চতুষ্কোণ— রেজা নুর

সকাল বেলার এই সময় জানালা খুলে বাইরে তাকায় মিনি। ছোট্ট জানালা। বাইরের খুব সামান্য দৃশ্য ভেসে ওঠে। উপরে তাকালে আকাশটার এক কোণা চোখে পড়ে। সেই কোণায় আকাশ নীল ঘুড়ি হয়ে ঝুলে থাকে যেনো। মাঝে মাঝে মিনির ওড়নার মতো এক টুকরো মেঘ এসে দাঁড়ায়। স’রে যায়। আকাশ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ওর চোখ যায় পাশের সরু গরু-গাড়ীর রাস্তার দিকে। ওদের বাড়ীর পাশের ক্ষেতের কিনার ছুঁয়ে আছে রাস্তাটার দুবলো ঘাসের দঙ্গল। ওই রাস্তা ধ’রে প্রতিদিন হেলেদুলে হেঁটে আসে মফিজ। হাতের কাঁচিটা বাতাসে তরবারীর মতো দোলে।
অন্যহাতে ওর গরুটার দড়ি ধরা থাকে। বাচ্চা বয়সী এঁড়ে গরু। চোখের চারপাশ আর চুটির গোঁড়া ঘিরে হালকা কেশরের আশপাশে কালো মেঘের মতো রঙ হয়ে উঠেছে। টগবগ ক’রে একটু হেঁটে মফিজের হাতে হ্যাঁচকা টান দিয়ে দেয় দৌঁড়। একহাতে উদ্ধত কাঁচি অন্যহাতে দড়ির রুদ্ধশ্বাস টান। হাঁসফাস করতে করতে মফিজ মিনির জানালার কাছে এসে দাঁড়ায়। এঁড়েটাকে ভৎর্সনা করে। দুষ্টুমি আর অবাধ্যতার জন্য। মিনিকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলে, এত গায়ের জোর ভালো নারে কালু। কতা না শুনলি, ঘাস পাবি নে। বাজারে বেচেউ দিতি পারি।’ মিনি হাসে একমনে।
ভাবে, ছ্যামড়াডা শুদু শুদু অবুলা জানোয়ারের সাতে কতা কয়। উরা কী বোজে মানসির কতা?। ও এট্টা পাগল। বাইরের পাগল আজ মিনির মনের পাগল হয়েছে। কবে কীভাবে, মনে নেই। গরুর খুঁটো পুতে ফালুক ফুলুক করতো মফিজ। এদিক ওদিক তাকিয়ে শিস দিতো। কেমন যেনো গানের কলির মতো শিসের সুর। প্রথম দিকে তেমন কান দিতো না। মনে করতো ছেলেরা তো কত কিছু করে। দিনে কিম্বা রাত-বিরাতে রাস্তা থেকে ভেসে আসে কত হেড়ে গলার গান। সাইকেলের র্কি র্কি শব্দ ছাপিয়ে ছড়িয়ে পড়ে হো হো হাসি। তাই মফিজের শিস দেয়াটা আলাদা কোনো মানে হয়ে উঠেনি ওর কাছে। একদিন এমনই এক সকালে যখন মিনির বাবা মাঠে চলে গিয়েছে, মা পাড়ার কারও কাজে,—হঠাৎ হুড় হুড় করে কারও দৌঁড়ানোর শব্দ পেল মিনি। মফিজের এঁড়ে গরুটা ওদের উঠোন দিয়ে দৌঁড়ে ঘরের দিকে যেতে লাগলো। পেছনে দড়ি সাপের মতো চলছে এঁেকবেঁকে।
মিনি বারান্দাতেই ছিল। তাড়াতাড়ি একটা খালি পাতিলে মগ ঠুকে শব্দ করলে থমকে দাঁড়ালো গরুটা। মফিজ দৌঁড়ে এসে ধরে ফেললো দড়ি। কৃতজ্ঞতায় চোখ নরোম ছোট্ট মোলায়েম ক’রে তাকালো। বুক কেঁপে উঠলো মিনির। এক মুহূর্তের দৃষ্টি-বিনিময় এত গভীর আলো ফেলে মনে! সবকিছু জ্বলজ্বলে ক’রে আড়ার কাপড়ের মতো মেলে দেয় রোদে। মফিজের চিকন তনু-দেহ যখন বাতাসে বেত-শাখার মতো দুলতে দুলতে আসছিলো, মিনির সত্তায় মৃদু ঝড় উঠেছিলো তখনই। ও চলে গেলে সারাটা সকাল আর কিছুই করতে পারেনি। মা প্রতিদিন সংসারের কিছু কাজকর্মের বিবরণ দিয়ে চলে যায়। যদিও এগুলো মিনির জানা। বাবা মাঠ থেকে আসার আগেই ভাত তরকারী রেঁধে রাখা। ছাগলগুলোকে কাঁঠালপাতা পেড়ে সামনে এগিয়ে দেয়া। পাশের ছোট্ট ডোবায় ময়লা কাপড় চোপড় ধুয়ে আড়ায় নেড়ে দেয়া। এইসব। কিছুতেই মন বসাতে পারছিলো না আজ এগুলোতে। ওকে তো এর আগে কতবার দেখেছে। আজ কী হলো! মনে হচ্ছে ও যদি ওর ফর্সা গায়ে স্যান্ডো গেঞ্জির ওপরে চেকের গামছা চাপিয়ে দুলতে দুলতে আসতো আবার। বলতো, এই মিনি, শুইনে যা। কতা আচে।’ ও অভিমানে, বলতো, যাহ্, আমার সাতে এতো খাশখুশ কইরে কতা কচ্চাও কেনো? তুমার মতলব ভালো না। ‘কার মতলব ভালো না রে মিনি? একলা একলা কী কচ্চিস?’ মিনি চমকে তাকালো। আনমনে কথাগুলো ফুটিয়ে বলা হয়ে গিয়েছিলো। দেখে, ওর মা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। ‘তুমি চইলে আইলে যে মা। মোড়ল-বাড়ী আইজ কাজ নেই তুমার? ‘কাজ আছেরে। মোড়লের বউ’র এটটা জিনিস দরকার। আমার কাছে আচে তা। নিতি আইচি। তুই কাজকম্ম ফেলায় থুইয়ে বারান্দায় বইসে বইসে বাতাসের সাতে কতা কওয়া বন্দ কর।’
সেই রাতেই পরিচিত শিসটা আবার বেজেছিলো। তবে খুব আস্তে, থেমে থেমে। মা-বাবা অন্যঘরে। পাঁচ বছরের ছোট ভাই শুয়ে আছে মিনির খাটের এক কোণায়। ঘুমে কাদা। জানালায় পয়লা খুট্ খুট্ আওয়াজ। সাথে সেই শিস। মিনির ঘুম ছিলো না চোখে। গরমকাল হলেও বাতাসে ঠান্ডা ভাব। বিকেল বেলা একঝাঁক পাখির মতো মেঘ এসে ঝরেছিলো খুব। জানালার পাশের মেহগনি গাছের পাতা চুয়ে টুপটাপ এখনও ঝরছে কলাপাতায়। পট্ পট্ শব্দ তুলে পানির ফোটাগুলো পড়ছে মাটিতে। কোনোকিছু না ভেবেই জানালা খুললো। ভাতের মাড়ের মতো ঘোলাটে আলো এসে চোখে পড়লো। পরিষ্কার আকাশে চাঁদ এখন পাহারাদার। তিন তারার লাঠি হাতে তার। কোনো মেঘ যেন ঢুকে পড়তে না পারে আকাশের ত্রিসীমানায়। আলোর আয়নায় মফিজের হাসিমাখা মুখ। একটু আনত। চোখে চোখ রেখে আবার নামিয়ে নিলো। অর্ধেক লাজুক হাসিতে সরু গোঁফরেখা বাঁকা হলো একদিকে। মন হেলে দুমড়ে মুচড়ে উঠলো মিনির। ‘এটটু বাইরি আসতি পারবা, কতা আচে’। চোখে পলক ফেলে জানতে চাইলো মফিজ। ‘তুমি সইরে দাঁড়াও, আসতিচি’। মিনির চাপাস্বর। ঘুমন্ত ভাইয়ের দিকে একবার দেখে দরোজার খুললো। রাত কত বোঝা যায় না। ওদের বাড়ীর সামনের কাঁঠালগাছ, তেজপাতা গাছ আর উঠোনের কোণের জামগাছে ঝাঁকে ঝাঁকে জোছনা এসে বসে আছে। এই নিস্তব্ধ, সুনসান প্রশান্তিময় রাতে আনন্দে চোখের জল ফেলছে ওরা। মাটিতে খই ফোটার শব্দ তুলছে সেইসব আদ্র আনন্দ। মাঝে মাঝে পাড়ার কুকুরের ডাক শোনা যায় রাতে। আজ তারাও ঘুমিয়েছে।
বৃষ্টিতে ভেজা মখমলি বাতাসে ঘুমিয়ে পড়েছে সমস্ত চরাচর। চালাঘরের পাশ দিয়ে বাড়ীর পেছনে এলো। দাঁড়ালো একটু। দেখলো, মেহগনি গাছে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মফিজ। ধীর পায়ে এগোলো। মফিজ তাকিয়ে আছে। গায়ের ওড়না উঠিয়ে মাথা ঢাকলো মিনি। ফিনফিনে জর্জেট ওড়নায় চাঁদের আলো ছেঁকে মুখম-ল কিছুটা আবছা করলো ওর। সেই আবছা আলোয় তবুও ভরাট পান-পাতার মতো মুখ উজ্জ্বল হয়ে রইলো মফিজের চোখে। কিছুদূর গিয়ে থামলো মিনি। মফিজ এগিয়ে এলো। কেঁপে উঠলো চিকন মেহগনি গাছটা। দু’এক ফোটা জল টুপ ক’রে পড়লো ঝরাপাতায়। মিনির মুখোমুখি এসে দাঁড়াল মফিজ। কিছু বলছে না ও। মিনি বললো, কী কবা তাড়াতাড়ি কও। আরেকটু কাছে এসে চোখের দিকে তাকালো মফিজ। পলক পড়ছে না মিনির। অজান্তে মিনির হাতদুটো মুঠোয় পুরে নিয়ে বললো, তোমার আমি ভালোবাসি। বিয়ে কত্তি চাই।’ বলার ভঙ্গিতে খুব হাসি পেলো মিনির। ওদের বাড়ীতেও মাঝে মাঝে ভিখারী আসে। তাদের দু’এক জনের মুখ মনে পড়লো ওর। ‘ভালোবাসো তা বুক ফুলুয়ে বলবা, ফকিরির মতন বলতিচাও ক্যন্। ভালবাসতি সায়স লাগে। দুরিত্তে শুদু ফালুক ফুলুক করলিই হয় না।’ মফিজ অসাড় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। মিনির ধারালো কথার সামনে জমে গেছে ওর প্রেম-বোধ। হাত মুঠোয় ধ’রে শুধু তাকিয়ে থাকতে পারলো। দেখার আনন্দ যে এমন, এই অনুভব, অনুভূতি, অজানা ভাললাগা আর কোনোদিন টের পায় নি মফিজ। কতকিছুর ওপর তো ওর দৃষ্টি যায়। সকালের সূর্য ওঠা। ঘাসের জল-বিন্দুর ওপর সোনার নাকফুল। ফসল-ভরা মাঠ। ঢেউ-ওঠা বিস্তীর্ণ সবুজ। সবই এক আলাদারকম ভালোলাগার শিহরণে ভরিয়ে দেয় প্রতিদিন। তবে আজ এই নিঝুম, আলোছায়াময় রাতের আভায় মিনির মুখের ওপর থেকে দৃষ্টি আর কখনও সরিয়ে নিতে ইচ্ছে করছে না। এই রাত যদি থেমে যেতো! ‘তোমার দেকা হলি আমি একন যা-ই?’ মফিজের দুই কাঁধে হাত লম্বা ক’রে দিয়ে চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো মিনি। ওদের উঠোনের বাঁশের যুগল আড়ার মতো হয়ে রইলো ওর হাত দুটো। কনুইয়ের ওপরে কামিজের হাতা যেখানে শেষ সেখান থেকে মিনির সুগোল দুই তুলতুলে লম্বাটে বাহু ফেলে রাখা আছে মফিজের একটু উঁচু কাঁধে। মফিজ ওর দুটো হাত কোথায় রাখবে ভাবছে। ওড়না সরে গিয়ে মাথা আলগা হয়েছে মিনির। একটুখানি ভিজে হাওয়ায় মাটিতে গিয়ে পড়লো ওড়নাটা।
মফিজ ঘাড় বাঁকা ক’রে দেখলো। দৃষ্টি ফিরিয়ে দ্যাখে, মিনি সামান্য শব্দ ক’রে হাসছে। দুলছে ওর শরীর। মফিজ অবাক হলে। বললো, কী হইলো ? হাসতিচাও ক্যান্? ‘তুমার কা- দেইকে হাসতিচি। আমি ঘাড়ে হাত রাকলাম। বাতাসও ওড়না ফ্যালায় দেলে আর তুমিও একনও লাউয়ের মতো ঝুলোয় রাকিচাও তুমার হাত। তুমি কীরাম মজনু, বিহান-রাত্তির পীরিত করতি আইসে দাঁড়ায় রইচাও নি:সাড় হইয়ে? ঘাড় থেকে নামিয়ে বগলের নিচে দু’হাত বাড়িয়ে মিনি পেঁচিয়ে ধরলো মফিজের দেহ। লেপ্টে রইলো ওর দুটো বুক। মফিজ দুহাতে জড়ালো মিনিকে। একবার চেপে পিষে ফেলতে চাইছে, আবার বাঁধন শিথিল ক’রে তাকিয়ে আছে। মিনির থই থই বুকের দিকে ভালো ক’রে তাকালো এবার। অজান্তে একটা হাত উঠে এলো। মুঠোয় পুরে নিলো মিনির একটা স্তন। চোখটা সামান্য বুঁজে একটু হেলে পড়লো মিনি। একটা হাত বাড়িয়ে মিনির পিঠ আঁকড়ে জড়িয়ে থাকলো মফিজ। মুঠোয় পুরে পুরে, হাতের পাতা মেলে চেপে চেপে কতক্ষণ মিনির স্তনদুটো নিয়ে খেললো মফিজ। মাঝে মাঝে তাকালে মিনির চোখে। আধঁবোজা চোখে, অস্ফুট ঈষৎ মেলে রাখা ঠোঁটে চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দিলো। এই প্রথম মিনির চোখে-মুখে দেখলো একটু লজ্জার আভা। এখন কতরাত কে জানে। চাঁদ হেলেছে একটু। জোছনা তবু আগের মতোই। টুপটাপ শব্দ তুলছে কলাপাতা এখনও। হঠাৎ বাড়ীর ভেতর থেকে কুকুরের ডাক ভেসে এলো। সম্বিৎ ফিরলো ওদের। মিনি বললো, আইজ যাও। বাড়ীর লোক জাইগে যাতি পারে। ‘তুমি তো আর কিচু বইললে না।’ বললো মফিজ। ‘সব কী মুকি বলতি হয়, পাগল। তুমার চিহারা দেইকে তো বুকা মনে হয় না। কতাবাত্তারা বুকার মতন ক্যান্। আল্লারে, পুরুষ মানষির কবে বুঝ-জ্ঞান দুবা। উরা শুদু মনে হয় এটটা জিনিসই চাতি জানে। সেইডে কীরাম কইরে পাবে সেই ফন্দি ছাড়া আর জানে না কিচু।’ হড়বড় ক’রে কথাগুলো ব’লে তাকালো মফিজের দিকে।
মফিজ মুখ ভার করে আছে দেখে দুইহাতের তালু দিয়ে মুখটা নিবিড় ক’রে ধ’রে হেসে বললো, মন খারাপ করো ক্যান্? আর কডা দিন যাক। তুমিও নিজির জন্যি, নিজির মতো কইরে কিছু করা শেকো। শুদু একটা আইড়ে গরুর ঘাস খাওয়াইয়ে ড্যাডাং ড্যাডাং কইরে ঘুইরে বেড়ালিই সংসার করা যায়? আমি তো আচি। তুমারে ছাইড়ে যাচ্চি নে কারও ঘরে। গেলি কী তুমার শিস দিয়া শুইনে বাইরি আসতাম, ঝাঁপায় পড়তি পারতাম উরাম কইরে তুমার বুকির ’পরে ? মফিজ আর কোনো কথা বলতে পারলো না। আরেকবার মিনিকে নিবিড় করে জড়িয়ে রাখলো বুকে। দুই বুকের স্পন্দনে কত কী যে কথা বিনিময় হলো, তা শুধু জানে ওই চাঁদ, মিহি রোদের মতো জোছনা, তারা, আর অফুরাণ রাত। – দুই – ইটের রাস্তার ধারে জামালের বাড়ী। দুইবিঘা জমির এককোণায় মাটির ঘরের ওপরে খড়ের চাল। মাটি থেকে সামান্য উঁচু বারান্দাটায় কেউ ব’সে থাকলে দেখা যায় রাস্তা থেকে।
রমণীর চওড়া কপালের মতো এক চিলতে উঠোন। তারপর একটু পর পর সারি সারি মেহগনির চারা লকলকিয়ে উঠেছে। কাঁঠাল আর আমের গাছগুলো আগেই ছিলো। বেশ ঝাঁকড়া হয়ে হয়েছে এখন। একটু জোরে বাতাস হলে লালচে কাঁঠাল পাতা বা হালকা সবুজ আম-পাতা এসে খেলা করে জামালের ওই উঠোনে। বাড়ী, ছোট্ট একটা রান্নাঘর আর গাছপালার ওপাশে আরেক বিঘা জমিতে ধান বোনে জামাল। এ পাড়ায় ওরা নতুন। এই সরসকাঠি গ্রামের উত্তর পাড়ায় ওদের বাড়ী। দুই ভাইয়ের ভেতর বনাবনি না হওয়ায় উঠে এসে ওদের মেঠো-জমিটার বুকেই আশ্রয় নিয়েছে। ভেজা চোখে বাপের ভিটের মায়া ছেড়ে চলে এসেছে। আর ফিরেও তাকায়নি কোনো দিন। জামালের এক ছেলে। দুই বছরের ছেলেটা দেখতে মায়ের মতোই। চোখ ঘোলাটে, অতিরিক্ত ফর্সা রঙ, চুল কটা। গায়ের রঙ, চেহারা ও চুল মায়ের কাছ থেকে পাওয়া। তবে চোখদুটো জামালের। এমন ধবধবে চেহারায় চোখ মানিয়েছে খুব। জামাল অত ফর্সা না হলেও কালো বলা যায়না। কিছুটা চ্যাপটা চেহারার কারণে লোকে ওকে ডাকে, ‘জাপান-জামাল’। এই নিঝুম গ্রামে জাপানের মতো উন্নত ঝলমলে দেশের নামটা উচ্চারিত হয় জামালের এই পরিবারের কারণে। নিজেদেরকে নিয়ে এইরকম সরস হাস্য-তামাশায় কিছু মনে করে না জামাল। পান-তামাকের আসরে মুচকি হেসে বউটার মুখ মনে ক’রে তৃপ্তি পায়। এই নিতান্ত হতদরিদ্র সংসারে হতাশা উঁকি দিতে পারে নি কোনোদিন। তা যেমন জামালের সদাহাস্য সদা-প্রফুল্ল মন-মানসিকতার জন্য, আবার ঘর আলো-করা বউটার জন্য-ও। চাঁদপুর গ্রাম থেকে ওর বাপে এই চাঁদ এনে দিয়েছিলেন।
বিয়ের আগে জামাল মেয়ে দেখেনি। জামালের বাপ বলেছিলেন, শোন্ জামাল, এই মাইয়ে যদি তোর পছন্দ না হয় তা-লি তোর বাপের নাম পাল্টায় দিস। নিজের রসিকতায় হো হো ক’রে হেসেছিলেন। বউ’র রূপ পয়লা দিন দেখার পর জামালের মৃদু-আউলা মন পুরো আউলা হলো। মাঠে, ঘাটে, হাটে যেখানেই যায়, মন থাকে বউ’র কাছে। নিজের ধানের ক্ষেতে নিড়ানি দেবার সময়-ও মন উসখুস করে এখনও। আজ যেমন করছে। নিবিড় সবুজের ওমের ভেতর ললিতার বুকের ওম দু’হাতের কবজি বেয়ে শিরশির ক’রে ছড়িয়ে পড়ে দেহে। নিড়ানীর বাঁটের মতো শক্ত, উদ্ধত হয়ে ওঠে নিঃসঙ্গ। মুঠো ক’রে ধ’রে চেপে চেপে যতই শান্ত করতে চায়, ততই ফুঁসে ওঠে। বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়ে। নিড়ানি রেখে উঠে দাঁড়ায় জামাল। একবিঘা জমিতে আর কয়েকদিন দুইবেলা নিড়ানি দিলে আগাছা পরিষ্কার হবে। তাড়াহুড়োর কিছু নেই। একটু হেঁটে ওদের বাড়ীর সরুপথে এসে পড়লো জামাল।
মেহগনি আর আম-কাঁঠালের ছায়া বিছানো ওই পথটায়। একটু দ্রুত এসে দাঁড়ালো উঠোনটায়। ললিতাকে দেখা যাচ্ছে না। ধোঁয়া উড়ছে রান্নাঘর থেকে। ছেলেটা এই ভরদুপুরে খেলতে খেলতে ধুলোমাখা গায়ে ঘুমিয়ে পড়েছে মাাটর বারান্দায়। জামাল হালকা স্বরে ডাকলো, নলিতা…., ও নলিতা…। (জামাল ললিতা বলতে পারে না, এই নামটা ললিতার বাবা রেখেছিলেন মাইকে ‘ও ঘাটে জল আনিতে যেও না, ও ললিতে’ এই গানটা শুনে)। চুলায় পাঠকাঠির অবাধ্য আগুন। ভাত ফুটছে টগবগ ক’রে। আগুনের আঁচ বাঁচিয়ে আঁচল দিয়ে ঘাম মুছছে ললিতা। কপালের একপ্রান্ত থেকে থুতনির নিচ পর্যন্ত মুছে ঘাড় ফেরাতেই দেখে জামাল দাঁড়িয়ে আছে। বেশীক্ষণ আগুনের আঁচে থাকায় ললিতার ফর্সা মুখ টুকটুকে লাল হয়ে উঠেছে। যেনো রক্ত মাংসের আগুনের শিখা। গরমে বুকের আঁচল ফেলে এলোমেলো হয়ে রাঁধছিলো। ছোটোখাটে ছিপছিপে রক্তিম শরীরে ওর ওই পুষ্ট স্তনদুটো দুই হাঁটুর হালকা চাপে উপচে পড়ছে। পাকা ডালিম ফেটে যেনো পড়বে এখনই। জামালের এইভাবে দাঁড়ানো দেখে হেসে ফেললো ললিতা। ওর অনাহুত আগমন জানে। এর হেতু জানে। তবু সরু রক্তাভ মিহি ঠোঁটদুটো বেঁকিয়ে বললো, কী গো জাকিরির বাপ, অসুমায় মৌচাকে ঢিল দিতি আইচাও? কামড় খাতি পারবা তো? রসিকতা কানে গেলো না। ইশারা করলো শুধু। ললিতা মগের পানি নিয়ে ছিটিয়ে দিলো চুলোয়। পাটকাঠিতে ফুছফুছ শব্দতুলে নিভে গেলো আগুন।
ধোঁয়া উঠলো একটু। ললিতাও উঠে দাঁড়ালো। আর তর সইলো না জামালের। বউকে শোলার মতো তুলে আড়কোলা ক’রে ঘরের নিয়ে গেলো। জামালের সবুজ ধান আরও সবুজ হয়ে উঠেছে। আগাছাও পাল্লা দিতে চায় ধানগোছার সাথে। জামাল বোঝা বোঝা কেটে বাড়ী নিয়ে আসে। গরু ছাগলে প্রাণ ভরে খায়। একদিন যখন আগাছার আঁটি মাথায় নিয়ে বাড়ী আসছে, পথে মফিজের সাথে দেখা। মফিজদের বাড়ী বড় রাস্তা থেকে একটু পাড়ার ভেতরে। মিনিদের বাড়ীর পাশেই। মফিজ ওর এঁড়েটা নিয়ে মাঝে মাঝে মাঠের ভেতরেও যায়। দড়ি ধ’রে আলের ঘাস খাওয়ায়। বিকেলে এঁড়েটাকে ঘাস খাইয়ে বাড়ী ফিরছিলো। জামালকে দেখে বললো, জামাল ভাই, তুমার জমিতি তো দারুণ ঘাস। আমার কালো-মানিকির জন্যি যদি এটটু ঘাস দিতে, ভালো হইতো। জামাল বোঝা নামাতে গেলো। মফিজ বাধা দিয়ে বললো, না না, তুমার বুঝাত্তে দিতি হবে না। আমি তুমার সাতে ভুঁই নিংড়োয়ে ঘাস নোবো, ফিরি ফিরি নোবো না। মফিজ হাসলো। বললো, কাইল সকালে আমাগের বাড়ী আইসো। গল্প-গুজব করবানে। জমিতি যাবানে তারপর। সকালে পান্তাভাত খেয়ে উঠোনে কুলি ফেলে তাকিয়ে দেখে পাশের বাড়ীর বারেক এগিয়ে আসছে ওর দিকে। মাথাটা একটু ঝাঁকালো মফিজ।
বারেক বললো, মফিজ তোর আঁইড়েডা এটটু লাগবে আইগের। আইদ ঘন্টার জন্যি দে। মফিজ বুঝতে না পারা চোখে তাকালো। বারেক আবার বললো, তুই আয় আমার সাতে, দেকতি পাবি। বারেকদের বাড়ীর উঠোনের এককোণায় শুকনো কলাপাতা দিয়ে একটা জায়গা আড়াল করা। ওরা সেদিকে নিয়ে গেলো এঁড়েটা। ওদেরকে দেখে তিনচারজন বন্ধু হেসে তাকালো। একজন বলে উঠলো, এ-ই মফিজ আয়, তোর কালোমানিক পাল দিতি পারবে ভালো। বাছুরও হবে তোর আঁইড়ের মতোন। খুঁটো থেকে দুটো বাঁশ দু’দিকে মেলে পুঁতে দেওয়া হয়েছে। তার ভেতরে একটি গাভী দাঁড় করানো। গাভীর পেটের দুপাশ ছুঁয়ে আছে বাঁশদুটো। পেছন-ফেরা গাভীটা। দেখেই এঁড়েটা দৌঁড়ে গেলো। হাতে টান লেগে হুমড়ি খাবার মতো অবস্থা মফিজের। কালোমানিক গাভীর পেছন শুঁকছে। দু’এক ফোঁটা চানার নিচে দাঁত শিঁটকে জিহবা মেলে দিয়েছে। অমৃত-বিন্দুর মতো পান করছে তা। মফিজ অবাক হয়ে দেখছে। ওর পেটের নিচ থেকে বেরিয়ে এসেছে বিশাল লম্বাকার লাল অগ্নি-শলাকা। সামনের দুইপা উঠিয়ে এগিয়ে গেলো হঠাৎ। পেছনটা সামনে-পেছনে করলো কয়েকবার। সেই শলাকা সেঁধিয়ে গেলো গাভীর অল্প-খোলা তুলতুলে যোনির ভেতরে। গোঁ গোঁ ক’রে শুয়ে পড়লো গাভীটা। একটু জিরিয়ে গা ঝাড়া দিয়ে উঠলো আবার।
মফিজ তাকিয়ে দেখে গাভীর যোনির কোয়া হা-হয়ে হেলে পড়েছে দু’দিকে। চিকন একফালি তরমুজ কাটলে যেমন রক্তিম হয়ে থাকে, জায়গাটা ঠিক তেমন। খোলা রক্তাক্ত তরবারীর মতো তরতরে লিঙ্গ-দ- নিয়ে যুদ্ধংদেহী এঁড়ে আবারও ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইছে। মফিজ ওর গরুর উম্মাদনা দেখলো বেশ কিছুক্ষণ। দড়ি ধরলো একসময়। কালোমানিককে রাস্তায় খুটো পুঁতে রেখে জামালের বাড়ীর দিকে গেলো। উঠোনে এসে দেখে জামালের বউ উঠোন ঝাঁট দিচ্ছে। একটু বেলা ক’রে ওঠা হয়েছে আজ। তাই বাসি উঠোনে ঝাঁটা পড়ে নি এখনও। একমনে ঝাঁটার গোড়া ধ’রে ঝিরঝিরে প্রান্ত বুলিয়ে যাচ্ছে মাটির গায়ে। ধুলোগুলো উল্লাসে উড়ে পিছিয়ে যাচ্ছে আর ললিতা সুলতানা রাজিয়ার মতো হঠিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ধূলিসৈন্য। ললিতার মুঠোয় ঝাঁটার তরবারী। লাল শাড়ীর আঁচল লুটিয়ে মাটি ছুঁয়েছে প্রায়-পতিত পতাকার মতো। খোলা কোমরের মেদে দু’তিনটে ভাঁজ। ঘামের নদী তিরতির ক’রে বইছে। যেনো সদ্য-ভাঙা কোনো চাকের মধু। সুপুষ্ট নিতম্বের ওপর দুলছে ভারী পশ্চাৎদেশ। কোমরের শাড়ী স’রে গিয়ে ভেসে উঠেছে লাল শায়া। অনেকটা উবু হয়ে ঝাঁট দেয়ায় আর ঝাঁটার ঝা ঝা শব্দে কারও উপস্থিতি টের পায়নি ললিতা। ওপাশ থেকে ফিরে যখন মুখ ঘোরালো, মফিজের মাথা ঘুরে উঠলো একটু। গোলাপি ব্লাউজের বাঁধন ছেড়ে লাফিয়ে উড়তে চাইছে ললিতার জোড়া-কবুতর। রমণীর বুকের এমন ঢেউ মফিজের চোখে এই প্রথম। হালকা কাশি দিলো মফিজ। মুখ তুললো ললিতা। একটা হাত ঝাঁটার বাঁধন খুলে ঝুলে রইলো। একটু কাত হয়ে মফিজের দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। রাস্তা দিয়ে ওকে কয়েকবার গরুসহ হেঁটে যেতে দেখেছে ললিতা। ওর ওই তাগড়া গরুটার মতোই ডাগর এই ছেলে। পার্থক্য হলো, গরুটা কালো আর এ ফর্সা। ছিপছিপে শরীর বেশ সুঠাম ও সুন্দর। পৌরুষপূর্ণ। ললিতা অবাক হয়ে তাকিয়েই রইলো। ঠোঁট কাঁপছে। মফিজ জড়োসড়ো অবস্থা বুঝতে পেরে বললো, ভাবী, আমি মফিজ, জামাল ভাই আসতি বলিছিলো। ভাই বাড়ী আছে? ‘বাড়ী আছে, কিন্তু দাঁতন কত্তি কত্তি ওই জুলুগের বাড়ীর দিকি গেচে। আইসে পড়বে এককুনি। তুমি বারানে বইসো। বিছেন দিচ্চি।’ ‘না না ভাবী, বিছেন লাগবে না’। ‘তা কি হয় ভাই, পয়লা আইসলে আমাগের বাড়ী। না বসলি চলে? না-হলি চকি দিচ্ছি। কাঁটাল গাচের ছুমায় বসেন। আমি এটটা ডিম ভাইজে আনি । আমার মুরগীতি ডিম পাইড়তেচে।’ ‘না না ভাবী, কিসসু লাগবে না। ভাই না আসা পইন্ত আমি বসতিচি। তুমি কাজ করো’। কাঁঠাল তলার চকিতে বসে আছে মফিজ। ভাবছে, বাড়ীর কত কাছে তবু এই নতুন বাড়ীটায় আসা হয়নি। রাস্তা থেকে দু’একবার তাকানো পড়েছে। বাড়ীটার চারপাশে কচাগাছের সবুজ বেড়া। লকলকে পাতার আড়াল নির্জনতা এনে দেয় বাড়ীটাতে। জামাল ভাইকে গ্রামের ছেলে হিসেবে চেনে। ঘনিষ্টতা নেই। ভাবীকে দেখেনি কোনোদিন। কী সুন্দর ব্যবহার। দেখতেও ভালো। একদম খুকি খুকি চেহারা। মনে হয় বিয়েই হয়নি। প্রথম দিনে কত আদর আপ্যায়ন করতে ব্যস্ত হলেন। জামাল ভাইকে ভাগ্যবান মনে হলো। মফিজ আসার পর ঝাঁটাটা সরিয়ে হাতমুখ ধুয়ে রান্না ঘরের দিকে গেলো ললিতা। ভাবলো, এই ছেলেটা তো বেশ ভালো। কী সুন্দর ভাবী ভাবী ব’লে ডাকলো। মন ভরে উঠলো।
এত মধুর আন্তরিকতায় কেউ ভাবী ব’লে ডাকে নি ওকে। দেবর নেই ওর। আছে এক গুমরামুখো স্বার্থপর ভাসুর। যার জন্য বাপের ভিটে ছাড়তে হলো জামালের। ‘আরে মফিজ ককন আইলে?’ আইসো, দুডো পান্তা খাইয়ে নি। তারপর যাই জমিতি।’ জামাল মেহগনি গাছের কোণা দিয়ে আসতে আসতে বললো কথাগুলো। মফিজ উঠে দাঁড়ালো। গলা উঠিয়ে জামাল বললো, ও নলিতা, ছেইলেডা উইটেচে। ওরে কিচু খাতি দ্যাও। আবার তুমার এক দ্যাওর আইয়েচে আইজ। এটটু ভালো-মন্দ রান্দো। পয়লা দিন আইসলো। এরপরে প্রায় প্রতিদিন মফিজ আর জামাল সকালে কিছু একটা খেয়ে ধানক্ষেতে গিয়েছে। কত গল্প যে হয়েছে নিড়ানী চালাতে চালাতে। ক্লান্ত হয়ে বিশ্রাম নিয়েছে গাছের ছায়ায়। ললিতা এটা-ওটা রেঁধে গামছায় বেঁধে নিয়ে গিয়ে খাইয়ে এসেছে ওদের। একরকম পারিবারিক সম্পর্ক তৈরী হয়েছে। জামাল এক ভাইকে আড়াল ক’রে আরেক ভাই যেনো দেখেছে মফিজের ভেতর। অনেক সময় মফিজ নিজে থেকে বাজার ক’রে এনে দেয় ভাবীকে। মন ঢেলে দিয়ে রাঁধে ললিতা। কত কত দিন বাজার থেকে সন্দেশ এনে জামালের ছেলের মুঠোয় গুঁজে দিয়েছে মফিজ। ভাবীর জন্য জামতলার রসগোল্লা এনেছে। একদিন গল্পে গল্পে ললিতা বললো, মফিজ ভাই, আর কতদিন গরুর দড়ি ধইরে চলবা? এইবার ঘরে বউ আনো, বউর আঁচল ধরো। কথাগুলো বলার সময় ললিতার বিগলিত ভঙ্গি নজর এড়ালো না। শুধু রসিকতা বা রসের কথা বলার সময় নয়, মফিজ এ বাড়ীতে আসলেই ললিতা যেনো অন্যমানুষ হয়ে ওঠে। চোখমুখ চঞ্চল হয়। বার বার বুকের কাপড় সরায়। গরম লাগার ভান ক’রে বুকের কাপড় ফেলে রাখে বহুক্ষণ, জামাল সামনে না থাকলে। বার বার মফিজের চোখ-মুখের ভাষা পড়তে চেষ্টা করে। মফিজ সব বুঝতে পারে। ভাবে, একদিন মিনির কথাটা বলতেই হবে ভাবীকে। তা’ছাড়া ওর সাথে যোগাযোগের জন্য ভাবীর সাহায্য-ও দরকার। সেদিন রাতের বেলার সব ব্যাপার জেনে ফেলেছেন মিনির মা। হুংকার দিয়ে কাউফিউ জারি ক’রে দিয়েছে বাড়ীর চারদিকে। মিনিকে বলেছে, ওই ভবঘুইরে ছ্যামড়ার দিকি যদি তাকাইস, চোক তুইলে দোবো তোর। যে ছ্যামড়া গরুর দড়ি ধইরে ঢ্যান ঢ্যান কইরে বেড়াই সারাদিন, সে করবে সংসার? তোর খাওয়াবে কি? কোনো চালকি করবিনে। মনে রাকিস, আমি তোর মা। …. চিরে বাইর করিচি তোর।’ মিনি-ও ওর মায়ের মেয়ে। জিদ, সাহস আর মুখের জোর ওর-ও কম নেই। কিন্তু মাকে ও জমের মতো ভয় পায়। এখনও উল্টোপাল্টা কিছু হলে দমাদম কিল পড়ে পিঠে। গত ক’মাস ধ’রে মিনির নিরাপত্তার কথা ভেবে ওদের বাড়ীর দিকে উঁকিও দেয় না মফিজ। মাঝে মাঝে কেউ বাড়ী না থাকলে শিস দিয়ে চলে যায় তাড়াতাড়ী। মিনি কান্নাভেজা চোখে তাকায়।
জড়ানো অভিমান-রুদ্ধ স্বরে বলে, নুবা তে নুবা, না নুবা তে কইয়ে দুবা, রোজ রোজ শিস দিয়া-দিয়ি ভাল্লাগে না’। মফিজ ইশারায় জানায়, এখন নয়। ‘ভাবী আমার এটটা উপগার করবা?’ মফিজ গম্ভীর হয়ে জানতে চায়। ‘কী কতা কও?’ ললিতা একটু এগিয়ে এসে কান পাতার মতো ভঙ্গি ক’রে জিজ্ঞেস করে। ‘মিনির সাথে কতা হয়নি তিনমাস। কইলজেডা আমার ফুটো হইয়ে যাচ্চে। তুমি এটটু ব্যবস্তা করো।’ ‘ক্যান্ ক্যান্ মিনির সাতে কতা না কতি পারলি উরাম লাগবে ক্যান্?’ ললিতার রসিকতা। ‘ভা-বী, তুমি বুইজে শুইনে উরাম কইরে কউয়ে না, কিচু করতি পারবা কিনা তাই কও?’ ললিতা কিছু বললো না। ভাবলো কিছুক্ষণ। সন্ধ্যা পেরিয়েছে। ছেলেটা ঘরের ভেতর ঘুমিয়ে। হ্যারিকেনের অল্প আলোর আভা ছড়ানো বারান্দায়। রাতের রান্না করছে ললিতা। একটু দূরে পিড়িতে বসে কথা বলছে মফিজ। মিনির কথা বলাতে ললিতা কেমন যেনো নিভে গেলো। চুলার আগুন খুঁচিয়ে উসকে দেবার সময় উজ্জ্বল দেখতে পাচ্ছে ললিতার মুখ। সেই মুখে ভাবনার গভীরতা। চোখ আনত। আঁচলের প্রান্ত দিয়ে বাতাস করছে নিজেকে। ব্লাউজের একটি বোতাম খুলে ফাঁক হয়ে আছে বুক। চুলোর আগুনে বুকের আগুন দ্বিগুন হয়েছে ললিতার। মফিজ প্রথম দু’একবার তাকিয়ে ফিরিয়ে নিয়েছে দৃর্ষ্টি। ললিতা তরকারী নাড়ছে একমনে। ওড়ঙে ঝোল কেটে বাঁ হাতের তালুতে ঢেলে নুন চাখলো। পা দুটো হালকা দাপিয়ে কাপড়টা একটু উঠিয়ে কোলের ওপর গুঁজে রাখলো। মফিজ ললিতার ব্যস্তটা দেখছে। একটু পরে বলে, আমি এখন আসি, ভাবী। কাইল কিন্তুক মিনির খবর নিয়ে রাখবা। আমি আসপানে।’ ললিতা কোনোদিকে না তাকিয়ে ঘাড় নাড়লো শুধু। পরের দিন সন্ধ্যা। মফিজ জামালকে ডাকতে ডাকতে ঢুকলো বাড়ীর ভেতর। আজ এই সময় জামাল কোথাও আর যায়নি। সাধারণত জুলু কিংবা আলীদের বাড়ীর উঠোনে বসে পান-বিড়ি খায় আর গল্প-টল্প করে।
ললিতার রান্না হলে বাড়ী এসে রাতের খাবার খায়। মফিজকে আসতে দেখে আরেকটা পাটি আনতে বললো জামাল। ললিতা পাটি বিছাতে বিছাতে আড়চোখে দেখলো মফিজকে। নিজেও বসলো। এরপর জামালের দিকে তাকিয়ে বললো, শুনিচাও, আমার দেওরের পিরিতির ফুল ফুইটেচে। সেই ফুলির নাম, মিনি। ‘আরে তাই নাকি? তা এতদিন তো শুনিনি। তুই শুদু ভাবীর সাতে কইস, আমার সাতে তো ক’লি নে।’ ‘না জামাল ভাই। তেমন কিচু না। ঘটনাডা প্যাঁচ খাইয়ে যাচ্চে। তা ভাবী, কী খবর কও।’ ‘মিনি তো খুপ রাইগে আচে, তুমার পরে। তিন মাস হইয়ে গেলো দেকা নেই, সাক্তাৎ নেই। বইলেচে, উরাম লোকের সাতে আর আমি নেই। আমার বে পাকা হইয়েচে। ওর আমার আর দরকার নেই।’ ‘কী যে কচ্চাও তুমি? জামাল লাফ দিয়ে উঠে। বলে, আমি কতা বলবো ওর সাতে। দেকি ও কীরাম অন্য জাগায় বে করে?’ ‘না না না, তুমি কী কতা কবা ওর সাতে? ওর মা তুমার আস্ত রাখপে না। এই ঝামেলায় জড়াতি দোবো না তোমার।’ গলা উঠিয়ে ধমকের সুরে কথাগুলো ব’লে হাত চেপে ধরলো জামালের। মফিজ নীরবে উঠে দাঁড়ালো। বাড়ীর দিকে চলে গেলো। পরদিন সকাল। কালোমানিকের দড়ি ধরে জামালের বাড়ীর সামনে একটু থামলো একটু। ললিতা দেখতে পেয়ে হাত নাড়লো। মফিজ ইশারায় ব্যস্ততার কথা জানালো। ললিতা একটু চেঁচিয়ে বললো, আজ রাত্তির একটু আসপা, আরও কতা আচে।’ মফিজ মাথা নাড়লো। নিতান্ত অনিচ্ছা নিয়ে একটু রাত ক’রে জামালদের বাড়ীর উঠোনে পা রাখলো মফিজ। ধান কেটে গাদা করা আছে উঠোনে। কোনোরকমে পা ফেলার জায়গা আছে। নিজের পা-টাও দেখা যায় না এমন অন্ধকার। মেহগনির চারাগুলো, চারপাশের গাছপালা নিঝুম হয়ে আছে। মাঝে মাঝে মাঠের ওই দিক থেকে বাতাস আসছে। তাতেও ভাদ্র মাসের গুমোট কাটছে না। ফিরে যেতে ইচ্ছে হলো মফিজের। মনে হয় সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। মফিজ যেই পেছন ফিরলো, মিহি স্বরে ওর নাম ভেসে এলো অন্ধকারের ভেতর থেকে। ধীর পায়ে বারান্দার দিকে গেলো মফিজ।
‘ফিরে যাচ্চিলে কেনো?’ চিকন মধুর স্বর ললিতার। ‘ভাবলাম তুমরা ঘুমোই পড়িচাও, তাই।’ ‘তুমারে আসতি কইয়ে, আমি পড়বো ঘুমুইয়ে? এ আবার কীরাম কতা? আইসো, ঘরে আইসো।’ মফিজের হাত ধ’রে টেনে পশ্চিম দিকের ঘরে নিয়ে গেলো। পাশের ঘরে শুয়ে আছে ছেলেটা। নিবু আলোয় জ্বলছে হ্যারিকেন। কাঠের জানালার কপাটে খিল আঁটা। ঘরে ঢুকে মফিজকে দাঁড় করিয়ে পেছন ফিরে ঘরের শিকল আটকালো ললিতা। মফিজ এদিক-ওদিক দেখছে। ‘কী খুঁজদিচাও। তুমার জামাল ভাই বাড়ী নেই আইজ। আমার বাপ জরুরী খবর দেচে। ছোট ভাই আইসে নিয়ে গেছে বিকেল বেলা। কাইল আসপে।’ ‘আমি তা-লি যাই ভাবী’। মফিজ যন্ত্রের মতো বললো। যাবার কোনো লক্ষণ দেখা গেলো না। ‘না না, তুমি যাবা ক্যান্? কতা আচে তুমার সাতে। খাটের পরে বইসো।’ মফিজ বসে আছে। সুন্দর বিছানা করেছে ললিতা। লাল-গোলাপ ছাপার চাদর বিছানো। নতুন বিছিয়েছে। ন্যাপথলিনের গন্ধ বেরুচ্ছে। এমন সুন্দর লাগছে ওকে। কারণে অকারণে ঘুর ঘুর করছে। ভুর ভুর করে পাউডারের গন্ধ ভেসে আসছে ওর গা থেকে। একেবারে অন্যরকম একটা শাড়ী পরেছে আজ। এমন সাজ আর শাড়ীতে ললিতাকে কখনও দেখেনি ও। অন্যকোনো দিন হলে কত রকম রসিকতা করতো ভাবীর সাথে। আজ মনটা বিক্ষিপ্ত। মিনি ওকে বিয়ের ব্যাপারে মানা করেছে। কেমন ক’রে পারলো! জীবনে তো অন্য কারও দিকে তাকায়নি মফিজ। এই পঁচিশ বছরের উদ্দাম যৌবনে স্বপ্নে ও জাগরণে কত মেয়ের শরীর কল্পনায় আসতে চেয়েছে। ফিরিয়ে দিয়েছে জোর ক’রে। শুধু মিনির জন্যই। আজ ও-ই কি-না ফিরিয়ে দিলো। ‘এতো কী ভাবদিচাও মফিজ?’ ডান হাতটা চোয়ালে ঠেকিয়ে রেখে মধুর ক’রে জানতে চাইলো ললিতা। চোখ দুটো টলটলে হয়ে উপচে পড়লো মফিজের। ললিতার হাতে এসে পড়লো একফোঁটা। দু’হাতের তালুতে মফিজের মুখটা নিবিড় ক’রে ধরলো ললিতা। টেনে এনে বুকের ভেতর ঠেঁসে দিলো। ঘোরের ভেতর মফিজ বুঝতে পারেনি, ললিতা কখন ওর ব্লাউজ খুলেছে।
ব্রা পরার অভ্যাস ওর নেই। ললিতার বুকের অথৈ ঢেউয়ে ভাসছে মফিজের মুখমন্ডল। আধো চেতনায় ও যেনো দেখতে পাচ্ছে প্রথম দিনের ঝাঁট দেয়ার সময় ললিতার বুকের সেই অঢেলতা। আর কিছু ভাবতে পারছে না। লুঙির ভেতরে লিঙ্গের লকলকে উত্থান টের পাচ্ছে। ললিতা অনবরত অভ্যস্ত ভঙ্গিতে মফিজকে জড়িয়ে চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দিচ্ছে ঠোঁট, কপাল, চোখ, নাক সবই। ডানহাতটা বাড়ালো নিচের দিকে, লুঙি যেখানে শামিয়ানা হয়ে আছে। মফিজের নিচের ঠোঁটটা চুষতে চুষতে তাকালো মুখের দিকে। চুম্বন বর্ষণের মুহুর্মুহু পশলার এক প্রবল ঝাপটায় সম্বিত ফিরে এলো মফিজের। একটা হাত উপরে তুলে বললো, না ভাবী, এইডে ঠিক হচ্চে না। তুমি যাতি দ্যাও আমার।’ ‘লম্বা লম্বা শ্বাসে হাসফাস ক’রে ললিতা বললো, ঠিক বেঠিক জানিনে। তুমারে আমি চাই। একদিনির জন্যিও জামাল আমারে পুরোদমে সুখ দিতি পাইরলো না।
তিন বছর গেলো। শুদু ঘোনো ঘোনো চড়–ই পাখির মতো ওটে। কাজের কাজ তেমন কিচু পারে না। ওর মনডা খুপ ভালো। এইরাম মানুষ এই জামানায় পাওয়া যায় না। তাই মুক বুইজে সহ্য কইরে নিচ্চি। তুমারে আমি ছাড়তিচি নে। যেদিন আমার কতায় সায় না দুবা, সেইদিন বিষ খাবো। দেকতি পারবা তুমার ললিতার মরা মুখ? তুমি কী মনে করো, তুমার বুকির মদ্যি ডুব মাইরে দেকিনি আমি? ভাবী কইয়ে ডাকো, দূরি দূরি থাকো, আর তলে তলে আমারে কত ভালোবাসো, তা আমি বুজি নে?’ পুরুষির চোখ দেখলি মাইয়েরা বোজে উরা কী চায়? আইসো, একন আর ভাল মানষির ঢঙ করতি হবে না।’

আরো পড়তে পারেন...

আমার যতো ইচ্ছে |

কিছুই ভালো লাগে না, মনে হয় লেখাপড়ার নামে সবাই আমাকে বন্দি করে রেখেছে। মা বলেন,…

এবং একদিন | তাজনীন মুন

‘-মা, এমা,  দেইখা যাও আব্বায় আইজ কত্তো বাজার পাঠাইছে। সুগন্ধি চাইল রান্তে কইছে আইজ। রমিলা…

অপরিচিতা-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-১ম খন্ড

আজ আমার বয়স সাতাশ মাত্র। এ জীবনটা না দৈর্ঘ্যের হিসাবে বড়ো, না গুণের হিসাবে। তবু…