গোলামের ছদ্ম বেশে
হযরত আবদুল্লাহ বিন মোবারক বর্ণনা করেন, মক্কাতে এক দীর্ঘ অনাবৃষ্টির ফলে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দিল। এ পরিস্থিতিতে একদিন মক্কাবাসীরা দোয়ার জন্য হেরেম শরীফে একত্রিত হল। ঐ জামাতে আমি ও উপস্থিত ছিলাম। হঠাৎ এক হাবশী গোলামের উপর আমার দৃষ্টি পড়ল। তাঁর পরনে একটি লুঙ্গি ও কাঁধে একটি গামছা ঝুলানো ছিল। সে জনতা হতে পৃথক হয়ে একটি নীরব স্থানে বসে একান্ত নিভৃত্ত্বে বৃষ্টির জন্য দোয়া করতে লাগল।
আমি নিকটে গিয়ে তাঁর কণ্ঠ শুনতে পেলাম। সে আকাশের দিকে হাত তুলে বলছিল, হে পরওয়ারদিগার আলম! তোমার নাফরমানীর কারণে মানুষের চেহারা সুরত বিবর্ণ হয়ে গিয়েছে। হে আজাব বিলম্বকারী আল্লাহ! হে ঐ মহান সত্বা! যার নিকট তাঁর বান্দারা শুধু কল্যাণই আশা করে, এ মুহূর্তে তুমি রহমতের বৃষ্টি বর্ষণ কর। এভাবে সে কায়মনো বাক্যে মুনাজাত করতে লাগল। কয়েক মুহূর্ত পর হঠাৎ আকাশ মেঘলা করে প্রবল বর্ষণ শুরু হল। যুবক মুনাজাত শেষ করে রওয়ানা হলে আমি তাকে অনুসরণ করে তাঁর বাড়ী চিনে নিলাম।
উপরোক্ত ঘটনার পর আমি হযরত ফোজায়েল (রহঃ) এর খেদমতে উপস্থিত হয়ে বিস্তারিত ঘটনার বর্ণনা করলাম। ঘটনা শুনে তিনি হঠাৎ বিকট স্বরে চিৎকার দিয়ে উঠলেন। কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর বললেন, হে ইবনে মোবারক! তোমার বিনাশ হউক! তুমি আমাকে সেই হাবশী গোলামের নিকট নিয়ে চল। আমি বললাম, এখন নয়, তাঁর ব্যাপারে বিস্তারিত জানা প্রয়োজন।
পরদিন ভোরে ফজরের নামায আদায়ের পর আমি তাঁর বাড়িতে গেলাম। ঘরের দরজায় এক বৃদ্ধা বসা ছিল। সে আমাকে চিনতে পেরে স্বাগত জানিয়ে জিজ্ঞেস করল, কি প্রয়োজনে এসেছ? আমি বললাম আমার হাবশী গোলামের প্রয়োজন। বৃদ্ধ বলল, আমার নিকট মোটা তাজা অনেক গোলাম আছে, তুমি তা থেকে একজন কে বেঁচে খরিদ করতে পারবে।
অতঃপর সে আমাকে এসে একে একে অনেক গোলাম দেখাল। কিন্তু আমি যার সন্ধানে এসেছি তাকে দেখতে না পেয়ে বললাম, তোমার কোন গোলামই আমার পছন্দ হয়নি। এগুলো ছাড়া অন্য কোন গোলাম থাকলে দেখাও অবশেষে আমার সে কাঙ্ক্ষিত বর্ণনা পাতলা গোলামটিকে দেখানো হল। তাকে দেখামাত্র আমার মুখ উজ্জ্বল হয়ে গেল। আমি তাকে ক্রয় করার প্রস্তাব দিলাম।
কিন্তু বৃদ্ধ তাকে বিক্রি করতে অস্বীকার করে বলল এই গোলামের উছিলায় আমার ঘরে বরকত নাযিল হয়। অথচ তাঁর পেছনে আমার কোন তাকা পয়সা খরচ করতে হয় না। সে রশি বানিয়ে বিক্রি করে এবং ঐ পয়সা দ্বারাই আহার করে। যেদিন রশি বিক্রি না হয় সেদিন অভুক্ত থাকে। সে কারো সাথে ঝগড়া বিবাদ ও গল্প-গুজব করে সময় নষ্ট করে না। রাত ভর ইবাদত বন্দেগী করে কাটায়। অথচ দিনের বেলায় ও সে নিদ্রার নাম মাত্র নেয় না।
হযরত আবদুল্লাহ বিন মোবারক (রহঃ) বলেন, অবশেষে বহু অনুনয়ের পর বৃদ্ধের নিকট থেকে সেই গোলাম খরিদ করে আমি শায়েখ ফোজায়েলের বাড়িতে রওয়ানা দিলাম। কিছুদূর যাবার পর গোলাম আমাকে ডাকল। আয় আমার মাওলা! আমি বললাম লাব্বায়েক! গোলাম বিচলিত হয়ে বলল, আমার আহ্বানের জবাবে আপনি কেন লাব্বায়েক বলছেন? বরং মনিবের আহ্বানের জবাবে গোলামের মুখেই লাব্বায়েক শোভা পায়। অতঃপর আমি বললাম, হে বন্ধু! আমাকে কেন ডেকেছ বল?
গোলাম বলল, হে মনিব! আমি একজন দুর্বল মানুষ আপনার কোন খেদমত করতে পারব এমন শক্তি আমার নেই। অথচ আমার মনিব আপনাকে অনেক মোটা তাজা গোলাম দেখিয়েছিল। আপনি তাদেরকে খরিদ না করে আমাকে কেন খরিদ করলেন?
উত্তরে বক্তব্য শুনে গোলাম অজস্র ধারায় কাঁদতে কাঁদতে শুরু করল। আমি জিজ্ঞেস করলাম হে বন্ধু! তুমি কেন কাঁদছ? সে বলল, তুমি নিশ্চয়ই আমার পরিচয় পেয়েছ, অন্যথায় এত গোলাম থাকতে তুমি কিছুতেই আমাকে ক্রয় করতে না। তুমি বল, আমার কোন আমলটি তোয়াম্র পছন্দ হয়েছে? আমি বললাম, আমি তোমার দোয়া কবুল হতে দেখেছি।
গোলাম এবার বলল, আসলে তুমি নিজেও একজন আল্লাহ ওয়ালা বুজুর্গ। কারণ আল্লাহ পাক তাঁর বান্দাদের মধ্যে যাকে ভালবাসেন তাঁর নিকটই ওলী আল্লাহদের হালত ও পরিচয় প্রকাশ করা হয়।
অতঃপর সে বলল, আমার রাতের কিছু নামায রয়ে গেছে, যদি সুযোগ দাও তবে এখন তা আদায় করবে। সে বলল, না, তুমি সম্মত হলে আমি এখানেই আদায় করব। নেক আমলে বিলম্ব করা ভাল নয়। অতঃপর সে পাশের একটি মসজিদে পরবেশ করে নামায আদায়ের পর ফিরে এসে আমাকে বলল, হে আবু আব্দুর রহমান।
তোমার কিছু প্রয়োজন থাকলে বল। আমি বললাম, তুমি একথা জিজ্ঞেস করছ কেন? সে বলল, আর তো সময় নেই। আমি এখন চলে যাচ্ছি। আমি বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কোথায় যাবে? গোলাম ধীর সান্ত কণ্ঠে জবাব দিল, আখেরাতের সফরে। আমি বিচলিত হয়ে বললাম, বন্ধু! একটু বিলম্ব কর। তোমাকে একটু সুখী করতে সুযোগ দাও।
গোলাম বলল, যতদিন আল্লাহর সাথে আমার সম্পর্ক গোপন ছিল ততদিন এ জীবন শান্তিময়। এখন তুমি আমার পরিচয় পেয়েছ আরো অনেকেই আমাকে চিনে ফেলেছে। সুতরাং দুনিয়ার এ জীবন এখন আমার নিকট বড় দুঃসহ। একথা বলেই সে উপরের দিকে হাত তুলে বলল, হে পরওয়ারদিগার! এ মুহুর্তে তুমি আমার জান কবজ করে নাও। সাথে সাথে তাঁর প্রাণ বের হয়ে গেল।