
গতকাল বাজারে গিয়েছি। হঠাৎ চাচার ফোন। আমি তো অবাক। চাচার তো এমন সময়ে ফোন আসার কথা না। তারচেয়ে বলা ভাল চাচা যেখানে আছে সেখান থেকে এখন ফোন করতে পারার কথা না। যাইহোক কিছুটা কৌতূহল নিয়েই ফোনটা ধরলাম।
- আরে চাচা, কেমন আসো??
- ভালা, তোমার খবর কি?
- এইতো। তুমি কোথায়? কেমনে ফোন করলা?? অইখানে তো নেটওয়ার্ক থাকার কথা না।
অবশেষে জানা গেল চাচা খাগড়াছড়ির কোন একটা পাহাড়ের উপরে। নিচে নেটওয়ার্ক নাই দেখে পাহাড় বেয়ে উপরে উঠে হলেও গ্রামীনফোনকে তার টাকা দেয়া চাই। আজকালকার জামাইরাও মনে হয় শ্বশুরবাড়িতে এত আদর পায়না। সব শুনে ভাবি এই না হলে চাচা। পাহাড়ের চুড়ায় উঠে ভীষণভাবে নিচে থাকা আমার কথা যত্ন করে মনে রেখেছে। মনটা খুশি খুশি হয়ে ওঠে।
মুজতবা আলী চাচা কাহিনী লিখে গেছেন আমার জন্মেরও কত আগে। আর তার মৃত্যুরও কত পরে আমি আবার আমার প্রিয়, আমাদের প্রিয় চাচাকে নিয়ে লিখতে বসলাম। চাচার ছয় বছরের বর্ণাঢ্য ক্যাডেট ক্যারিয়ার এর দিকে চেয়ে তার জন্য দুই এক লাইন লেখা মোটেও বাড়াবাড়ি নয়। বরং একে ঋণস্বীকারও ধরে নেয়া যায়।
কলেজে থাকতে মজা করে বলতাম চাচা প্লাইস্টোসিন কালের মানুষ। ডাইনোসর এর রোস্ট না হলে তার নিয়মিত আহার ঠিক জমতোনা। আর্মিতে গিয়ে তখনকার মত শাহী বসবাসস্থল আর খানদানী ডাইনোসর না পেলেও খাগড়াছড়িও নিদেনপক্ষে খারাপ হয়নি। মন্দের ভাল। আমি কার কথা বলছি মির্জাপুরের পোলাপানের বুঝার বাকী নাই। অন্যান্য কলেজেরও বেশ বড়সড় অংকের পোলাপান চিনে যাবে একনিমিষেই।
আর যারা চিনেনা তাদের জন্য বলা- আমাদের সকলের শ্রদ্বাভাজন এই চাচার বাপ মা প্রদত্ত নাম রাসেল। ক্যাডেট কলেজের সেন্সর বোর্ড এর চিপায় পড়ে হয়ে গেল নাজমুল। আর বন্ধুদের আপামর ভালবাসায় পিষ্ট হয়ে সেখান থেকে আমাদের সবার প্রিয় “চাচা”।
এই পৃথিবীর কোন কিছুই কারণ ছাড়া ঘটেনা। ক্যাডেট কলেজের প্রত্যেকটা নামকরণের বেলায়ও একই কথা খাটে। প্রত্যেকটা নামকরণ এর পিছনে কত ইতিহাস আর কত আইনস্টাইন এর মাথা একসাথে কাজ করে সেটা আমাদের সবারই জানা। আমাদের চাচারও “চাচা” হয়ে ওঠা শুধু নামেই নয়। কাজের মধ্য দিয়েও সুপ্রতিষ্ঠিত। পাঞ্জেরী বাংলা গাইডের ভাষায় বলতে গেলে- উক্ত নামকরণ সর্বকারান্তে সার্থক ও সময়োপযোগী।
চাচার সাথে আমার পরিচয় বেশ প্রাচীনকালের। চাচার স্নেহচ্ছায়া টাঙ্গাইলে ক্যাডেট কোচিং করার সময় থেকেই আমার জন্য বরাদ্দ। একসাথে আবাসিকে থাকতাম। কোচিং এর অনেকেই ওকে সহ্য করতে না পারলেও আমার সাথে কেন যেন দারুন মিলতো। দুইজনেই ক্লাসটাইমে লুকিয়ে গল্পের বই পড়ায় আসক্ত ছিলাম বলেই বোধহয়।
প্রথমদিন কলেজে এসে অতি আনন্দের সাথে আবিস্কার করলাম আমি আর চাচা একই হাউসে আর একই রুমে। এমনকি দুইজনের পাশাপাশি বেড। আমি ১৯৭৬ আর ও ১৯৭৭। দুইজনেই মহা খুশি। টাঙ্গাইল পেরিয়ে এখন মির্জাপুরেও এক সাথে ঘাটি গাঁড়লাম। আমার খুশি আস্তে আস্তে অন্যদের মাঝেও ছড়িয়ে পড়লো। কারণ আর কিছুই না। সবেমাত্র কৈশোরে পা দেয়া মাসুম বাচ্চাগুলা সরাসরি চাচার অধীনেই বেড়ে উঠতে লাগলাম।
চাচা “ঐ” বিষয়ে তার অগাধ জ্ঞানের ভান্ডার আমাদের মাঝে একবারে উপুড় করে ঢেলে দিল। আর আমরাও নাবালকত্ব বিসর্জন দিয়ে খুব দ্রুত সাবালক হয়ে উঠতে লাগলাম। কলেজে আসার আগে যে স্বাগত পানি দিয়ে ক্যাপসুল গিলে খেতে পারতোনা সে কীনা অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই জনৈক গুপ্ত মশাইয়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বই লেখার মত জ্ঞান অর্জন করে ফেললো। যার স্বাক্ষর সে পরবর্তী বছরগুলোতে বেশ কৃতিত্বের সাথেই রেখেছে।
চাচার ফ্রি কোর্সের অন্তর্ভুক্ত হলে গরুও মানুষ আর মানুষগুলো আরো জ্ঞানী মানুষ হয়। সেই কোর্সের এমনই গুণ। এমন গুন কি আর বেশি দিন চাপা থাকে। ফজলুল হক হাউসের সীমানা পেরিয়ে অন্য দুই হাউসেও চাচার সুনাম ছড়িয়ে পড়লো। একাডেমি ব্লকে প্রেপ টাইমেও চাচার ডেস্কের আশেপাশে অসংখ্য গুনগ্রাহীর ভীড় জমে যায়।
এমন বিদ্বান মানুষকে নাম ধরে ডাকতে আমরাও কেমন বিব্রত বোধ করি। কিছু একটা করা দরকার। কি করা যায় সবাই ভাবছি। বিশেষত ফজলুল হক হাউসের যারা। হাজার হলেও হাউসের এমন একটা রত্ন। ঐ সময়ে হুমায়ুন আহমেদের “অমানুষ” নামে একটা বই যেটা ইংরেজী “ম্যান অফ ফায়ার” এর বাংলা অনুবাদ, আমাদের মধ্যে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করলো।
ওই বইটাতে “এত্রা চাচা” নামে একটা চরিত্র ছিল। এই চাচার চরিত্রে আবার নারী ঘটিত কিছু সমস্যা আছে। সেই চরিত্রটা কেন জানি আমাদের মধ্যে বেশ ফেবারিট হয়ে গিয়েছিল। আর আমাদেরই কোন এক ক্লাসমেট, খুব সম্ভবত সাব্বির (অথবা হিমেল) এই ফেবারিট চরিত্রটার নামে আমাদের ফেবারিট নাজমুলকে ডাকা শুরু করলো।
মিলটা ঠিক কোথায় সেটা অবশ্য পরিস্কার নয়। তবে দুইজনের মধ্যেই একটা কমন বিষয় আছে- “নারী”। একজন নারীর প্রতি দুর্বল, আরেকজন নারী বিশেষজ্ঞ। এরচেয়েও অনেক ছোটখাট মিল থেকে অনেক বিখ্যাত নামের জন্ম হয়েছে। সেই তুলনায় এটা হাতি পরিমাণ সাদৃশ্য। আমরাও সাথে সাথে নামটা লুফে নিলাম। সেদিন থেকে নাজমুল হয়ে গেল “এত্রা চাচা”।
বেচারা বুঝতেও পারলোনা তার পিতৃপ্রদত্ত নামটা বিলুপ্তির দিকে তিন গজ এগিয়ে গেল। এর কিছুদিন পরে বৃহস্পতিবার ভি সি আর শো তে “বাদশা” মুভি দেখানো হল। সেই ছবি থেকে আরেক চরিত্র আমাদের আলোচনায় উঠে আসলো,”নিনজা চাচা”। হাসিমুখে আমরা সেই নামও “এত্রা চাচা”র জন্য বরাদ্দ করলাম।
কিন্তু মাঝে মাঝে দুই নাম নিয়ে গন্ডগোল বাঁধতো। একদল বলে এত্রা চাচা তো আরেকদল বলে- না,নিনজা চাচা। অবশেষে দফা রফা হলো এত্রা কিংবা নিনজা কোনটাই না। আগের দুইটা ছেঁটে ফেলে এখন থেকে শুধু “চাচা”। শেষমেষ একটা আকীকা করা নাম পেয়ে আমরাও সবাই খুশি।
চাচা খুশি হয়েছিল কীনা সেটাকে “কোশ্চেন অব দ্যা মিলেনিয়াম” হিসেবে চোখ বন্ধ করে মনোনয়ন দেয়া যেতে পারে। চাচার গুণের মত নামটাও দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়লো। হাউস বেয়ার এসে বলে- চাচা, আপনারে অমুক স্যার ডাকসে। ফর্ম ক্লাসে মালেক স্যার তার স্বভাবসুলভ টানে বলে- “ছাছা দাঁড়াও।” জুনিয়ররাও আড়ালে আড়ালে চাচা ডাকে।
একদিন এক জুনিয়র এসে বলতেসে- “কাইন্ডলি জিহাদ ভাই, চাচা আপনার কাছে অমুক বইটা চাইসে।” শুনে আমি চোখ পাকিয়ে তাকাতেই জুনিয়র ভয়ে কাঁচুমাচু। শেষ পর্যন্ত আর হাসি চেপে রাখতে পারিনাই। জুনিয়রটাও হাপ ছেড়ে বাঁচসে। এথলেটিক্স এর আগে প্রাকটিসে আমি আর চাচা এক সাথে দৌড়াচ্ছি। তানভীর স্যার দেখে বলে- “কি মিয়ারা, চাচা ভাতিজা এক লগে দৌড়াও।”
শুনে আমি হাসি। চাচার গজদাতটাও বিকেলের রোদে স্পষ্ট ঝিকঝিক করে ওঠে। সেও খুশি। সব মিলিয়ে এই হল আমাদের চাচা। আমাদের ছয় বছরের রুটিন জীবনের ব্যতিক্রমী এক আনন্দের উৎস। চাচা যা করে তাতেই আমরা সবাই আনন্দ পাই।
কলেজ থেকে চলে আসার আগে আগে কয়েকজন মিলে চিন্তা করলাম- চাচার মত এমন জিনিস কলেজের গৌরব। তাই কলেজেই তাকে রেখে যাওয়া উচিত। সেই হিসেবে ফেয়ারওয়েলের দিন প্রিন্সিপালের হাতে কলেজ মিউজিয়ামের জন্য তাকে দান করে গেলে মন্দ হয়না!! চাচার কাহিনী একবসায় লিখে শেষ করা সম্ভব নয়। সে চেষ্টা করার মত বুকের পাটাও আমার নাই। কাজেই আমি ধারাবাহিক ভাবে লিখার চেষ্টা করবো। আজকের মত এখানেই বিদায়। ডাইনিং হল প্রিফেক্ট, আলহামদুলিল্লাহি রাব্বিল আলামীন। হে হে হে (চাম হাসি)