়েটির চোখ মুছে দেয় রাজপুত্র। “নাহ, আমি থাকতে কেউ ওদের মরতে দেবে না।” বহুকাল পরে কারো বুকে মাথা রেখে কাঁদে মেয়েটি।   পরেরদিন সকালে রাজপুত্রের ঘুম ভাঙে মেয়েটির চিৎকারে। তার পোষা ইঁদুরকে ঝাড়ি দিচ্ছে। মুচকি হেসে বাইরে এসে দাঁড়ায় ছেলেটি। সে এখানেই থাকবে, পৃথিবীটাকে আরেকটু বাসযোগ্য করবে। রাজত্ব চাইনা তার। ঘর গোছাচ্ছে তার জাদুর আয়নার রাণী। ও ঢুকতেই বলে উঠল, “তোমাকে যে ঝাড়ি দিই তুমি রাগ করোনা তো? এটা আমার অনেক আগের অভ্যেস, বুঝলে? আমি আমার কাছের মানুষগুলোকে মজা করে ঝাড়ি দিই। আমার ভালো লাগে।” রাজপুত্র হাসে, “তোমার কাছে আগের পৃথিবীর গল্প শুনবো আমি, এতগুলো বছর কীভাবে বেঁচে ছিলে তার গল্পও শুনবো।” তাদের কথাবার্তায় ছেদ পড়ে দূর থেকে ভেসে আসা একটি গুঞ্জনে। সেটির তীব্রতা বাড়তে থাকে। কীসের আওয়াজ দেখার জন্য বাইরে আসে ওরা দুজন। বিস্ফোরিত চোখে রাজপুত্র দেখে, তার বড় ভাই তার বাহিনী নিয়ে এগিয়ে আসছে।   মেয়েটিকে বুঝানোর চেষ্টা করে রাজপুত্র যে সে এসবের কিছুই জানে না, আর ও যাতে এখনি পালিয়ে যায়। ও ওর ভাইকে সামলাবে। মেয়েটি লুকায় ঝর্ণার এক কোণে। বড় রাজপুত্র নেমে আসে আর নির্লজ্জ্বের মত তার ভাইকে বলে দেয় কীভাবে একটা ট্র্যাকিং ডিভাইস সে লুকিয়ে রেখেছিল ওর জামার ভেতর, আর কীভাবে ওর বাহিনীকে সে ধ্বংস করেছে। প্রচণ্ড রাগ হয় ছোট রাজপুত্রের। কিন্তু বড় ভাইয়ের বিশাল বাহিনীর কাছে ওর কিচ্ছু করার নেই। ও পড়ে পড়ে মার খায়। মেয়েটির তা সহ্য হয়না। বের হয়ে আসে সে, বড় রাজপুত্র তার ভাইয়ের গলায় ছুরি ধরে মেয়েটিকে বলে আয়নাটা এনে দিতে, নাহলে তার ভাই এর গলা সে এখনি কেটে নিবে। বাধ্য হয়ে তার জাদুর আয়না নিয়ে আসে মেয়েটি। শেষবারের মত মুখ দেখে নেয় ওতে। তারপর ক্ষিপ্রতার সাথে আক্রমণ করে বসে বড় রাজপুত্রকে।   ছুরি হাতে আত্মরক্ষার এই কৌশলটি অনেকবার অনুশীলন করেছে বড় রাজপুত্র। আক্রমণকারীর মৃত্যু এতে নিশ্চিত। তাই হল। মেয়েটির নিথর দেহ পড়ে রইল তার চোখের পানিতে গড়ে ওঠা সবুজ ঘাসের ওপর।
সাথে সাথে তার ওপর শেষ অশ্রুবিন্দুটুকুও পড়ে রইল।   গভীর রাতে চেতনা ফিরে আসে ছোট রাজপুত্রের। সারা শরীরে অসহ্য ব্যথা। চোখ ঘুরিয়ে দেখল সে সেই মায়াবী মুখটিকে। যে মুখটি আশেপাশে প্রাণ ছড়িয়ে রেখেছিল আলোর মত, ওতে এখন প্রাণের কোন চিহ্ন নেই। কেমন যেন একটা শূন্যতা। নিজেকে মৃত মনে হল রাজপুত্রের। এ ধরনের মানুষের হারানোর কিছু নেই, তাই তারা ভয়ংকর।   এক সপ্তাহ পর। আজ রাজা জাদুর আয়নায় নিজের মুখ দেখবেন। তার বড় ছেলে তার জন্য নিয়ে এসেছে আয়না, তাই আজ তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে রাজ্যের ভার তার হাতে তুলে দেবেন। ছোট ছেলের জন্য চিন্তা হচ্ছে, কিন্তু তাই বলে বড় ছেলেকে তার প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করবেন না তিনি। রাজার শয়নকক্ষে ঢোকার একটা গোপন দরজা আছে। তার পরিবারের লোকজন ছাড়া আর কেউ জানেনা সেটা। ছোট রাজপুত্র খুব সাবধানে ছদ্মবেশে ঢুকে পড়ল সেখানে। জাদুর আয়না খুঁজে বের করে চুপিসারে বেরিয়ে এল।
তারপর সবাই যখন অনুষ্ঠানে যাচ্ছে, সে প্রাসাদের ছাদে উঠল। আকাশের দিকে চেয়ে বল, “হে অশ্রুকুমারী। এ আয়নার অধিকার তোমার, আর কাউকে এটা পেতে দেব না আমি।”   সূর্যের দিকে মেলে ধরল সে আয়নাটিকে। ধরের থাকল, ধরেই থাকল। সূর্যের বয়স কমা শুরু করল। একসময় যে তার আলো আর উত্তাপ হারাতে শুরু করল, শীতল হতে শুরু করল সূর্য।

শালুকের দৈত্য

আসিফ ও দানবের গল্প

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *